বাংলাদেশে প্রায় ৭০ ধরনের ফল জন্মে । বহুল প্রচলিত ফলের মধ্যে কলা, আম, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, পেঁপে, লেবু, বাতাবিলেবু, লিচু, কুল এবং নারিকেল উল্লেখযোগ্য । অন্যদিকে কামরাঙ্গা, লটকন, সাতকরা, তৈকর, আতা, শরিফা, জলপাই, আমড়া, কদবেল, আমলকি, জাম, ডালিম, সফেদা, জামরুল, গোলাপজাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য অপ্রচলিত ফল । বাংলাদেশে বহু রকম ফল উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও মাথাপিছু দৈনিক ফলের প্রাপ্যতা ৩০-৩৫ গ্রাম যা পুষ্টিবিজ্ঞানীদের সুপারিশকৃত ন্যূনতম চাহিদা মাত্রার ৮৫ গ্রাম থেকে ও কম । বিশ্ব খাদ্য সংস্থার হিসাব মতে এক জন মানুষের গড়ে ১০০-১২০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত । বর্তমানে (২০০৬-০৭) বাংলাদেশে ১ লাখ ৪৪ হাজার ২ শত ষাট হেক্টর জমি থেকে ৪১ লাখ ৩১ হাজার ১ শত ৩০ টন ফল উৎপাদন হয় । অথচ দৈহিক ১১৫ গ্রাম হারে দরকার ৬২.৯৬ লাখ টল । ফলের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় ২১.৫ লাখ টন কম । জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ফল প্রাপ্তির পরিমাণও বাড়াতে হবে । ২০০৬-০৭ সালে বাংলাদেশে ১৪৪.২৬ হাজার হেক্টর জমিতে ফল চাষ করা হয় । এই জমির পরিমাণ উক্ত সময়ের মোট আবাদি জমির শতকরা মাত্র ০.৭৫ ভাগ। এতে প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে ফল চাষের জমির পরিমাণ খুবই নগণ্য । ফল চাষের জমির পরিমাণ আস্তে আস্তে বাড়ছে । তবে এই বৃদ্ধির হার অত্যন্ত কম । ১৯৭১-৭২ সালে ১৩০ হাজার হেক্টর, ১৯৯০-৯১ সালে ১৬৭.৭১, হাজার হেক্টর, ১৯৯৪-৯৫ সালে এই জমির পরিমাণ ১৭৬.৫১ হাজার হেক্টর এবং ২০০৬-০৭ সালে ১৪৪.২৬ হাজার হেক্টের । তবে এ সময় জমির পরিমাণ কমলেও হেক্টর প্রতি ফলন বৃদ্ধি পায় । বাংলাদেশের অধিকাংশ আবাদি জমিতে মূলত দানাজাতীয় শস্যের আবাদ বেশি । সেই সাথে আলু, আম ও পাটের আবাদ লক্ষণীয় । এরপরও ফলের আবাদি এলাকা যথেষ্ট পরিমানে বৃদ্ধি পেয়েছে । বিগত ১৫-১৬ বছরে দানা জাতীয় শস্য এবং ফল উৎপাদনের জমির পরিমাণের তুলনামূলক একটি পরিসংখ্যান সারণি -১ এ দেয়া হলো:
সারণি -১ বাংলাদেশের মোট আবাদি জমির পরিমাণ ও বিভিন্ন ফলের বিপরীতে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ জমির পরিমাণ ০০০ হেক্টর
উপরোক্ত তালিকাতে হতে দেখা যায় যে, মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ এবং দানাজাতীয় ফসলের জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমেছে এবং ধীরে ধীরে ফল চাষের জমির পরিমাণ বাড়ছে। ফল চাষের জমির পরিমাণ ২০০৬-০৭ সালে শতকরা হারে দাঁড়িয়েছে শতকরা ০.৭৫ ভাগ যা মোটেই সন্তোষজনক নয় । অথচ এই সময়েই দানাজাতীয় ফসলের আওতায় জমির পরিমাণ শতকরা হার ছিল ৫৯.১৯ ভাগ । ইতিমধ্যে ফলের চাহিদা বৃদ্ধি এবং তুলনামূলক হেক্টর প্রতি উৎপাদন হার বৃদ্ধি পেয়েছে । তথাপি ফল উৎপাদনের এলাকা আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ফলের আওতায় জমির পরিমাণ
বাংলাদেশে ফল চাষের আওতায় জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা খুবই কঠিন । এর প্রধান কারণ হচ্ছে দুএকটি প্রধান ফসল ছাড়া অধিকাংশ ফলই ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পরিকল্পিত বাগান আকারে বেশি পরিমাণ জমিতে চাষ করা হয় না । তাছাড়া ক্ষেতের বিভিন্ন আইল, রাস্তাঘাট, অফিস আদালত প্রাঙ্গনে ও বসত বাড়ির আশে পাশে জন্মানো বিভিন্ন ফল গাছের সংখ্যা, জমির পরিমাণ ও মোট উৎপাদন সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয় । তবুও বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রতি বছর অনুমানের উপর ভিত্তিতে করে বিভিন্ন ফলের অধিনস্থ জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ নির্ণয় করে থাকে । বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্টাটিসটিকস এর তথ্য অনুযায়ী ২০০০ ২০০১ - ২০০৬-০৭ পর্যন্ত ফল চাষের আওতায় মোট জমির পরিমাণ, উৎপাদন এবং হেক্টর প্রতি ফলন সারনি ২ এ দেয়া হলো ।
সারণি:- ২ বাংলাদেশে ফলের আওতায় জমির পরিমাণ, মোট উৎপাদন এবং হেক্টর প্রতি ফলন ।
উপরোক্ত সারনি হতে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে বর্তমান ফল চাষের আওতায় মোট জমির পরিমাণ ১৪৪.২৬ হাজার হে:, মোট ফল উৎপাদনের পরিমাণ ৪১৩১.১৩ হাজার টন । ফল চাষের অন্তর্ভুক্ত উক্ত জমি মোট চাষাবাদ যোগ্য জমির মাত্র শতকরা ০.৭৫ ভাগ । এ হতে এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশে ফল চাষের আওতায় জমির পরিমাণ ক্রমশ হ্রাসবৃদ্ধি হচ্ছে । তবে এ হ্রাস বৃদ্ধির হার তেমন উল্লেখযোগ্য নয় । উপরের সারণিতে দেখা যায় যে, ২০০০-০১ সনে মোট জমির পরিমাণ ছিল ১৯১,৬৬ হাজার হে: যা কমে ২০০৬-০৭ সনে হয়েছে ১৪৪.২৬ হাজার হে: এবং ফলের মোট উৎপাদন ১৪৮৪,৩১ হাজার টন হতে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪১৩১.১৩ হাজার টন । মোট জমির পরিমাণ কমলেও উৎপাদিত ফলের পরিমাণ বেড়েছে । দুঃখের বিষয় হেক্টর প্রতি ফলন বাড়লেও জমির পরিমাণ কমে গেছে। ২০০০-০১ সনে যেখানে ফলন ছিলো ৭.৭৪ টন/হেঃ সেখানে ২০০৬-০৭ সনে উৎপাদন পাওয়া গেছে ২৮.৬৩ টন/হেঃ । এই সারণি-১ হতে বুঝা যায় ফল চাষে কৃষকের তেমন আগ্রহ নেই । উপযুক্ত পরিচর্যা, উন্নত প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহারে হেক্টর প্রতি ফলের উৎপাদন বাড়লেও বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ, কৃষকের দরিদ্রতা, কৃষি ঋণের অভাব, উপকরনের দুর্মূল্য, পরিবহনের সুযোগের অভাব, বাজার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে ফল চাষের আওতায় জমি কমে যাচ্ছে ।
অঞ্চলভিত্তিক ফল চাষের জমির পরিমাণ
এলাকাভিত্তিক পছন্দ – অপছন্দ, পরিবেশ, জলবায়ু এবং আবহাওয়াগত পার্থক্যের কারণে ঐতিহ্যগতভাবে এক - এক অঞ্চলে এক এক রকমের ফল ফলাদি উৎপাদন বা চাষাবাদ হয়ে থাকে। সব রকমের ফল সকল অঞ্চলে সমভাবে চাষ হয় না । যেমন- উত্তর বঙ্গে উৎপাদিত আম বা লিচু বরিশাল অঞ্চলে চাষাবাদ হয় না । অপরদিকে ঢাকা অঞ্চলের কাঁঠাল অন্য অঞ্চলে সমভাবে সমমাণ সম্পন্ন হয় না । একইভাবে নারিকেল, সুপারি, পেয়ারা বরিশাল এবং খুলনা অঞ্চলে যেমন চাষ হয় অন্য অঞ্চলে তেমন হয় না। বাংলাদেশের এটা সার্বিক চিত্র। তারপরও গবেষণা এবং উন্নতর প্রযুক্তি বিস্তারের মাধ্যমে এক অঞ্চলের ফল অন্য অঞ্চলেও প্রসার লাভ করছে । যেমন- সিলেট অঞ্চলের কমলার চাষ পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও অঞ্চলেও বিস্তার লাভ করছে। উল্লেখ্য যে, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট অঞ্চলভিত্তিক ফল গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সারা দেশে ৭৩টি হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে ফল চাষ সম্প্রসারণ এবং অনেক বেসরকারি নার্সারি উন্নত জাতের চারা কলম উৎপাদনের মাধ্যমে ফল চাষের এলাকা ও উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । বর্তমানে বাংলাদেশের ছয়টি বিভাগে ফল চাষের আওতায় জমির পরিমাণ, উৎপাদন ও ফলন সারণি - ৪ এ দেয়া হলো ।
সারণি- ৪ বিভাগ ওয়ারী ফলের চাষের জমির পরিমাণ ও মোট উৎপাদন
(জমির পরিমাণ ০০০ হে: এবং ফলন ৩০০ টনে)
উপরের সারণি হতে দেখা যায় বাংলাদেশের ছয়টি বিভাগের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং খুলনা বিভাগে ফল চাষের অন্তর্ভুক্ত জমি ও উৎপাদনের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই । তাছাড়া ঐ বিভাগগুলোতে বিগত কয়েক বছর ফলের জমি ও উৎপাদন মাটামুটিভাবে একই অবস্থানে আছে। আরও লক্ষণীয় যে, ফলের জমির দিক থেকে চট্টগ্রাম বিভাগ বরারই প্রথম স্থানে ও সিলেট বিভাগ সর্বনিম্নে অবস্থান করছে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বাধিক জমিতে ও সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম জমিতে ফল উৎপাদন হয় ।
ফল চাষ বৃদ্ধিতে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি প্রণয়ন
বাংলাদেশে ফল চাষ, ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ফলের মানান্নেয়নের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। দেশের খাদ্য চাহিদা পুরণে ও পুষ্টি সমস্যা সমাধানে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম । খণ্ড খণ্ড পতিত ও অব্যবহৃত জমি ব্যবহারের মাধ্যমে বেশি বেশি উৎপাদন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে এবং শিল্পের বিকাশ ঘটাতে ফল চাষ সম্প্রসারণ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে । আমাদের দেশে জনসংখ্যার চাপে চাষযোগ্য জমি আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে । চাষের নিবিড়তা বাড়িয়ে অল্প জমি থেকে বেশি বেশি পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব ।
কোন ফলের চাষ করে একই পরিমাণ জমি হতে নির্দিষ্ট সময়ে বেশি পরিমাণ পুষ্টিকর ফল পাওয়া যায় তা নির্ণয় করা দরকার । তবে সাধারণভাবে দেখা যায় যে বাংলাদেশের সর্বত্র কম বেশি কলার চাষ হয় এবং এটি উচ্চ ফলনশীল ফসল হিসেবে সুপরিচিত। কলার চাষ করে প্রতি হেক্টরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অন্যান্য অনেক ফসলের চেয়ে বেশি পরিমাণে ফলন ও পুষ্টি উপাদান পাওয়া সম্ভব। একই ভাবে পেঁপে এবং পেয়ারা চাষ করেও অল্প সময়ে বেশি লাভবান হওয়া যায় । আমাদের দেশে ফলের বার্ষিক চাহিদা (জনসংখ্যা ১৫ কোটি ও ফলের চাহিদা দৈনিক ১১৫ গ্রাম ধরে) ৬২,৯৬ লাখ মেঃ টন। অথচ বর্তমানে বার্ষিক উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৪১.৩১ লাখ মেঃটন । এ জন্য ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে হলেও আমাদের ফল উৎপাদন আরও ২১, ৬৫ লাখ টন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন । জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এ চাহিদা ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি পাবে । এছাড়া প্রতিদিন প্রায় ২০২ হেক্টর জমি চাষের আওতা বহির্ভূত হয়ে যাচ্ছে ।
বাংলাদেশে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। ভূমির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বিজ্ঞানভিত্তিক ফসল বিন্যাস, উন্নত চাষাবাদ, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি, এলাকাভিত্তিক ফসল বিন্যাস, এলাকাভিত্তিক উৎপাদন পরিস্থিতি ও চাহিদা নির্ণয় এবং প্যাকেজিং ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা, কো-অপারেটিভ পদ্ধতি, সরকারী নীতি প্রণয়ন করে ফলের আওতায় জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। ময়মনসিংহের গারো পাহাড়, সিলেট, চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা, বৃহত্তর দিনাজপুরের উঁচু ভূমি, সড়ক ও রেলপথের পাশে, অফিস আদালত ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আশেপাশের অব্যবহৃত স্থানসমূহে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফলের চাষ করা সম্ভব । রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, কুষ্টিয়ার চর এলাকা এবং খোলা চরাভুমিতে আরও দ্রুত বর্ধনশীল ফলের চাষ সম্ভব।
ফল উৎপাদন বৃদ্ধি করা হলে সামগ্রিকভাবে দেশের কি উপকার হতে পারে তা নিচে উল্লেখ করা হলো
ক) খাদ্য ঘাটতি পূরণ ও পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ
বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছরই সচরাচর ১৫-২৫ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি বিরাজ করে । প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কারণে এ ঘাটতি আরও বেশি হতে পারে । খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার সাধারনত শতকরা প্রায় ১.৮ ভাগ । অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রায় শতকরা ২.১৭ ভাগ । মাথাপিছু জমির স্বল্পতা এবং আবাদযোগ্য জমি কমে যাওয়া, সেচ সুবিধার অভাব এবং প্রযুক্তি সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা, কারিগরি জ্ঞানের অভাব ও উপকরনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা, দানাজাতীয় শস্যের হেক্টর প্রতি ফলন কম, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কারণে কেবল দানা জাতীয় শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মসূচি গ্রহণ করে খাদ্য এবং পুষ্টি ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয় ।
মাণব দেহকে সুস্থ ও সবল রাখার জন্য পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ প্রধান । পুষ্টি উপাদানের সবচেয়ে সহজ ও সস্তা উৎস হলো ফল। বাংলাদেশে ফলের ঘাটতি আছে । অপরদিকে পুষ্টিহীনতা বিরাট সমস্যা । তাই ফল উৎপাদন বৃদ্ধি করে পুষ্টিহীনতা দূর করা সম্ভব।
(খ) কৃষকের আয় বৃদ্ধি
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শস্য জাতীয় ফসল আবাদের চেয়ে ফল চাষ বেশী লাভজনক। যেমন- এক হেক্টর জমিতে কলা । চাষ করে বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব । উন্নত জাতের কুলের একটি গাছ হতে (৬ মিটার ৬ মিটার জমিতে) বছরে ১০০০/- টাকা পর্যন্ত কুল বিক্রি করা যায় । এক হেক্টর জমিতে পেঁপে চাষ করে বছরে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা উপার্জন করা সম্ভব । অনুরূপভাবে তরমুজ, বাঙ্গি বা ফুটি, পেয়ারা ইত্যাদি চাষ করে অধিক আয় করা সম্ভব । দানাজাতীয় শস্য চাষ করে এত বেশি লাভ করা সম্ভব নয় । নিচের সারণিতে তা দেখানো হলো।
সারণি -৫ দানা শস্য ও ফল চাষের আনুপাতিক আয় (ফলন টনে, লাভ টাকায়)
২.৮% উৎস: বেনসন এটেলজ/৯৮
(গ) কর্মসংস্থান: দ্রুত বর্ধনশীল ফলের চাষে শ্রমিক বেশি লাগে । ফল চাষে কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের পরিচর্যার প্রয়োজন হয় । যেমন সাকারকাটা, ফল পাতলা করা, অঙ্গ ছাটাই, গর্ত তৈরি ইত্যাদি । জমি তৈরি হতে শুরু করে সার প্রয়োগ, সেচ প্রদান, ফলের চারা ও কলম উৎপাদন, দীর্ঘ সময় ধরে ফল সংগ্রহ, প্যাকিং, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ ইত্যাদি কাজে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে ।
(ঘ) শিল্পের বিকাশ: অধিকাংশ ফলের উৎপাদন মৌসুম ভিত্তিক। এ জন্য এক এক মৌসুমে এক এক ফল সীমিত সময়ের মধ্যে পেকে যায় এবং অন্য সময় তা পাওয়া যায় না। এ অবস্থা বিবেচনায় পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ হিমাগার প্রতিষ্ঠা করে এবং প্রক্রিয়াজাত করে ফল সংরক্ষণের জন্য শিল্প গড়ে তুলেছে। ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে এর বহুবিধ ব্যবহার এবং সংরক্ষণের জন্য আমাদের দেশেও শিল্প গড়ে তালোর সুযোগ আর ফল সংগ্রহাত্তের গ্রেডিং ও প্যাকিং, ফলের বিভিন্ন উপজাত দ্রব্য তৈরি করা ইত্যাদি । উদাহরণ হিসাবে বলা যায় - নারিকেল ও বাদাম হতে তেল তৈরির কারখানা, নারিকেলের ছোবরা হতে দড়ি ও গদি তৈরি এবং ছাবেরা নার্সারিতে ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়াও পেয়ারা, আনারস, আম, কমলা, চালকুমড়া ইত্যাদি ফল দ্বারা জ্যাম, জেলী, জুস, মারব্বা, শরবত ইত্যাদি পুষ্টিকর এবং উপাদেয় দ্রব্যদি তৈরির কারখানা স্থাপন করা যায়।
(ঙ) বৈদেশিক মুদ্রা আয় : সঞ্চয় ও বিদেশে টাটকা ও প্রক্রিয়াজাত করা ফলের যথেষ্ট চাহিদা আছে। আমদাি নকারক দেশের চাহিদা অন্যায়ী উৎপাদন ও গ্রেডিং করা ফল পরিষ্কারকরণ, প্যাকেজিং ও টাটকা অবস্থায় পরিবহণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফল বিদেশ থেকে আমদানী করা হয় । দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বিদেশের চাহিদা মোতাবেক দেশীয় প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলসমূহের চাষ বৃদ্ধি করে আমদানীর পরিমাণ কমিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে। এতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে যাবে এবং বাড়তি আয়ও করা যাবে ।
(চ) জমির সদ্ব্যবহার: জমির আইলে তাল, খেজুর, সুপারি গাছ লাগানো যায় । এতে প্রধান ফসলের ক্ষতি ছাড়াই বাড়তি ফসল পাওয়া সম্ভব । এছাড়াও আমাদের দেশে অনেক পতিত জমি আছে, যেখানে ধান বা অন্য কোন দানাজাতীয়, তৈলজাতীয় বা অন্য কোন ফসল করা সম্ভব হয় না। অথচ এসব পতিত জমি অঞ্চল ভেদে লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্দিষ্ট ফল চাষের মাধ্যমে পতিত জমি ব্যবহার উপযোগী করা যায় এবং সেই সাথে ফলের উৎপাদন ও বৃদ্ধি করা সম্ভব ।
(ছ) ঔষধ হিসেবে ব্যবহার: আমলকি, বেল, হরিতকি, পেঁপে, কমলালেবু, ডালিম, বেদানা, পেয়ারা, আম ইত্যাদি ফল ঔষধ হিসেবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য ফলের রস অপরিহার্য । পেটের পীড়ার জন্য বেল ও পেঁপে, চক্ষু প্রদাহের জন্য কঁচা আম, যকৃতের জন্য পাকা আম, অজীর্নতা ও কার্ভি রোগের জন্য আমড়া; বলকারক টনিক তৈরিতে আমলকি, হরিকতি ও বয়রা; ডায়ারিয়ার জন্য ডাব ইত্যাদি কাজ করে । এছাড়া অনেক ফল গাছের পাতা, ছাল, শিকড় ইত্যাদি অনেক রোগ উপশমে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।
(জ) পরিবেশের উন্নয়ন: প্রচুর পরিমাণে ফল গাছ লাগানো হলে পরিবেশের উন্নয়নে যথেষ্ট সহায়ক হবে । যেমন পরিবেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হবে, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়বে, ভূমিক্ষয় কমে যাবে, পাখির আবাসস্থল বৃদ্ধি পাবে ইত্যাদি। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের পাখি ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে ফসল ও পরিবেশের উপকার করে ।
(ঝ) সৌন্দর্যবর্ধক: কিছু কিছু ফল গাছ আছে যেগুলো দেখতে সুন্দর । আবার অনেক গাছের ফল নানা আকারের ও নানা রংয়ের হয়ে থাকে। যেমন- করমচা, জামরুল, ডালিম, আঙ্গুর, লিচু ইত্যাদি ।
ফল চাষ বৃদ্ধির কৌশল
ফলের চাষ বৃদ্ধি করতে হলে প্রধানত: তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে । যেমন-
ক) বর্তমানে যেসব গাছ রয়েছে সেগুলোর পরিচর্যার মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি করা ।
খ) নতুন করে ফলগাছ লাগানো এবং
গ) জাত উন্নয়ন করা।
ক) যে সব গাছ বর্তমানে ফল উৎপাদনশীল রয়েছে সেগুলোর পুষ্টির অভাব দূরীকরণ, পরগাছার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ, মৃত বা রোগাক্রান্ত ডালপালা ছাটাই করা, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ রোধ, সেচ, নিকাশ এবং সার প্রয়োগ ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় না। এসব কারণে অধিকাংশ গাছ উপযুক্ত পরিমাণে ফলন দিতে পারে না । নিয়মিত পরিচর্যার মাধ্যমে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উৎপাদন ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা অনেকাংশে সম্ভব ।
(খ) নতুন করে ফল গাছ রোপণের ব্যাপারে কয়েকটি নীতি অনুসরণ করা একান্ত প্রয়োজন । যেমন-
(১) যে সব এলাকায় অনাবাদি জমি রয়েছে সেখানে বাগান আকারে ফলের চাষ করতে হবে। ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় ফল চাষের উপযাগী প্রচুর জমি রয়েছে । এসব এলাকায় আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, আনারস, লিচু, লেবু, কলা জাতীয় ফল, কাজু বাদাম, আমড়া, আঙ্গুর ইত্যাদি ফল গাছের চাষ করা যেতে পারে। এসব এলাকার কৃষকদেরকে শর্ত সাপেক্ষে পাহাড়ি জমি বন্দোবস্ত দেয়া এবং ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলতে সহযোগিতা দেয়া যেতে পারে ।
(২) বসতবাড়ির আশেপাশে পারিবারিক চাহিদা মেটানোর জন্য ফল গাছ লাগানো হয়। এ ব্যাপারে উপযুক্ত ফল গাছ। নির্বাচন করা দরকার। বিভিন্ন ফল গাছ এমনভাবে লাগাতে হবে যাতে পরিবারের খাওয়ার জন্য সারা বছর ফল পাওয়া যায়। স্বল্পমেয়াদি ফল গাছ এজন্য সবচেয়ে উপযোগী। যেমন- কলা, পেঁপে, আঙ্গুর, তরমুজ। পারিবারিক বাগানের জন্য বাড়ির পাশে এ ধরনের ৫-৬ টি ফলের গাছ লাগানো যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি গাছ লাগানোর সুযোগ থাকলে বিভিন্ন ধরনের ফলের সমন্বয় করে যথা আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, কুল, সফেদা, ডালিম, জলপাই ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে। কেউ যদি একই জাতীয় ফল ২-৩ টি লাগাতে চায় তাহলে আমের যেমন আগাম হিসেবে গুটির আম, মধ্যম হিসেবে ফজলি এবং নাবি হিসেবে আশ্বিনা লাগাতে পারে । অনুরূপভাবে অন্যান্য ফলের বেলায়ও আগাম, মধ্যম ও নাবি জাত নির্বাচন করে লাগাতে পারে ।
(৩) মাঠ ফসল বা সবজির চেয়ে ফল চাষে বেশি সময় লাগে। বাগান আকারে দীর্ঘমেয়াদি ফলের চাষ করতে চাইলে সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। জমির সুষ্ঠু ব্যবহার ও বাড়তি আয়ের জন্য ফল গাছের মাঝে স্বল্প মেয়াদি ফসল উৎপাদন করা যেতে পারে ।
(৪) ফলের জাত ও ফসল নির্বাচন, লাগানো ফসলের পরিচর্যা, আন্তফসল উৎপাদন এবং বাগান ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এর ফলে তারা সঠিকভাবে ফুল চাষ করে লাভবান হতে পারে ।
(৫) বাংলাদেশের আবহাওয়াতে জন্মানো সম্ভব এমন সব ফলের চারা কৃষকের পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করা অসম্ভব নাও হতে পারে । এগুলোর চারা সরকারিভাবে উৎপাদন করে আগ্রহী কৃষকদের জন্য সহজলভা করা যেতে পারে।
(৬) ফল বাজারজাতকরণের জন্য বাজার সৃষ্টি এবং ফল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় খামার যন্ত্রপাতি কৃষকদের সহজলভ্য করার লক্ষে অঞ্চলভিত্তিক কৃষক সমবায় কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। এ সুযোগ সৃষ্টি করা হলে ফল বিক্রির জন্য কৃষকরা দালাল বা ফড়িয়াদের হয়রানির হাত থেকে অব্যহতি পাবে এবং সহজে যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে পারবে ।
(গ) উন্নত জাতের গাছ নির্বাচন করে নতুনভাবে লাগাতে হবে । গবেষণার মাধ্যমে নতুন জাত উদ্ভাবন ও শনাক্ত করতে হবে । সেগুলোর চারা ও কলম তৈরি করে দ্রবত কৃষকদের কাছে সহজলভ্য করতে হবে ।
ফল চাষ বৃদ্ধিতে করণীয়
বাংলাদেশে মাথাপিছু ফলের উৎপাদন অত্যন্ত কম। তাই মাথাপিছু ফলের উৎপাদন বাড়াতে, পুষ্টির যাগোন দিতে, পতিত জমির সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার । যা ফল চাষ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে । যেমন
১। জমির উচ্চতা নিরূপণ করে স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ফল চাষের জন্য এলাকা চিহ্নিতকরণ ।
২। অঞ্চলভেদে ফলের জাত নির্বাচন ও চাষের জন্য সুপারিশ করা ।
৩। ফলের উন্নত জাত উদ্ভাবন ।
৪ । সুস্থ চারা কলম উৎপাদন এবং সকল এলাকায় সহজে পাওয়ার ব্যবস্থাকরন
৫। ফলের গুরুত্ব এবং পুষ্টিমাণ সম্পর্কে জনগণকে অবহিতকরণ ।
৬। উন্নত প্রথায় ফল চাষের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাকরণ ।
৭ । ফল উৎপাদনের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য কৃষকদের বীমার ব্যবস্থাকরণ ।
৮। ফল সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের সুষ্ঠ ব্যবস্থাকরণ।
৯। ফলের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার ব্যবস্থাকরণ।
১০। সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থাকরণ।
১১ । ফল উৎপাদনের জন্য কারিগরি সহায়তা প্রদান ।
১২। যে সব গাছ ফল দেয় না সেগুলোর পরিচর্যা করা ।
১৩ । ভাল ফল উৎপাদনকারীকে উৎসাহ প্রদানের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থাকরণ ।
১ । জমির উচ্চতা নিরূপন করে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ফল চাষের জন্য এলাকা চিহ্নিতকরণ উঁচু জমি, বৃষ্টিপাত কম ও শুষ্ক আবহাওয়ায় লিচু ভালো জন্মে। পানির কাছে এবং লবণাক্ত পানি এলাকায় নারিকেল ভালো জন্মে । পানিতল কাছে অথচ জলাবদ্ধতা হয় না এবং বাতাসে আর্দ্রতা বেশি সেখানে পেয়ারা, দেওফল, ডুমুর ভালো জন্মে। জমি উঁচু মাটি লালচে এবং বৃষ্টিপাত বেশি অথচ পানি দাঁড়ায় না সেখানে সুপারি, আনারস, কাঁঠাল জাম ইত্যাদি ভাল জন্মে। তাই এভাবে বিভিন্ন ফল ভিত্তিক এলাকা গিতি করে ফল চাষের জন্য সুপারিশ করতে হবে ।
২। ফলের জাত বাছাই: যে সব জাতে ফল তাড়াতাড়ি ধরে এবং বেশি পরিমাণে হয় সেগুলো বাছাই করে চাষ করা উচিত। যেমন
ফলের | জাত উন্নত জাত |
আম | ফজলি, আম্রপালী, লক্ষৌ, ল্যাংড়া, হিমসাগর, মল্লিকা, গোপালভোগ, তাসমিরা |
পেয়ারা | কাজী, স্বরুপকাঠি, আঙ্গুর, পেয়ারা |
লিচু | চায়না-৩, বোম্বাই, মোজাফরপুরী, বেদানা |
কলা | মেহের সাগর, সবরী, করবী |
আনারস | ক্যালেন্ডার (জায়েন্ট কিউ), হানিকুইন, ঘোড়াশাল |
নারিকেল | টিপিকা সবুজ, টিপিকা বাদামি ও পেয়ার্ক (ভিয়েতনাম) |
৩। ফলের উন্নত জাত উদ্ভাবন: গবেষণার মাধ্যমে ছোট গাছে বেশি ফল ধরে, প্রতি বছর প্রচুর ফল দিতে পারে বা বছরে একের অধিক বা ফল দিতে পারে, ফলের পুষ্টিমাণ বেশি, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে ইত্যাদি গুণাগুণ সম্পন্ন জাত উদ্ভাবন করা ।
৪। সুস্থ চারা কলম উৎপাদন এবং সকল এলাকায় সহজে পাওয়ার ব্যবস্থাকরণ: সাধারণত কৃষকরা গুণগত চারা উৎপাদন করতে পারে না। তাই বিভিন্ন এলাকায় অভিজ্ঞ লাকে দ্বারা চারা কলম উৎপাদনের জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে । নার্সারি স্থাপনকারীদেরকে উৎসাহিত করার জন্য জমি বন্দোবস্ত ও ঋণ সুবিধা দেওয়া উচিত । এ সুবিধা সৃষ্টি করা হলে কৃষকরা নিজ এলাকায় সহজে উন্নতজাতের চারা/কলম পাবে এবং ফল চাষে আগ্রহী হবে । চারার । চেয়ে কলমের গাছে তাড়াতাড়ি ফল ধরে এবং ফল সংগ্রহ ও অন্যান্য পরিচর্যা করা সহজ হয়। এর ফলে কৃষকরা উৎসাহিত হবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করা সহজ হবে। বাংলাদেশের আবহাওয়াতে জন্মাতে পারে এমন বিদেশি অপ্রধান ফলের চারা কৃষকদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না । এসব ক্ষেত্রে সরকারি ভাবে চারা সংগ্রহ করে আগ্রহী কৃষকদের মাঝে বিতরণ করতে হবে ।
৫। ফলের গুরুত্ব এবং পুষ্টিমান সম্পর্কে জনগণকে অবহিতকরণ: বাংলাদেশে পুষ্টি সমস্যা খুব বেশি । এদেশে প্রািেটনের যথেষ্ট ঘাটতি আছে । প্রািেটনের অভাবে শতকরা ৫০ ভাগ শিশু স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে । পাঁচ বছরের বয়সের নিচের শিশুদের শতকরা ৭৫ ভাগই অপুষ্টির শিকার । শতকরা ৭৬ ভাগ পরিবার ক্যালরি এবং শতকরা ৯০ ভাগ পরিবার ভিটামিন “এ”- এর অভাবে ভুগছে । শতকরা ৭৫ ভাগ মহিলা ও শিশু রক্তশূন্যতায় ভুগছে এবং ১০ লক্ষ লাক গলাফোলা রোগে আক্রান্ত। ভিটামিন “সি” রাইবাফ্লোবিন এবং ফলিক এসিডের ঘাটতিও খুব বেশি । এদেশে অপুষ্টিজনিত মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি । ফল চাষ বৃদ্ধি করা হলে ও বেশি করে ফল খাওয়ার অভ্যাস করা হলে অপুষ্টিজনিত সমস্যা সহজে দুর করা সম্ভব ।
৬। উন্নত প্রথায় ফুল চাষের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাকরণ: সফলভাবে ফল চাষ করার জন্য উন্নত কলাকৌশল সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত । যাতে তারা নিজ এলাকায় তা বাস্তবায়ন করতে পারে।যেমন- উন্নত জাত নির্বাচন, চারা তৈরি, গর্ত খনন, চারা রোপণের পূর্বে এবং পরে সার প্রয়োগ সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি, বিভিন্ন ধরনের আন্ত পরিচর্যা, ফল পাড়া, বাছাই, সংরক্ষণ ইত্যাদি । সময়মত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং এলাকার উপযোগী কলাকৌশলের প্রশিক্ষণ দেয়া হলে কৃষকরা ফল চাষ বৃদ্ধিতে উৎসাহ পাবে। বেশি সময় ধরে ফল পাওয়ার জন্য আমের আগাম হিসেবে গুটি আম, মধ্যম হিসেবে ফজলি, নাবি হিসেবে আশ্বিনা আম । চাষ করা যেতে পারে। রসা বা গালা কাঁঠাল আগে পাকে, আধা রসা বা আধাগলা কাঁঠাল কিছুটা পরে পাকে এবং চাউলা কাঁঠাল দেরিতে পাকে। আগাম, মধ্যম ও নাবিতে পাকে এভাবে ফল নির্বাচন করে চাষ করা যেতে পারে। অনুরূপভাবে কুল, জাম, লেবু ইত্যাদিও চাষ করা যেতে পারে।
৭। ফল উৎপাদনের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য কৃষকদের ঝুঁকি বীমার ব্যবস্থাকরণ: কৃষকদেরকে ফল উৎপাদনকালে নানাবিধ ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়। যেমন ঝড়ঝঞ্জা, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ, বন্যা বা খরা, বাজারজাতকরণ সমস্যা ইত্যাদি । এ অবস্থায় কৃষকরা যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সে জন্য বীমার ব্যবস্থা করা হলে তারা বেশি করে ফল চাষে আগ্রহী হবে।
৮। ফল সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা: আমাদের দেশের অধিকাংশ ফলই মৌসুমী ফল । তাই নির্দিষ্ট মৌসুমে নির্দিষ্ট ফল একসাথে পাকে। যার ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিক্রয় করতে হয়।কোন কারণে বিলম্ব হলে প্রচুর ফল পচে নষ্ট হয়ে যায়। সরকারিভাবে বা প্রতিটি ফল উৎপাদন এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দ্বারা বা ফল চাষীদের দ্বারা ফল চাষী সমবায় করা যায়। এর মাধ্যমে মৌসুমে অতিরিক্ত ফল সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা হলে কৃষকরা ফল চাষে আগ্রহী হবে। অনুরূপভাবে ফল চাষীদের উৎপাদিত ফল বিক্রয়ের নিশ্চয়তা দেয়া হলেও তারা বেশী করে ফল চাষ করবে।
৯। কৃষকদের ফলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ: প্রায়শই দেখা যায় যে ফড়িয়া বা দালাল দ্বারা ফল উৎপাদনকারী কৃষকগণ প্রতারিত হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার ত্রুটি এবং এলাকাভিত্তিক ফলের ক্রয়কেন্দ্র না থাকায় কৃষকরা অনেক সময় ফল উৎপাদন করে বিপাকে পড়ে । যার ফলে কম দামে ফল বিক্রি করতে হয় । তাই ফল বিক্রয় ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হলে কৃষকরা তার পন্যের উপযুক্ত মূল্য পাবে এবং ফল চাষ বৃদ্ধিতে উৎসাহিত হবে ।
১০। কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থাকরণ: ফলচাষ করতে বেশি টাকার প্রয়োজন হয়। এছাড়াও ফলের বাগানে আন্ত পরিচর্যার র্যার জন্য দামি যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় । যা আমাদের দেশের গরীব কৃষকদের পক্ষে ক্রয় করা সম্ভব না । বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি ফলের বাগান হতে ১০ হতে ১২ বছর পর উৎপাদন পাওয়া যায়। আমাদের দেশের গরিব কৃষকদের পক্ষে ১০ হতে ১২ বছর জমি ফেলে রাখা অসম্ভব। তাই এসব ক্ষেত্রে উৎপাদন শুরু না হওয়া পর্যন্ত সুদবিহীন ঋণ দেয়া উচিত । এতে কৃষকরা বেশি করে ফল চাষে আগ্রহী হবে ।
১১। কৃষকদেরকে ফল উৎপাদনের জন্য কারিগরি সহায়তা প্রদান: মাঝে মাঝে ফল বাগানের মাটিতে সেচের পানিতে নানাবিধ সমস্যা হয় । এমনকি নানাবিধ রোগ, পোকামাকড়েরও প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করে উপযুক্ত পরামর্শ দেয়া প্রয়োজন ফলের গাছের পরিচর্যার জন্য ভাড়া ভিত্তিতে মেশিনারী সরবরাহের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে, যা ফল চাষীদের আগ্রহ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে । এমনকি এগুলো হাতে কলমে করে দেখানো হলে তা দেখে অন্যান্য কৃষকরা উৎসাহিত হবে ।
১২। যে সব প্রাপ্ত বয়স্ক গাছ বিভিন্ন কারণে ফল দেয় না সেগুলোর পরিচর্যা করা: গাছের পুষ্টির অভাব থাকলে সার প্রয়োগ করা দরকার। গাছে পরগাছা, অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ও রোগ পোকামাকড়ের আক্রমণ থাকলে তা কেটে হেঁটে পরিষ্কার করে দিতে হবে । প্রয়োজনীয় পরিচর্যার মাধ্যমে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব ।
১৩ । ভালো ফল উৎপদানকারীকে উৎসাহ প্রদানের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থাকরণ বিভিন্ন সময়ে ফল প্রদর্শনীর আয়াজেন করে বা কমিটির মাধ্যমে ভালো ফল চাষীদের নির্বাচন করে পুরস্কারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে । এতে চাষীরা উৎসাহ পাবে এবং ফল চাষে আগ্রহী হবে।
ফল চাষের সার্বিক অবস্থা
বাংলাদেশে বর্তমানে(২০০৬-০৭) ১৪৪.২৬ হাজার হেক্টর জমিতে ফলের চাষ করা হয়ে থাকে। হিসাব অনুযায়ী এ জমির পরিমাণ মোট চাষযোগ্য জমির মাত্র শতকরা ০.৭৫ ভাগ। বিগত দশ এগার বছরে ফলের জমি কমেছে ১১৪.৭৪ হাজার হেক্টর এবং উৎপাদন সে তুলনায় খুব সামান্যই বেড়েছে। নিচের সারনিতে (সারণি-৮) উলেখিত তথ্য মোতাবেক দেখা যাচ্ছে যে, এদেশে দ্রুত বর্ধনশীল ফলই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ উৎপন্ন হয়। দ্রুত বর্ধনশীল ফলের মধ্যে কলা, পেঁপে, আনারস ও তরমুজই প্রধান। ২০০৬-০৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এদেশের মোট উৎপাদিত ফলের প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ হচ্ছে দ্রুত বর্ধনশীল ফল । আবার দ্রুত বর্ধনশীল ফলের শতকরা ৭০ ভাগই হচ্ছে কলা ।
দেশে ৪১৩১.১৩ হাজার মেট্রিক টন ফল উৎপন্ন হচ্ছে । কিন্তু আমাদের মোট চাহিদা হচ্ছে ৬২৯৬.২৫ হাজার মেট্রিক টন । সে মোতাবেক ফলের উৎপাদন কমপক্ষে ২/৩ গুণ বৃদ্ধি করা প্রয়াজন ।
পেঁপে, লিচু, লেবু জাতীয় ফল, কুল, পেয়ারা, তাল ও অন্যান্য ফলের আওতায় জমির পরিমাণ খুবই কম । আবার লিচু, কুল, পেয়ারা, নারিকেল ও লেবু জাতীয় ফলের গড় ফলন অত্যন্ত কম । উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, এদেশে ফলের উৎপাদন বাড়ানোর এখনো যথেষ্ট সুযাগ আছে ।
বাংলাদেশের জলবায়ু ও মাটি ফল চাষের জন্য অনুকুল থাকায় ফলের উৎপাদন বাড়ানার বেশ সুযোগ রয়েছে । অনেক বিদেশি ফল যেমন রাম্বুটান, ম্যাঙ্গাস্টিন, আঙ্গর, স্টবেরি, এভাকেডো, কাজুবাদাম প্রভৃতি ফল এদেশে জন্মানো সম্ভব । উত্তরাঞ্চলে অনেক পতিত জমি, চট্টগ্রাম, ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশ কিছু পাহাড়িয়া অঞ্চল, বড় বাস্তার ধারে, পুকুর পাড়, বিভিন্ন অফিস সংলগ্ন মাঠ, আদালত প্রাঙ্গণ, রেললাইনের পাশ, বতসবাড়ির আশেপাশে এবং অনুরূপ আরও অনেক জমিতে অধিক সংখ্যায় ফল গাছ লাগিয়ে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ ও সম্ভাবনা এদেশে এখনও বিদ্যমান আছে ।
তাছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইতিপূর্বে রোপিত ফল গাছ সমূহের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে । বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফলের হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৬০-৭০ টন । সেখানে আমাদের দেশে তা মাত্র ৭ টনের মত । এ থেকে অনুমাণ করা যায় যে আমাদের দেশে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা কত বেশি ।
ফল চাষীদের সমস্যাও কিন্তু কম নয়। জমির স্বল্পতা ও নিম্ন উৎপাদনশীলতা, উৎপাদন উপকরণের দুষপ্রাপ্যতা ও দুমূল্য, লাগসই প্রযুক্তির অভাব, কৃষকের শিক্ষার ও প্রশিক্ষণের অভাব, দারিদ্র্য ও ঋণগ্রস্ততা, প্রাকৃতিক দুযোর্গ, আর্থিক ঝুঁকির আশংকা, ফল সংরক্ষনে অসুবিধা, পরিবহন সমস্যা, প্রক্রিয়াজাতকরন শিল্পের অভাব, বিপনন সমস্যা, শস্যবীমার অনুপস্থিতি ইত্যাদি নানাবিধ কারণ কৃষকের ফল চাষে আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে ।
ফল চাষীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানকল্পে সরকারি অঙ্গীকার ও সাহায্য সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং জনগণের সচেতনতা ও সদিচ্ছা ফলের উৎপাদন বাড়াতে পালন করতে পারে ।
সারণি-৩ হতে দেখা যায় স্বল্প মেয়াদি ফল সমূহ যেমন, কলা, পেঁপে, আনারস, তরমুজ ইত্যাদি ফলই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হয়। দীর্ঘমেয়াদি ফলের মধ্যে আম চাষে অন্তর্ভুক্ত জমির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি । তাছাড়া কাঁঠাল, সুপারি, নারিকেল ইত্যাদি ফলের আওতায়ও বেশ কিছু পরিমাণ জমি আছে । ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান উপলদ্ধি করার জন্য বিশ্বের অন্যান্য কয়েকটি দেশের তুলনামূলক গড় উৎপাদন সারনি-৮ তুলে ধরা হলো ।
সারণি-৬ বাংলাদেশ ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ফলের তুলনামূলক উৎপাদন(০০০টন)
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১ । আমাদের দেশে মাথাপিছু দৈনিক ফলের প্রাপ্যতা কত ?
২। দেশের মোট আবাদি জমির কতটুকু জমিতে ফল চাষ করা হয় ?
৩ । বাংলাদেশে প্রতিদিন কত জমি চাষের আওতা বহির্ভূত হয়ে যাচ্ছে ?
সংক্ষিত প্ৰশ্ন
১ । বাংলাদেশে ফল চাষের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা কর ।
২। বাংলাদেশে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ?
৩ । বাংলাদেশে ফল চাষ বৃদ্ধির কৌশল ব্যাখ্যা কর ।
৪ । বাংলাদেশে ফল চাষের মাধ্যমে কৃষকের আয় কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় আলোচনা কর ।
৫ । বাংলাদেশে ফলের আওতায় মোট জমির পরিমাণ ও মোট ফল উৎপাদন লিপিবদ্ধ কর।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। বাংলাদেশে ফল চাষের আওতায় জমির পরিমাণ অতীত ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর ।
২। বাংলাদেশে বিভিন্ন ফলের উৎপাদন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা কর ।
৩ । বাংলাদেশে বিভিন্ন ফলের জমির পরিমাণ ও উৎপাদন সম্বন্ধে বর্ণনা কর ।
৪ । বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগে ফল চাষের আওতায় জমির পরিমাণ ও উৎপাদন সম্পর্কে বিবরণ দাও ।
৫ । বাংলাদেশে ফল চাষের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি সম্পর্কে আলোচনা কর ।
৬ । বাংলাদেশে ফল চাষের সর্বাধিক অবস্থা ব্যাখ্যা কর ।
ফলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু খাদ্য হিসেবে নয়। মানব দেহের পুষ্টি সাধনে, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে, সামাজিক কর্মকাণ্ডে, চিকিৎসা শাস্ত্রে ইত্যাদিতে ফল বিভিন্নভাবে অবদান রাখছে । ফল চাষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নানান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটিতে বর্তমানে প্রায় ৭০ ধরনের ফল উৎপাদন হয়ে থাকে । একটু যত্ন নিলে ও কিছু কিছু বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এগুলোর ফলন বাড়ানো সম্ভব । এছাড়া গবেষণার মাধ্যমে জাত নির্বাচন করে আরও কিছু নতুন নতুন ফল প্রবর্তন বা চালু করা যেতে পারে। যেমন- ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান চেরী, গেছো টমেটো, স্টার আপেল, নাশপাতি, পার্সিমন ইত্যাদি ।
মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে বর্তমানে টাটকা ও প্রক্রিয়াজাত করা ফলের ভালো বাজার আছে। সুপরিকল্পিতভাবে এলাকা নির্ধারণ করে উৎপাদন কর্মসূচি গ্রহণ, আমদানি কারক দেশের সাথে অগ্রিম চুক্তি, সংরক্ষণ, উন্নত ও দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থার পদক্ষেপ নেওয়া হলে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অনায়াসে অর্জন করা সম্ভব । প্রতিবছর বিদেশ থেকে আপেল, আঙ্গুর, খেজুর, কমলালেবু ইত্যাদি ফল প্রচুর পরিমাণে আমদানি করা হয় । দেশে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হলে আমদানির পরিমাণ কমে যাবে এবং এতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে যাবে ।
জাতীয় অর্থনীতিতে ফলের অবদান
জাতীয় অর্থনীতিতে দানাজাতীয় শস্য তথা খাদ্য শস্যের অবদানের চেয়ে ফলজাতীয় শস্যের অবদান তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। ২০০৬-২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ফলের আওতায় রয়েছে মোট চাষভুক্ত জমির শতকরা ০.৭৫ ভাগ। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিতে মোট ফসলভিত্তিক আয়ের আনুমানিক প্রায় শতকরা ১০ ভাগ আসে ফল হতে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও অন্যান্য ফসলের তুলনায় ফলজাতীয় ফসলের আয় তুলনামূলকভাবে বেশি। ফলের বাজারমূল্য সব সময় বেশি থাকে বিধায়, ফলের গড় আয় অন্যান্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশি । আমাদের জিডিপিতে কৃষি সেক্টরের অবদান যেখানে শতকরা ৩৩ ভাগ সেখানে ফল ও ফলজাত দ্রব্যের অবদান প্রায় শতকরা ২.৩ ভাগ । পৃথিবীর অনেক দেশেই উপযুক্ত জলবায়ুর অভাবে ফল চাষ সম্ভব হয় না। সে সব দেশে ফল রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব । তাছাড়া বাংলাদেশে চাষাবাদ সম্ভব এমন ফল যেমন আঙ্গর, অ্যাভাক্যোডো, রামবুটান, কাজুবাদাম ইত্যাদি চাষ করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানো সম্ভব ।
কোন কোন ফল চাষে লাভ বেশি
বাংলাদেশে অনেক রকমের ফলের চাষ করা হয়। তবে যে সব ফল ব্যাপকভাবে বা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চাষ করা হয় সেগুলো হলো আম, লিচু, কাঁঠাল, কলা, আনারস, পেঁপে, পেয়ারা, নারিকেল, কুল, লেবুজাতীয় ফল, আমড়া ইত্যাদি । এদের মধ্যে কলা, পেঁপে, আনারস ইত্যাদি স্বল্প মেয়াদী অবৃক্ষজাতীয় ফল । কারণ খুব অল্প সময়েই অর্থাৎ গাছ লাগানার এক বা দুই বছরের মধ্যেই এগুলো ফল দিয়ে থাকে এবং এগুলো খুব দীর্ঘস্থায়ী বা দীর্ঘজীবী নয় । এদেশে মোট উৎপাদিত ফলের অর্ধেকের বেশি ফল স্বল্পমেয়াদি অবৃক্ষজাতীয় গাছ হতে উৎপন্ন হয় ।
আম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারিকেল, কুল, লেবু, আমড়া, জাম, সফেদা ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি বৃক্ষজাতীয় ফল । এসব গাছ থেকে ফল পেতে ৪-৭ বছর সময় লেগে যায় ।
কলা, পেঁপে, আনারস উচ্চফলনশীল ফল হিসেবে সুপরিচিত । অন্যান্য অনেক ফল মাঠ ফসলের চেয়ে স্বল্প সময়ে, স্বল্প পরিসরে প্রতি হেক্টরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনেক বেশি পরিমাণ ফলন ও পুষ্টি উপাদান পাওয়া সম্ভব । এদের হেক্টর প্রতি ফলন ও বিক্রি মূল্য এবং নীট আয়ও অন্যান্য বৃক্ষজাতীয় ফলের তুলনায় বেশি ।
কলা, পেঁপে, আনারস
কলা, পেঁপে ও আনারস দ্রুতবর্ধনশীল ফল । কলা ও পেঁপে উৎপাদনে প্রায় এক বৎসর এবং আনারসের বেলায় প্রায় দুই বৎসর সময় লাগে । এখানে যে হিসাবটি উপস্থাপন করা হল, তাতে স্পষ্ট প্রতিয়মান হবে যে, এই সব ফলের উৎপাদন প্রকৃতই অন্যান্য বৃক্ষজাতীয় ফল ফসলের তুলনায় লাভজনক ।
সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)সারণি- ১ কলা, পেঁপে ও আনারসের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শত টাকা, হেক্টরপ্রতি)
কলা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক ব্যয়, শ্রম, সার ও খুটি বাবদ। পেঁপের প্রধান ব্যয় শ্রম ও সারজনিত । আনারসের ক্ষেত্রে শ্রম, বীজ, চারা জমিজনিত ব্যয় সর্বাধিক ।
আম ও অন্যান্য বৃক্ষজাতীয় ফল
বাংলাদেশের প্রধান বৃক্ষ জাতীয় ফল আম ও অন্যান্যের আয়-ব্যয়ের হিসাব করতে এক বা দুই বৎসরের পরিবর্তে অন্তত ৮-১০ বৎসরের হিসাব ধরা আবশ্যক । আম গাছে বিক্রয় উপযোগী ফল ধরতে রোপণের পঞ্চম বর্ষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অন্যান্য বহু ফলের বেলাও প্রথম কয়েক বৎসর যাবৎ কেবল বায়ের পালা । কিন্তু একবার ভালোভাবে ফল ধরা শুরু হলে ব্যয় অনুপাতে অনেক বেশী আয় হতে থাকে । এখানে তালিকায় আম উৎপাদনের একটি আনুপাতিক হিসাব দেয়া হলো। এটা হতে অন্যান্য বৃক্ষ জাতীয় ফলের আয়-ব্যয় হিসাব সম্বন্ধে বেশ কিছুটা ধারণা লাভ করা সম্ভব হবে ।
একদিকে ক্রম- বর্ধিষ্ণু ব্যয় ধরে অপরদিকে ক্রমবর্ধিত আয় ধরা হয়েছে । তাতে আমের বেলায় লাভ আসতে প্রায় নয় বৎসর লেগে যায় । এখানে প্রথমে গাছের পারস্পরিক দূরত্বের অর্ধেক তথা ২০ ফুট দূরত্বে ১২৫ টি গাছের সংকুলান দেখানো যাচ্ছে । পনেরো বিশ বছর পরে যখন গাছসমূহ একে অন্যের গায়ে চড়াও হয়ে যাবে, তখন একান্তর গাছসমূহ কেটে ফেলতে হবে । দশম বৎসরে মাত্র পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা ব্যয় করে প্রায় একলাখ দশ হাজার টাকা মুনাফা হবে । এরপর বৎসরের পর বৎসর ধরে এ আয় চলতে থাকবে । কেবল তাই নয়, এমন কি এ আয় বাড়বে, এরূপ আশা করা যেতে পারে । আমের এই উদাহরণটি মোটামুটি ভাবে লিচু, কাঁঠাল, লেবু, সফেদা, পেয়ারা ইত্যাদির বেলায়ও অনেকটা প্রযোজ্য ।
সারণি- ২ আম উৎপাদনের প্রথম ১০ বৎসরের আয় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব (শতটাকা, হেক্টর)
বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষের কৌশল
বাংলাদেশের জলবায়ু, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত গ্রীষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে উৎপাদিত ফল জন্মানোর উপযোগী । বর্তমানে অধিকাংশ ফলই সমভূমি এলাকায় জন্মে । বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকায় সমতল ভূমি আছে। যেখানে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ করা অত্যন্ত সহজ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর ও বৃহত্তর দিনাজপুর এলাকায় উঁচু টিলা ও পাহাড়ি জমিতেও বানিজ্যিক ভাবে বিভিন্ন প্রকার ফল চাষ করা যেতে পারে। এমনকি এ সমস্ত এলাকাতে আনারস, নারিকেল, পেয়ারা, , আক্তার, কাঁঠাল, লিচু, কামরাংগা ইত্যাদি ফল চাষের জোন হিসেবে গড়ে তালো সম্ভব । বর্তমানে দেখা যায় যে, এ সমস্ত এলাকার পাহাড়ি ও টিলা ভূমিগুলো প্রায়ই অনাবাদি ও পতিত থাকে ।
রাজশাহীর বিস্তীর্ণ পদ্মার চরাঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উন্নত জাতের কুল, স্ট্রবেরী ও আমের চাষ সম্প্রসারণ করা যায়। দক্ষিণ অঞ্চলের ভালো, পটুয়াখালী ও বরগুনার চরাঞ্চলে উন্নত জাতের তরমুজ ও কলার বাণিজ্যিকভাবে বাগান তৈরি করে ফল চাষ সম্প্রসারণ করা যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে মাথা পিছু জমির পরিমাণ দিন দিন যার ফলে সব ধরনের আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। তাই শুধু ফল চাষের জন্য মাঠ আকারে বড় বড় বাগান তৈরি করে জমির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয় । তবে অন্য ভাবে ফলের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। যেমন-অফিস-আদালত, রাস্তার পাশে, রেল লাইনের পাশে, জমির আইলে, বাড়ির আনাচে কানাচে পরিকল্পিতভাবে উন্নত জাতের ফল গাছ লাগিয়ে ফলের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব ।
এদেশে কিছু কিছু ফল আছে যা স্বল্প সময়ে এবং স্বল্প পরিসরে জন্মানো যায়। যেমন পেঁপে, তরমুজ, ফুটি বা বাংগি, কলা, আনারস ইত্যাদি । বীজ হতে চারা বা গাছ উৎপাদন করে ফল ধরার উপযোগী হতে অনেক সময় লাগে । তাই অনেক ফল আছে যেগুলো কলমের মাধ্যমে তৈরি করে স্বাভাবিক সময়ের চাইতে কম সময়ে ফল উৎপাদন করা সম্ভব । যেমন- কুল, লেবু, পেয়ারা, লিচু, আম, জামরুল ইত্যাদি ।
কোন কোন ফল রোপণের সময় হতে উৎপাদনে আসতে সময় বেশি লাগে। তবে এ সময়কালের মধ্যে জমির সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা যায় । যেমন- দীর্ঘমেয়াদি ফলের সাথে স্বল্পমেয়াদি ফল চাষ করা । এভাবে ফল চাষে মূলধন বেশি লাগে । কিনতু ফলের হেক্টর প্রতি ফলন ও বিক্রয় মূল্য বেশি পাওয়া যায় । ফল সহজে বাজার জাত করা যায় এবং সহজে খাওয়া যায় বলে এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি । আবার অনেক ফলের ভেষজ (ঔষধ) ব্যবহার আছে যেমন লেবু, আমলকি, হরিতকি, ডাব, পেঁপে, আনারস ইত্যাদি ।
এদেশে আগে লাকেজন সখের বসে যেমন ফল গাছের চারা রোপণ করেছেন তেমনি অনেকে গড়ে তুলেছেন বাণিজ্যিক ফল বাগান । এই সকল বাগানে দীর্ঘ মেয়াদি ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে বাগানের মধ্যে স্বল্প মেয়াদি ফল, শাকসবজি ও মসলাজাতীয় ফসল চাষ করা হয়। এর মাধ্যমে অনেকেই ফল চাষকে বাণিজ্যিক উৎপাদন কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় থেকে দিঘিনালা পর্যন্ত অসংখ্য এক একর বা দুই একর বাগান যেমন হয়েছে, তেমনি সেখানে ২৫ একরের বেশি জায়গা নিয়েও বাণিজ্যিকভাবে ফলের বাগান গড়ে উঠেছে। অসংখ্য ফল বাগান আছে যা বানিজ্যিক ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এসব বাগানে লাগানো হয়েছে আম্রপালি জাতের আম, লিচু, জলপাই ইত্যাদি । অনেকে এর সাথে লেবুও লাগিয়েছেন। বছরে এসব বাগান থেকে ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকার আম বিক্রি হচ্ছে আবার অনেকে বাগানের মধ্যে হলুদের চাষ করেছেন। এসবের ফলে উক্ত এলাকার প্রান্তিক জনগাষ্ঠির জীবন । যাত্রার মানও উন্নত হয়েছে।
রাজশাহী বিভাগে প্রায় সবগুলো জেলায় ফলের বাগান গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ এলাকায় সাম্প্রসারিত হয়েছে কুলের বাগান । বাউ কুল, থাইকুল, আপেলকুল, তাইওয়ানসহ অসংখ্য ধরনের কুল চাষ হচ্ছে এ এলাকায় । উক্ত বিভাগে কেবল ২০০৮-২০০৯ সালেই ১২ থেকে ১৫ লাখ কুলের চারা লাগানো হয়েছে ।
চাপাইনবাবগঞ্জে আম বাগানের মধ্যে কুল বাগান করা হয়েছে । যেহেতু আম বাগানের মধ্যে অনেক জায়গা খালি থাকে সেখানে কুল চাষ করা সম্ভব । আবার কুল বাগানের মাঝে নানা রকম শাক-সবজি ও মসলার চাষ করা হয়েছে। এতে যেখানে কেবল আম ছাড়া কিছু হতোনা, সে জমিতে এখন একই সাথে আম, কুল এবং শাক-সবজি ও মসলার চাষ হচ্ছে। জমির এই বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করে প্রগতিশীল কৃষকরা ও বাগান মালিকরা লাভবান হচ্ছে ।
অন্যান্য শস্যের সাথে ফল চাষের লাভজনক অবস্থা
বাংলাদেশে কৃষি কার্যক্রম প্রধানত ধানভিত্তিক। ফল চাষের জন্য আমাদের জমির পরিমাণ অত্যন্ত কম । দানাজাতীয় ফসল যেমন- ধান, গম, সরিষা, ভুট্টা ইত্যাদির গড় ফলন হেক্টরে ৪ থেকে ৬ টন। অথচ অধিকাংশ ফল যেমন--কলা, পেঁপে, আনারস, তরমুজের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ১৫ থেকে ৫০ বা ১০০ টন পর্যন্ত হতে পারে । ধান, গম, সরিষা, ভুট্টা অপেক্ষা ফলের মূল্য বেশি। বাজারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকে বিধায় সব সময়ই ফলের দাম বেশি থাকে। তাই ফল চাষ করে কৃষকরা অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশি লাভবান হতে পারে । অনেক ফল আছে যেমন নারিকেল, সুপারি, পেঁপে, পেয়ারা ইত্যাদি বহুদিন ধরে আয় দিতে পারে । পরিকল্পিত ভাবে ফল চাষ করে ফলচাষী প্রতি মাসেই নগদ টাকা ঘরে আনতে পারেন এবং এ আয়ের পরিমাণ যেমন উল্লেখযোগ্য তেমনি তা কৃষকের দৈনন্দিন জীবন যাপনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে । বাড়ির আশে পাশে পতিত জায়গা বা প্রান্তিক জমিতে যেখানে মাঠ ফসল চাষ করা সম্ভব নয়; সেখানে পরিকল্পিতভাবে ফল চাষ করে অনেক টাকা আয় করা সম্ভব । রেল লাইন ও সড়কের ধারে, পুকুর, ডাবো ও খালের পাড়ে, ধর্মীয় উপাসনালয়ের আশে পাশে, অফিস আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশে পাশে, পাহাড়ের ঢালে, বিভিন্ন ধরনের বাধে, জমির আইলে অর্থাৎ বিভিন্ন পতিত স্থানে নারিকেল, সুপারি, খেজুর, তাল ইত্যাদি ফুল গাছ লাগিয়ে প্রচুর অর্থ আয় করা যায় । দানাজাতীয় ফসল যেমন- ধান, গম ইত্যাদি চাষ করে হেক্টর প্রতি ২৫০০/- থেকে ৩০,০০০/- আয় করা যায় । অন্যদিকে ফল চাষ করে হেক্টর প্রতি ২-২.৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায় । এছাড়াও যফল বাগানের মধ্যে অন্যান্য ফসল যেমন আদা, হলুদ, মিষ্টি আলুর লতা ইত্যাদি চাষ করে আয়ের পরিমাণ আরো বাড়ানো সম্ভব । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শস্য জাতীয় ফসল আবাদের চেয়ে ফল চাষ বেশি লাভজনক । যেমন- এক হেক্টর জমিতে কলা চাষ করে বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব । উন্নত জাতের কুলের একটি মাত্র গাছ হতে (৬ মিটার ঢ ৬ মিটার জমিতে বছরে ১০০০ টাকা পর্যন্ত কুল বিক্রি করা যায়। এক হেক্টর জমিতে পেঁপে চাষ করে বছরে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা উপার্জন করা সম্ভব । অনুরূপভাবে তরমুজ, পেয়ারা ইত্যাদি ফল চাষ করে অধিক আয় করা যেতে পারে। অথচ দানাজাতীয় শস্য চাষ করে এত বেশি লাভ করা সম্ভব নয় । (সারণি-৩)
বাংলাদেশের মত ঘন বসতিপূর্ণ দেশে গড় খামারের আকার অত্যন্ত ছোট । তাই একমাত্র ফুল চাষের মাধ্যমে অল্প জমি হতে অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব । দানা শস্য বা অন্যান্য অনেক ফসল অপেক্ষা ফলের হেক্টর প্রতি ফলন বেশি এবং বাজার মূল্যও অনেক বেশি। সারণি: ৪ হতে দেখা যাচ্ছে যে, হেক্টর প্রতি দানা শস্য অপেক্ষা ফলের উৎপাদন অনেক বেশি ।
ফলের মধ্যে দ্রুত বর্ধনশীল ফল হলো কলা, পেঁপে, তরমুজ ও ফুটি। এদের ফলন তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ফল অপেক্ষা আরো অনেক বেশি । দ্রুতবর্ধনশীল ফলের মধ্যে ৭০ ভাগই হচ্ছে কলা। ২০০৬-০৭ সালে মোট আবাদি জমি ১৯২৬৬ হে: এর মধ্যে প্রধান প্রধান ফল চাষের জমির পরিমাণ হচ্ছে ১৪৪২৬ হেক্টর এবং দানা শস্যের জমির পরিমাণ হচ্ছে ১১৪০৩.৫০ হেক্টর (সারণি-৫) এই তথ্য গুলো থেকে অনুমান করা যায় যে বাংলাদেশে ফল চাষের জমির পরিমাণ কম অথচ দানা শস্যের চাইতে হেক্টর প্রতি ফলন অনেক বেশি ।
তথ্য সারণি- ১ হতে দেখা যায় যে, মোট জমির মাত্র ০.৭৫ ভাগ জমিতে ফল চাষ হচ্ছে । এ থেকে আমরা দৈনিক মাথা পিছু ফল পাই মাত্র গড়ে ৩০-৬০ গ্রাম । যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম । কেননা খাদ্য বিজ্ঞানীদের মতে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের দৈনিক গড়ে অন্তত ১১৫ থেকে ১২০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত । যদিও উন্নত বিশ্বের লাকেজন গড়ে ২০০ গ্রামের ও বেশি ফল খায় । ফলের আওতায় জমি বৃদ্ধি এবং উন্নত জাতের আবাদ করে ইউনিট প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি করে ফলের চাহিদার এ ঘাটতি পূরণ করা যায় ।
সারণি- ৪ বাংলাদেশে বিভিন্ন ফলের তুলনামূলক ফলন
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটিতে বর্তমানে কত ধরনের ফল উৎপাদন হয় ?
২ । বাংলাদেশের জিডিপিতে ফল ও ফলজাত দ্রব্যের অবদান কত ?
৩ । দ্রুত বর্ধনশীল ফলের মধ্যে কলার অবদান কত ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১ । কোন কোন ফল চাষে কৃষক সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে তার একটি তালিকা তৈরি কর ।
২ । বাণিজ্যিক ভাবে ফল চাষের কৌশল বলতে কী বোঝায় ?
৩ । বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ফলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব কেমন বর্ণনা কর ।
৪ । অর্থনৈতিক বিবেচনায় কোন কোন ফল বাংলাদেশে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ?
রচনামূলক প্রশ্ন
১ । বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষিতে কোন কোন ফল চাষ সবচেয়ে লাভজনক তার বিবরণ দাও ।
২ । বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ বৃদ্ধির কৌশল ব্যাখ্যা কর ।
৩ । বাংলাদেশে উৎপাদিত অন্যান্য ফসলের সাথে ফল চাষের লাভজনক অবস্থা ছকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা কর ।
আমরা জীবনধারণের জন্য যা খাই তাই খাদ্য। যে সব দ্রব্য ভক্ষণ করলে শরীরের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধি সাধন, তাপ উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় তাকেই খাদ্য বলে । খাদ্য গ্রহনের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো শরীরকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখা। শরীরের সুস্থতা নির্ভর করে দেহের পুষ্টি সাধন প্রক্রিয়ার উপর। মানুষের খাদ্য তালিকায় ফল একটি উল্লেখ যোগ্য স্থান দখল করে আছে। ফলে আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় প্রায় সকল পুষ্টি উপাদানই পাওয়া যায় । বিশেষত বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের সবচেয়ে সহজ ও সস্তা উৎস হলো ফল। ফল রান্না ছাড়া পাকা বা কাঁচা অবস্থায় সরাসরি খাওয়া যায়। ফলের পুষ্টি উপাদান সহজে শরীর গ্রহণ করতে পারে।
ফলের বিদ্যমান বিভিন্ন প্রকার খনিজ উপাদান যেমন-ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস ইত্যাদি শরীরে বিপাকে সহায়তা করে । এছাড়াও ফল শরীরের অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন- আমিষ, শর্করা, চর্বি, ভিটামিন, পানি ইত্যাদি সরবরাহ করে শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখে। ফল খাদ্য হিসাবে পুষ্টির অন্যতম বাহক ।
বিভিন্ন ফলের পুষ্টিমান
নিচের সারণিতে আমাদের দেশে প্রচলিত ও অপ্রচলিত বিভিন্ন ফলে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ উল্লেখ করা হলো।
সারণি: বিভিন্ন ফলের ভিটামিন ও খনিজ মানের পরিমাণ (প্রতি ১০০ গ্রাম )
শর্করা: দেহের শক্তির প্রধান উৎস হলো শর্করা । পুষ্টি বিধানে জরুরি উপাদান শর্করা সরবরাহে ফল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে । ফল দানাজাতীয় শর্করার পরিপূরক উৎস হিসেবে গণ্য হতে পারে । জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) এর মতে শরীরের চাহিদার শতকরা পাঁচভাগ ক্যালরি সবজি ও ফল থেকে আসা উচিত । কিসমিস, খেজুর, করমচা, কলা, বেল ইত্যাদি শর্করা প্রধান ফল ।
চবি: চর্বি জাতীয় খাদ্য দেহে সঞ্চিত শক্তি হিসেবে কাজ করে। মোট চাহিদার অন্তত দশভাগ খাদ্য শক্তি স্নেহজাতীয় খাদ্য হতে আসা উচিত । অন্যথায় স্নেহ দ্রবণীয় ভিটামিনসমূহ যেমন-ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে এর শোষণ বাধাপ্রাপ্ত হয় । কাজুবাদাম, এভােেকডো, করমচা, বাদাম, নারিকেল, কাঁঠাল বীজ, কদবেল ইত্যাদি ফল চর্বি সমৃদ্ধ ।
ভিটামিন: শারিরিক পুষ্টির জন্য ভিটামিনের অবদান অনস্বীকার্য। আর এ ভিটামিনের প্রধান উৎসই হলো শাকসবজি ও ফলমূল । মানবদেহের চাহিদার শতকরা প্রায় ৯০-৯৫ ভাগ ভিটামিন 'সি', ৬০-৮০ ভাগ ভিটামিন 'এ' এবং ২০-৩০ ভাগ ভিটামিন 'বি' সবজি ও ফল হতে আসে । বিভিন্ন ভিটামিন সরবরাহে ফলের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো
ভিটামিন 'এ': শরীরের পুষ্টি সাধনে এবং দৃষ্টিশক্তি অক্ষুন্ন রাখতে ভিটামি এর প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক । এর অভাবে রাতকানা রোগ হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় । হলুদ শাঁসবিশিষ্ট ফল যেমন: আম, পেঁপে, আমড়া, কাঁঠাল, ফুটি, বিলিম্বি, আলুচা, কমলা, বাতাবিলেবু, বেল, কাজুবাদাম, ডুমুর প্রভৃতি ফলে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন 'এ' বিদ্যমান রয়েছে ।
ভিটামিন বি ১ (Thiamine): শ্বেতসার বিপাক প্রক্রিয়া এবং স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কাজ নিয়ন্ত্রণে ভিটামিন বি ১ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে । এর অভাবে ক্ষুধা কমে যায়, বেরিবেরি রোগ দেখা দেয়, চর্মের অনুভব ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং পক্ষাঘাত দেখা দিতে পারে। কাজুবাদাম, আখরোট, বাদাম, খোবানী, কলা, লিচু, কমলা, আঙ্গুর, কিসমিস ইত্যাদি ফলে অধিক পরিমাণে ভিটামিন বি ১ রয়েছে ।
ভিটামিন বি ২ (Riboflavin): ভিটামিন বি ২ চর্মের মসৃণতা ও ক্ষুধা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে । এর অভাবে ক্ষুধা হ্রাস, গলায় ঘা, দেহের ওজন হ্রাস, নাক ফুলা ইত্যাদি শারিরীক জটিলতা দেখা দিতে পারে । বেল, কাজুবাদাম, পেঁপে, লিচু, আনারস, বেদানা, কদবেল প্রভৃতি ভিটামিন বি ২ এর ভাল উৎস।
ভিটামিন বি ৩ বা নায়াসিন (Niacine): এ ভিটামিন হজম শক্তি এবং চামড়ার মসৃণতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে ।
'ভিটাবিন সিঃ ভিটামিন 'সি' শরীরের বৃদ্ধি সাধন, রোগ প্রতিরোদ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং লৌহ ও ক্যালসিয়াম বিপাকে সাহায্য করে । এর অভাবে স্কার্ভি রোগ, দাঁতের মাড়ি ফুল ও দাঁত ক্ষয়, শরীরের জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা, হাত পা ফুলা, বাতব্যাধির লক্ষণ ইত্যাদি দেখা যায় । আমলকি, পেয়ারা, কমলা, লিচু, আনারস, স্ট্রবেরী, পেঁপে, সুপারি ইত্যাদি ফলে প্রচুর ভিটামিন সি বিদ্যমান।
খনিজ পদার্থ ও শরীরের সুষ্ঠু গড়নের জন্য খনিজ পদার্থ অপরিহার্য । বিভিন্ন ধরনের প্রধান খনিজ পদার্থগুলো হচ্ছে ক্যালসিয়াম, লৌহ, পটাসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, ফসরাস, সালফার, আয়োডিন ইত্যাদি । এদের মধ্যে কোন কোন গুলো শরীরে হাড়, রক্ত বা হরমোন তৈরির কাজে, খনিজ পদার্থ দেহের অম্ল- ক্ষারত্ব এবং বিভিন্ন অঙ্গে জলীয় অংশের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন এনজাইমের সুষ্ঠ কার্যাবলি সম্পাদনেও খনিজ পদার্থ সাহায্য করে । ক্যালসিয়ামের দিক হতে বাদাম, লিচু, করমচা, কদবেল, আখরোট, কিসমিস, আমলকি, বেল, কাজুবাদাম, খেজুর, ডুমুর, লেবু, কাগজীলেবু, কমলা প্রভৃতি ফসফরাসের দিক হতে বাদাম, কাজুবাদাম, কদবেল, এভোকেডো, কলা, বেল, সুপারি, খেজুর, ডুরিয়ান, করমচা, বেদানা, কিসমিস ইত্যাদি এবং লৌহের দিক হতে করমচা, খেজুর, কাজুবাদাম, আখরোট, কিসমিস, কাঁচা আম, বাদাম, স্ট্রবেরী, সুপারি, আপেল, আমলকি, ডুমুর, লিচু, পেয়ারা, শরীফা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
পানি সরবরাহে ফলের অবদান
শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পানি । পানি রক্তকে তরল রাখে, ভুক্ত খাদ্য দ্রব্য পরিপাকে সাহায্য করে এবং শরীরের দুষিত পদার্থ বের করে দিতে সহায়তা করে । বিভিন্ন ফল শরীরে পানির চাহিদা পূরণে সহায়তা করে । কচি নারিকেল (ডাব), আম, আনারস, পেঁপে, কমলা, কাঁঠাল, লিচু, লেবুজাতীয় ফল, পেয়ারা, তরমুজ, জামরুল ইত্যাদি ফলে প্রচুর পরিমানে পানি থাকে ।
অন্যান্য উপাদান
উপরোক্ত উপাদানসমূহ ছাড়াও এমন কিছু জৈব এসিড ও এনজাইম আছে যা আমাদের হজমে সহায়তা করে । যেমন: লেবু জাতীয় ফলে সাইট্রিক অ্যাসিড, আঙ্গুর ও তেওঁলে টারটারিক এসিড রয়েছে। এই সব জৈব অ্যাসিড ক্ষুধার উদ্দীপক ও হজমে সহায়তা করে । পেঁপে তে পেপাইন নামক হজমকারী এনজাইম রয়েছে । ফলে প্রচুর আঁশ থাকে যা পাকস্থলী ও অন্ত্রকে সর্বদা উত্তেজিত ও কর্মক্ষম রাখে এবং পাচনতনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে । ফলের আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। খাদ্য গ্রহণের মুখ্য উদ্দেশ্য কী ?
২। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের দৈনিক কত গ্রাম ফল খাওয়া উচিত ?
৩ । ফল খাদ্য হিসাবে পুষ্টির অন্যতম বাহক এ কথার অর্থ কী ?
৪। ফলের পুষ্টিগত গুরুত্ব বলতে কি বোঝায় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ফলের পুষ্টিগত গুরুত্ব বলতে কী বোঝায় ?
২। ভিটামিন 'এ' সমৃদ্ধ পাঁচটি ফলের বাংল ইংরেজি ও উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নাম লেখ ।
৩। আয়রন সমৃদ্ধ পাঁচটি ফলের বাংলা ইংরেজি ও উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নাম লেখ ।
৪ । ভিটামিন 'সি' সমৃদ্ধ পাঁচটি ফলের বাংলা, ইংরেজী ও উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নাম লেখ ।
৫। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পাঁচটি ফলের বাংলা ইংরেজি ও উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নাম লেখ ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। মানব দেহে পুষ্টি সরবরাহে ফল কীভাবে অবদান রাখে লেখ ।
২। বাংলাদেশে পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফল গুলোর গুরুত্ব বর্ণনা কর ।
৩। বিভিন্ন ফলে বিদ্যমান ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের পরিমাণ উল্লেখ করে তালিকা তৈরি কর।
বাংলাদেশে ফল উৎপাদনের চলমান সমস্যা বহুবিধ। অন্যান্য ফসল উৎপাদনের সমস্যার চেয়ে বাংলাদেশে ফল উৎপাদনের সমস্যা জটিল ও বহুবিধ। তবে অধিকাংশ সমস্যাই কৃষি বিষয়ক অন্যান্য সমস্যার সাথে ওতপ্রাতেভাবে জড়িত । আদিকাল হতে এ সমস্যা পুরুষানুক্রমে চলে আসছে । বিজ্ঞানের চরম উন্নতি ঘটলেও বাংলাদেশে এসব সমস্যা সমাধানের যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়নি । এসব কারনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ফলের জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ যে হারে বাড়ানো উচিত ছিল আজ পর্যন্ত সে হারে বাড়েনি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির অব্যাহত চাপের মুখে তাই বাড়তি জনগণের চাহিদা পূরণ ও অপুষ্টিজনিত সমস্যা দূরীকরণে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও চাষের কৌশল বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে। চিহ্নিত সমস্যাগুলোর সাথে যুক্ত হচ্ছে আরো নতুন নতুন সমস্যা । তবে সমস্যাগুলোকে সম্মিলিত ভাবে সমাধান করে এদেশের ফলের উৎপাদন বহুগুণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
ফল চাষের সমস্যাসমূহ
ফল চাষের সমস্যাগুলোকে সম্মিলিত ভাবে বিবেচনায় রেখে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় । যথা-
১। আর্থ সামাজিক সমস্যা
২। আর্থিক ও কারিগরি সমস্যা
৩। আইনগত সমস্যা
উপরোক্ত সমস্যাগুলোকে আবার কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১। আর্থ-সামাজিক সমস্যা: দেশের প্রচলিত চাষাবাদ ব্যবস্থা বিবেচনায় আর্থ-সামাজিক সমস্যাকে নিয়ে বর্ণিত শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে, যেমন-
ক) জমির স্বল্পতা
খ) কৃষকের দারিদ্রতা বা অর্থের অভাব
গ) আর্থিক ঝুঁকির আশঙ্কা
ঘ) পরিবহন সমস্যা
ঙ) বিপণন বা বাজারজাতকরণ সমস্যা
চ) উৎপাদন উপকরণের ও যন্ত্রপাতির মূল্য বেশি
ছ) গতানুগতিক প্রথায় চাষাবাদ ও প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা
২। আর্থিক ও কারিগরি সমস্যা: এলাকা ভেদে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা। প্রাকৃতিক অবস্থা, জমির প্রকৃতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি। বিষয় বিবেচনা করে এ সমস্যা টিকে নিম্নোক্ত ভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে । যেমন-
ক) নিম্ন উৎপাদনশীলতা
খ) জমির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা কম
গ) জমির উপযুক্ততা কম(স্থান, পরিবেশ)
ঘ) উৎপাদনের উপকরণের অভাব (ফল বাগানের জন্য যন্ত্রপাতি, চারা কলম উৎপাদনের দ্রব্যাদি, প্রয়োজনীয় জৈব ও রাসায়নিক সার এর দুষপ্রপ্যতা ইত্যাদি)
ঙ) ফল সংরক্ষণের সুযোগ সুবিধা ও কারিগরী জ্ঞানের অভাব
ছ) প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের অভাব
জ) ফলের গুণাগুণ বিচার করা হয় না
ঝ) প্রাকৃতিক দুযোর্গ (বন্যা, অতিবৃষ্টি, খরা, ঘূর্ণিঝড়, কুয়াশা ইত্যাদি)
ঞ) জলাবদ্ধতা ও জমিতে লবণাক্ততা
ট) ব্যাংক ঋণের অভাব/মূলধনের অভাব
৩। আইনগত: উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আইনগত দিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ । আইনগত দিক প্রণয়ন ও গ্রহনে নিম্ন বর্নিত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। যথা-
ক) কৃষি অঞ্চল চিহ্নিতকরণের ওপর ভিত্তি করে ফল চাষে বাধ্যকরণ
খ) ফল উৎপাদনে ও ফল পাকানোর কাজে নিষিদ্ধ ঔষধ ব্যবহার ও ঔষধের অপপ্রয়োগ রোধ করা
গ) রফতানি নীতি প্রনয়ন
ঘ) রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধর্মঘট পরিহার
ঙ) ফল উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মধ্যবর্তী কালে ফড়িয়া-দালালদের দৌরাত্ম্য রোধ
ফল চাষের প্রধান প্রধান সমস্যা
বাংলাদেশের ফল চাষের যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ফল চাষ করতে গিয়ে অনেক ধরনের বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় । সমস্যাগুলোর কিছু কিছু উতরানো সম্ভব হলেও এমন কিছু সমস্যা আছে যা খুবই জটিল এবং সমাধান সময় সাপেক্ষ। ফল চাষের প্রধান প্রধান সমস্যা নিম্নলিখিত ভাবে চিহ্নিত করা যায় । যেমন-
১। জমির স্বল্পতা ও নিম্ন উৎপাদনশীলতা ২। ব্যবহারিক জ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পের অভাব
৩। উৎপাদন উপকরণের দুষপ্রাপ্যতা ও দুমূল্য এবং কৃষকের দারিদ্রতা
৪ । প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আর্থিক ঝুঁকির সম্ভাবনা
৫। ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের অভাব
৬। ফল পরিবহন ও বিপণন সমস্যা
৭। বাজার ব্যবস্থার অপ্রতুলতা
১। জমির স্বল্পতা ও নিম্ন উৎপাদনশীলতা ।
ফল চাষের জন্য তুলনামূলক ভাবে উঁচু জমি দরকার । চাষাবাদ যোগ্য সব জমিতেই ফল চাষ করা যায় না । ফল চাষের জন্য এটি একটি মারাত্মক সমস্যা। কলা, পেঁপে, আনারস, কাঁঠাল, লেবু, লিচু, আঙ্গুর, তরমুজ, ফুটি ইত্যাদি ফল চাষের জন্য বেশ উর্দু জমির দরকার । বাস্তব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এরুপ উঁচু জমির পরিমাণ এমনিতেই কম । যার কারনে ইচ্ছা থাকলেও নিচু এলকায় সার্থক ভাবে ফল চাষ করা যায় না। জনসংখ্যার ক্রমাগত চাপে জমি বিভক্ত হয়ে জমির আকার ছোট হয়ে আসছে ফলে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে । বাংলাদেশে চাষাবাদযোগ্য মোট জমির শতকরা ৭৫ ভাগ জমিতে ফল চাষ করা হয় । এর প্রধান কারন হলো বিপুল জনগাষ্ঠেীর খাদ্য ঘাটতি মিটানা েও দারিদ্র্য দূর করার জন্য দানা জাতীয় খাদ্যশস্য বেশি করে চাষ করা । এ ছাড়াও বর্তমানে জমিতে বেশ কিছু খাদ্য উপাদান বিশেষত গৌণ খাদ্য উপাদানের যথেষ্ট ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে । মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ও প্রয়োজনের তুলনায় কম। ফলে জমির উৎপাদনশীলতা কমে ফল উৎপাদনের হার কমে গেছে।
আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফল চাষ হয় না বিধায়, উৎপাদন খুব কম । বাংলাদেশে ফলের গড় ফলন ৭.৮ টন/হেঃ। যেখানে বিশ্ব উৎপাদন ৩০ টন মাত্রায় টন/হেঃ। ফল বাগানে সঠিক সময়ে উপযুক্ত পরিমাণ সার ব্যবহার না করা, উপযুক্ত সময় ও মাত্রায় কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ না করা, বাগানে ঘটাইসহ সঠিক আন্তঃ পরিচর্যা না করার কারণে ফলের উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পায় ।
(২) ব্যবহারিক জ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিক্ষার অভাব
আমাদের দেশে যারা ফল চাষের সাথে জড়িত তারা প্রায় নিরক্ষর ও কৃষি শিক্ষা সম্পর্কে অঙ্গ। ফল চাষের ব্যবহারিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্বন্ধে তারা একেবারেই অজ্ঞ। পারিপার্শ্বিকতার সাথে খাপ খাইয়ে নতুন প্রযুক্তি উ দ্ভাবন যেমন তাদের পক্ষে সম্বব হয় না ঠিক তেমনি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আবিষ্কৃত ব্যবহারিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি গ্রহনে তাদের অনীহা দেখা যায় অথবা তারা এ ব্যাপারে তেমন সাড়া প্রদান করেন না। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন বারমাসী আমের নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। জাপান, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তান উন্নত ও মিষ্টি জাতের আঙ্গুর উদ্ভাবন করেছে। থাইল্যান্ড ভাইরাস প্রতিরোধক এবং ১০০ ভাগ স্ত্রী গাছ উৎপাদক পেঁপে বীজ শনাক্ত করতে পেরেছে । কিন্তু বাংলাদেশে এই ব্যাপারে এখনও পিছিয়ে । গবেষণার মাধ্যমে জাত উদ্ভাবনে তেমন কোন অগ্রগতির হয়নি। বিজ্ঞান ভিত্তিক ও বাস্তবমুখী ব্যবহারিক জ্ঞান এবং কলাকৌশলের অভাব গতানুগতিক ভাবে চাষের পরিবর্তে নতুন জাত ও চাষ কৌশল তেমন উদ্ভাবন করা হয় নাই । ফল চাষে কোন সময় বাগানের কি পরিচর্যা দরকার জ্ঞানের অভাবে ভাল উৎপাদন হয় না। কৃষকরা গতানুগতিক পন্থায় ফল চাষ করার ফলে উৎপাদান অনেক কম হয়। এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্য ব্যবহারিক জ্ঞান, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আধুনিক শিক্ষার বিস্তার দরকার ।
(৩) উৎপাদন উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতা ও মূল্য এবং কৃষকের দারিদ্রতা
আমাদের দেশে ফল উৎপাদনের অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে প্রয়োজনীয় উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতা ও দুর্মূল্য এবং কৃষকের দারিদ্রতা। উৎপাদন উপকরন বলতে বীজ, সার, সেচ যন্ত্রপাতি, কীটনাশক, চারা/কলম ও পরিচর্যারজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ইত্যাদি বুঝায়। বাংলাদেশে ফল চাষের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে অধিকাংশ মান সম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য বীজ বা চারা কলম পাওয়া যায় না। আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষক দরিদ্র । ফল চাষে প্রাথমিক ভাবে অনেক মূলধন লাগে যা অধিকাংশ কৃষকের নেই । ফল চাষীরা প্রয়োজন ও চাহিদা মোতাবেক ফলের বীজ, চারা ও কলম পায় না অথবা পেলেও উন্নত মানের হয়না অথবা এদের দাম ও এত বেশি যে দরিদ্র কৃষকের পক্ষে এগুলো নগদ মূল্যে কেনা সম্ভব হয় না । ফল চাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, সার ঔষধ ইত্যাদির মূল্যের উর্ধগতি কৃষককে ফল চাষে নিরুৎসাহিত করে ।
(৪) উচ্চফলনশীল জাতের অপ্রতুলতা এবং উন্নতগুণ সম্পন্ন চারা কলমের অভাব
বাংলাদেশে ফলোৎপাদনের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে উন্নত জাতের অপ্রতুলতা। প্রধান ফলের স্বল্প সংখ্যক উন্নত জাত উদ্ভাবিত হলেও অধিকাংশ অপ্রধান ফলের কোন উন্নত জাত নেই । এতে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি গুনগত মান সম্পন্ন ফল উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। উন্নত গুনাগুন সম্পন্ন চারা/কলম বলতে অধিক উৎপাদনশীল উন্নত জাতের রোগ বালাই মুক্ত সুস্থ, সবল ও সঠিক বয়সের চারা বুঝায়। চারা/কলম উৎপাদনের সাথে সংশিষ্ট লোকজনের প্রযুক্তি গত জ্ঞানের অভাব ও উদাসিনতার কারণে উন্নত গুণাগুণ সম্পন্ন চারা/কলম উৎপাদন করা যাচ্ছে না ।
সে জন্য কৃষকরা সুস্থ সবল চারা/কলম প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে উন্নতমানের ফল উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে।
(৫) অপরিকল্পিত ফল বাগান সৃজন ও ফল গাছের সঠিক পরিচর্যার অভাব
কৃষকরা বসতবাড়ির আঙিনা অন্যান্য বনজ বৃক্ষের ছায়ায় ঘন করে ফল গাছ লাগিয়ে থাকে । ফল গাছ আলোর অভাবে লিকলিকে হয়ে বাড়তে থাকে এবং ফলন কম দিয়ে থাকে । কখনও কখনও কৃষকরা বাগানেও ঘন করে ফল গাছ রোপন করে । নির্দিষ্ট দূরত্বে না লাগানোর ফলে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি কমে যায় । নানাবিধ রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বাড়ে এবং উৎপাদনশীলতা কমে যায়। এছাড়াও অঞ্চলভিত্তিক সঠিক প্রজাতি ও জাত নির্বাচন না করায় আশানুরূপ ফলন হচ্ছে না ।
কৃষকেরা সাধারণত ফল গাছের পরিচর্যা করে না । ফল গাছের পরিচর্যা করলে এর উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে সে বিষয়েও তারা বুঝতে চায় না। এর ফলে গাছে পুষ্টি উপাদানের অভাব দেখা যায় এবং রাগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণে বেড়ে যায়। গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং গাছের আয়ু কমে যায়। কখনও কখনও বিধিসম্মতভাবে পরিচর্যা না করার দরুন গাছের ক্ষতি হয় এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ।
(৬) প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আর্থিক ঝুঁকির আশংকা
বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দেশ । প্রতি বছরই বন্যা, ঝড়, জলাচ্ছ্বোস, সাইক্লোন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, রোগ, পোকামাকড় অথবা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আবির্ভাব হয়। এতে ফলের ব্যাপক ধ্বংস লীলা সাধিত হয় । যেমন- অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি বা বন্যায় পেঁপে, কলা, পেয়ারা, লেবু জাতীয় ফল, জামরুল ইত্যাদি ফল সাংঘাতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। শিলাবৃষ্টি ও সাইক্লোন বা প্রবল ঝড়ে আম, কলা, পেঁপে, কুল, লিচু ইত্যাদি ফলের গাছ ভেঙে যায় এবং ফল ছিড়ে পড়ে প্রচুর ক্ষতি হয়। এছাড়া রোগ ও পোকামাকড় এবং তাপমাত্রার তারতম্যের কারনে ফলের প্রচুর ক্ষতি হয় । তা ছাড়া এদেশের দরিদ্র কৃষকের পক্ষে ফল চাষের জন্য কয়েক বছর মুলধন বিনিয়াগে করে লাভের আশায় অপেক্ষা করা একেবারেই অসম্ভব । কাজেই কৃষক ঝুঁকি নিয়ে নিবিড় মূলধনভিত্তিক ফল চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ।
(৭) ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের অভাব
ফল খুবই দ্রুত পচনশীল বলে একে সাধারণভাবে খুব বেশি সময় সংরক্ষন করা যায় না। এ পচনশীল ফলকে পচনের হাত হতে রক্ষা করার কোন উন্নত কলা কৌশল বা হিমাগারে ফল সংরণের কোন ব্যবস্থা এবং কোন । প্রক্রিয়াজাতকরন শিল্প আজ পর্যন্ত গড়ে উঠেনি। অধিকাংশ ফল প্রায় একই সময়ে পাকার কারণে ফলের দাম খুব । কম হয় এবং উৎপাদিত ফলের অধিকাংশ পচে নষ্ট হয়। ফলে কৃষকরা নাম মাত্র মূল্যে ফড়িয়াদের কাছে ফল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ফলে আর্থিকভাবে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আনারস, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, তরমুজ ইত্যাদি ফলের প্রক্রিয়াজাতকরন ব্যবস্থা থাকলে অমৌসুমে বাজারজাত করা যেত। এছাড়া বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদিশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হতো। এতে চাষীদের মধ্যে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আগ্রহ সৃষ্টি হতো ।
(৮) পরিবহন ও বিপণন সমস্যা
আমাদের দেশের অধিকাংশ ফল গ্রামের দুর্গম এলাকায় উৎপাদিত হয়। এ সব উৎপাদন এলাকার সাথে বিপণন এলাকা তথা শহরের ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা পড়ে উঠেনি। এ কারনে উৎপাদন এলাকা হতে শহরাঞ্চলে ফল পৌঁছতে অনেক সময় লাগে। খরচও বেশি পড়ে যায়। তাছাড়া ফলের গুনগত মান কমে যায় এবং অনেক সময় ফল পঁচে যায়। অনেক সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হরতাল ও পরিবহন ধর্মঘটের ফলে ফল উৎপাদনকারীগন যথাসময় উৎপাদিত ফল বাজারজাত করতে পারে না। রফতানিকৃত দ্রব্য রেলস্টশনে, সমুদ্র বন্দরে, ট্রাক স্ট্যান্ডে, লঞ্চ বা নৌকা ঘাটে, বিমান বন্দরে দীর্ঘ সময় আটকা পড়ে থেকে নষ্ট হয় যায় । এতে অনেক সময় রাস্তা ঘাটের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ফল বিক্রয় করতে হয় বলে ফলের পচন ত্বরান্বিত হয়, ফলের অপচয় হয় এবং কৃষকরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । ফল বিপণনের সাথে জড়িত রয়েছে সম্পূর্ণ ফড়িয়া ও অন্যান্য মধ্যস্বত্বভোগি সুবিধাবাদি গোষ্ঠি । ফল চাষের লভ্যাংশ এই সব ফড়িয়াদের হাতে চলে যায় । কৃষকের নাম মাত্র মুল্যে ফল বিক্রির করতে হয় বলে মূলধন অনেক সময় উঠেনা । তাই কৃষকও ফল চাষে তেমন গুরুত্ব দেয় না ।
উপরোক্ত সমস্যাবলী ছাড়াও ভালো জাতের অভাব, ঋন সংক্রান্ত সমস্যা সেচ সুবিধার অভাব, কৃষি সমবায়ের অনুপস্থিতি, কৃষি সম্প্রসারণ ও গবেষনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ কৃষি বাজার ব্যবস্থা, ফড়িয়া দালালদের দৌরাত্ম, শস্য বীমার অনুপস্থিতি ইত্যাদি কারণে ফলোৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। বাংলাদেশে ফলের গড় ফলন কত ?
২ । কোন দেশে ভাইরাস প্রতিরোধক ১০০ ভাগ স্ত্রী গাছ উৎপাদক পেঁপে বীজ শনাক্ত করতে পেরেছে ?
৩ । ফল চাষের জন্য সাধারণত কি ধরনের জমি দরকার ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ফল চাষের প্রধান প্রধান সমস্যাগুলোর তালিকা তৈরি কর ।
২ । ফল চাষে জমির অভাব ও নিম্ন উৎপাদনশীলতা সমস্যা সম্পর্কে বর্ণনা কর ।
৩ । উৎপাদন উপকরের দুর্মূল্য ও দুষপ্রাপ্যতা সম্পর্কে লেখ ।
৪ । ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করন সমস্যা বর্ণনা কর ।
৫ । ফল চাষে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আর্থিক ঝুঁকি ব্যাখ্যা কর ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১ । ফল উৎপাদনের সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো লিপিবদ্ধ কর ।
২। বাংলাদেশে ফল চাষের প্রধান প্রধান সমস্যাগুলোর বিবরন দাও।
৩ । ফল পরিবহন ও বাজারজাতকরণের সমস্যা বর্ণনা কর ।
৪ । মানসম্পন্ন চারা ও উচ্চফলন শীল জাতের অভাব এবং অপরিকল্পিত বাগান ও ফল বাগানের সঠিক পরিচর্যা জ্ঞানের অভাব সম্পর্কে আলোচনা কর ।
বংশ বিস্তারের ধারণা কোন একটি উদ্ভিদ প্রজাতির টিকে থাকা ও সংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে সংক্ষেপে ঐ উদ্ভিদের বংশবিস্তার বলা যায় । ফল গাছ তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য বংশ বিস্তার করে থাকে । কোন কোন ফল গাছ শুধু বীজের মাধ্যমে আবার কোন কোন ফল গাছ বীজ ও অঙ্গজ উভয় পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করে থাকে । কিছু কিছু ফল গাছে অজ চারা উৎপাদন প্রায় অসম্ভব কিংবা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল । যেমন- নারিকেল, তাল, এসব ক্ষেত্রে চারা উৎপাদনের জন্য বীজ ব্যবহার করাই শ্রেয় । বীজ থেকে গজানো চারা বড় ও শক্ত হয় এবং ফল বেশি দেয় । যে সব ক্ষেত্রে উভয় পদ্ধতিই সমান ভাবে প্রযোজ্য সেখানে অঙ্গজ বংশ বিস্তারের মাধ্যমে চারা উৎপাদন করাই শ্রেয়।
বীজের মাধ্যমে কোন কোন ফল বংশবিস্তার করে
কোন একটি উদ্ভিদ প্রজাতির প্রকৃতিতে টিকে থাকাও তার সংখ্যাবৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে সংক্ষেপে ঐ উদ্ভিদের বংশ বিস্তার বলা যায় । বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বংশ রক্ষার্থে নির্দিষ্ট কোন একটি গাছ যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যৌনকোষের সাহায্যে বা অঙ্গজ উপায়ে তার সমতুল্য নতুন একটি গাছের জন্ম দিয়ে থাকে সে প্রক্রিয়াকে উদ্ভিদের বংশ বিস্তার বলে ।
উদ্ভিদসমূহ প্ৰধানত দুটো পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করে থাকে । যথা- যৌন পদ্ধতি ও অযৌন পদ্ধতি বা অঙ্গজ পদ্ধতি বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তার পদ্ধতি বা যৌন পদ্ধতি (Sexual propagation) এ পদ্ধতিতে বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা হয় । উদাহরণ- আম, কাঁঠাল, জাম, নারিকেল, তাল ইত্যাদির বীজ দ্বারা গাছ তৈরি করা যায় ।
অঙ্গজ বা অযৌন বংশবিস্তার (Asexual vegetative propagation )
এ পদ্ধতিতে যৌনকোষ বা বীজ ছাড়া মাতৃগাছের অন্যান্য কোষ দ্বারা মাতৃগাছের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নতুন গাছ তৈরি হয় । গাছের প্রতি কোষই মাতৃগাছ বা নতুন গাছ সৃষ্টির কৌলতাত্ত্বিক উপাদানসমূহ ধারন করে । এ জন্য প্রতিটি কোষ হতে একটি নতুন গাছ জন্ম হতে পারে। অযৌন বা অঙ্গজ বংশবিস্তারের পদ্ধতিগুলোর তালিকা নিম্নে দেওয়া হলো ।
ফল চাষের বংশ বিস্তার পদ্ধতি
১। অ্যাপোমিকটিক পদ্ধতি (Apomictic): উদাহরণ- সাইট্রাস, আম ইত্যাদি ।
২। পৃথকীকরণ পদ্ধতি (Separation): উদাহরণ- পেঁয়াজ, টিউলিপ ইত্যাদি ।
৩। কন্দর মাধ্যমে বংশবিস্তার (Bulb): উদাহরণ- পেঁয়াজ, টিউলিপ ইত্যাদি ।
৪ । গুড়ি কন্দের মাধ্যমে বংশবিস্তার (Com): উদাহরণ- ওল, মুখীকচু, গরাডিওলাস ইত্যাদি ।
৫। বিভাজন পদ্ধতি (Division): উদাহরণ- আলু ।
৬। স্থূল কন্দের মাধ্যমে বংশবিস্তার (Tuber): উদাহরণ- আলু ।
৭। মুলের মাধ্যমে বংশবিস্তার (Tuberous root): উদাহরণ- মিষ্টি আলু, ডালিয়া ।
৮ । রাইজোমের মাধ্যমে বংশবিস্তর (Rhizome): উদাহরণ- কলা, আদা, হলুদ ।
৯ । খর্ব ধাবকের মাধ্যমে বংশবিস্তার (Offsets / off roots): উদাহরণ- আনারস, খেজুর।
১০ । মুকুটের মাধ্যমে বংশবিস্তার (runner): উদাহরণ- থানকুনি, আমরুল ।
১১ । ধাবকের সাহায্যে বংশবিস্তার (Propagation by cutting)
১২ । দাবা কলমের সাহায্যে বংশবিস্তার (Lay ering): উদাহরণ- পেয়ারা, লেবু, হাসানা হেনা, জবা ।
১৩ । জোড় কলমের সাহায্যে বংশবিস্তার (Grafting)
১৪ । কুঁড়ি সংযোজন বা চোখ কলমের সাহায্যে বংশবিস্তার (Budding) : উদাহরণ- কুল, গোলাপ
১৫ । কোষ বা কলা কালচার পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করে (Tissue culture)
অঙ্গজ বংশবিস্তার ও বীজের মাধ্যমে ফল চাষের পার্থক্য
উদ্ভিদসমূহ প্ৰধানত দুটো পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করে থাকে যথা- যৌন পদ্ধতি ও অযৌন বা অঙ্গজ পদ্ধতি । ফল চাষের ক্ষেত্রে এ দুই পদ্ধতির পার্থক্য নিম্নে দেখানো হলো ।
ছক- ১ বীজের মাধ্যমে বা যৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তারের সুবিধা ও অঙ্গজ বা অযৌন পদ্ধতির অসুবিধা
বীজের মাধ্যমে বা যৌন পদ্ধতিতে | অঙ্গজ বা অযৌন পদ্ধতিতে |
১। যে সব ফল গাছ সাধারনত আজ উপায়ে বংশ সজীব বিস্তার করতে পারে না সেসব ফলগাছের বংশ বিস্তারের জন্য যৌন পদ্ধতি একমাত্র উপায় | ১। কতিপয় ফলগাছ যেমন-কলা, আনারস ইত্যাদি ও প্রকৃত বীজ উৎপাদন করে না। তাই এসব গাছের বংশ টিকিয়ে রাখার জন্য অযৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই । |
২। বীজ থেকে উৎপন্ন গাছ সাধারনত অধিক কষ্ট সহিষ্ণু হয় ও বেশিদিন বাঁচে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- ঝড়, বৃষ্টি, খরা বা যে কোন প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম । | ২। বীজ থেকে উৎপন্ন চারায় মাতৃগাছের গুণাগুণবজায় থাকে না। তাই মাতৃগুণ সম্পন্ন গাছ পেতে হলে অযৌন পদ্ধতিই একমাত্র উপায় । |
৩। সংকরায়ণের মাধ্যমে নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতির আর কোন বিকল্প নেই। | ৩। ফল গাছের এমন কতগুলো জাত আছে যারা উত্তম গুণাগুণ সম্পন্ন ফল প্রদান করে এবং উচ্চ ফলনশীল। কিন্তু জলাবদ্ধতা, খরা, লবণাক্ততা, রোগ, পোকামাকড় ইত্যাদির প্রতি অধিক সংবেদনশীল । এসব গাছকে বীজ থেকে না জন্মিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির সংগে খাপ খায় এমন আদিজোড় এর সাথে কলম করে প্রতিকূল পরিবেশে টিকিয়ে রাখা যায়। |
৪। যৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তারের জন্য তেমন কোন কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতার দরকার হয় না । | ৪ । অযৌন পদ্ধতিতে জন্মানো গাছ কম বিস্তারশীল হওয়ায় এসব গাছের ফল সগ্রহ ও পরিচর্যা সহজতর হয়। অপরদিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গায় অধিক সংখ্যক গাছ । লাগিয়ে মোট ফলন বাড়ানো যায় । |
৫। অপেক্ষাকৃত সহজ ও সস্তায় এবং কম পরিশ্রমে চারা পাওয়া যায় । | ৫। অপেক্ষাকৃত কম সময়ে উচ্চ গুণসম্পন্ন চারা পাওয়া যায় । |
ছক-২ অঙ্গজ বা অযৌন পদ্ধতির সুবিধা বীজের মাধ্যমে বা যৌন পদ্ধতিতে বংশবিস্তারের অসুবিধা
অঙ্গজ বা অযৌন পদ্ধতিতে | বীজের মাধ্যমে বা যৌন পদ্ধতিতে |
১। এ পদ্ধতিতে নতুন কোন জাত সৃষ্টি করা যায় না । | ১। বীজ থেকে উৎপন্ন গাছে কখনো মাতৃগাছের গুণাগুণ অক্ষুন্ন থাকে না । |
২। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌন পদ্ধতির চেয়ে অযৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তারের খরচ বেশি লাগে। | ২। গাছ লম্বা, উঁচু ও বড় হওয়ায় ফল সংগ্রহ কষ্টকর হয়। |
৩। এ পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করতে গেলে যথেষ্ট কারিগরি জ্ঞান, দরাতা ও অনুশীলনের দরকার হয়। | ৩। এ প্রক্রিয়ায় জন্মানো গাছে ফুল ফল আসতে সময় বেশি লাগে। |
৪ । অঙ্গজ উপায়ে বংশ বিস্তারকারী গাছসমূহ সাধারণত অল্প দিন বাঁচে। | ৪। গাছ বড় আকারের হওয়ায় নির্দিষ্ট পরিমান জমিতে কমসংখ্যক গাছ লাগাতে হয় । |
৫। এ পদ্ধতিতে কিছু কলমের অস্থানিক মূল সৃষ্টি হওয়ায় তা মাটিতে শক্তভাবে আটকে থাকতে পারে না । ফলে ঝড় বৃষ্টিতে গাছ পড়ে যায় । | ৫। আঙ্গিক বৃদ্ধি বেশি হওয়ায় ঝড় তুফানে গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা থাকে |
৬। এ কাজে দর মালি পেতে কষ্ট হয় । | ৬। মানসম্মত বীজ পেতে অসুবিধা । |
৭ । পরিবহনে অল্প সংখ্যক চারার জন্য অনেক জায়গার প্রয়োজন হয় । | ৭। বীজতলা তৈরি ও চারা উৎপাদনের জন্য কারিগরি দক্ষতার অভাব । |
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ফল গাছের বংশ বিস্তার কীভাবে ঘটে থাকে ?
২। বীজের মাধ্যমে কোন কোন ফলের বংশ বিস্তার হয় ?
৩। অঙ্গজ বংশ বিস্তারের সুবিধা কী ?
৪ । আমাদের দেশে স্বল্প মেয়াদী ফল কোনগুলো?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। বীজের মাধ্যমে কোন কোন ফল বংশ বিস্তার করে ?
২। অঙ্গজ বংশবিস্তারের ফলের নামের তালিকা তৈরি কর ।
৩ । অঙ্গজ বংশবিস্তার ও বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তারের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী ?
৪। উদ্ভিদের বংশবিস্তার বলতে কি বাঝায় ?
৫ । ভিনিয়ার ও সংস্পর্শ জোড় কলমের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী ?
৬ । গাছের পাঁচটি অংশের নাম লেখ যার মাধ্যমে বংশবিস্তার করা যায় ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। অঙ্গজ ও যৌন বংশ বিস্তারের সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ লিপিবদ্ধ কর
২। অঙ্গজ বংশ বিস্তার ও বীজের মাধ্যমে ফল চাষের পার্থক্য ব্যাখ্যা কর ।
৩। অযৌন বংশবিস্তার বলতে কী বাঝায় ? গাছের বংশবিস্তার কয় ভাগে করা যায় উদারহণসহ লেখ।
৪ । অযৌন বংশ বিস্তারের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো লেখ ।
৫ । ভিনিয়ার জোড় কলম করার পদ্ধতি চিত্র অঙ্কনসহ বর্ণনা কর ।
৬। টীকা লেখ: ক) গুটি কলম খ) শাখা কলম গ) চোখ কলম ঘ) জোড় কলম ।
ফল বাগান স্থাপনের আগে বাগান পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। কারণ ফলের বাগান তৈরির সময় কতিপয় মৌলিক নিয়ম-কানুন সঠিকভাবে অনুসরণ না করলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হয় না এবং পরবর্তীতে ফল বাগান ব্যবস্থাপনায় নানাবিধ সমস্যা দেখা যায়। দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক ফল বাগানের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। অধিকাংশ ফলের গাছই বহুবর্ষী হওয়ায় ফলের বাগান তৈরির সময় কোন ভুলত্রুটি থাকলে পরবর্তীকালে সেগুলো সংশোধন করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে দাড়ায় ।
ফল বাগান পরিকল্পনার সাধারণ নীতিমালা
(১) ফল বাগান স্থাপন এবং কোন নির্দিষ্ট ফল ভালোভাবে চাষের জন্য তার উপযোগী আবহাওয়া, জমির উচ্চতা, মাটির প্রকারভেদ, ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ, পরিবহন ও বিপণনের সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করতে হবে ।
(২) পতিত জমিতে বাগান করতে হলে সেখানে পুরাতন গাছ বা গাছের গোড়া থাকলে তা পরিষ্কার করে গভীরভাবে চাষ করতে হবে । পাহাড়ী এলাকা হলে কস্টর এবং সিড়িবাধ তৈরি করে কিছুদূর পর্যন্ত সমতল করে নিতে হবে ।
(৩) বাগান তৈরিতে রাস্তা, সেচ ও নিষ্কাশন নালা, বাগানের গুদামঘর ইত্যাদি কাজের জন্য কোনক্রমেই মোট জমির শতকরা দশভাগের বেশি ব্যবহার করা সমিচিন হবে না ।
(৪) বাগানে সেচ সুবিধার জন্য কাছাকাছি পানির ব্যবস্থা থাকা দরকার ।
(৫) চিরসবুজ গাছগুলো বাগানের সামনে এবং ভিতরে লাগাতে হবে । পাতা ঝরে যায় এমন গাছ যেমন- বেল, আমড়া, বরই ইত্যাদি পিছনে এবং বাইরে লাগাতে হবে ।
(৬) সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয় এমন গাছ পানির উৎসের কাছাকাছি এবং বৃষ্টিনির্ভর গাছ পানির উৎস হতে দুরে লাগাতে হবে ।
(৭) ছোট আকারের গাছ বাগানের সামনে এবং লম্বা ধরণের গাছ পিছনের দিকে লাগাতে হবে, তাতে বাগান তত্ত্বাবধানে সুবিধা হবে ।
(৮) বর্ষার শুরুতে সঠিক দূরত্বে গর্ত করে পরিমাণ মত সার দিয়ে চারাগাছ লাগাতে হবে ।
(৯) গাছের সঠিক বৃদ্ধির জন্য পরিমাণমত জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে ।
(১০) ফলের বাগানে আন্তঃফসলের চাষাবাদ করলে গাছের দূরত্বের সর্বোচ্চ দূরত্বে এবং তা না করলে সর্বনিম্ন দূরত্বে গাছ লাগাতে হবে ।
(১১) বাগানের চারিদিকে প্রয়োজনে বেড়া দিতে হবে। প্রবল বাতাস থেকে গাছ রক্ষার জন্য উত্তর পশ্চিম দিকে বায়ুরোধকারী বৃক্ষ ঘন সারি করে লাগাতে হবে । বেড়া গাছ গ্রীষ্মের গরম বাতাস এবং শীতের শুষ্ক ও ঠান্ডা বাতাস থেকে বাগানের ফল গাছকে রক্ষা করবে । বেড়ার চারদিকে কাটা ওয়ালা পাতি, কাগজি ও গন্ধরাজ লেবুর গাছ ও করমচা গাছ লাগানো যেতে পারে । এতে বেড়ার কাজ হবে এবং ফল ও পাওয়া যাবে। তবে বেড়ার জন্য লাগালে এসব গাছ ছাটা ঠিক হবে না ।
(১২) উর্বর জমিতে লাভজনকভাবে ফল চাষের জন্য যে সমস্ত ফল গাছ মোটামুটি একই সময়ে ফল দেয় সে সমত ফল গাছগুলোকে পাশাপাশি লাগাতে হবে।
(১৩) বাগানের নক্সা তৈরির আগে গাছের আকার, জমির পরিমাণ ও জমির আকৃতি, গাছ রোপণ প্রণালী ঠিক করে নিতে হবে ।
(১৪) ফলের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে বাঁশের ঝুড়ি, চটের ব্যাগ, কাঠের বা পিচবোর্ডের বাক্সে প্যাকিং করে বাজারে পাঠাতে হবে । তাই বাগান এলাকার আশেপাশে এ সমস্ত উপকরণসমূহের সহজলভ্যতা থাকতে হবে।
(১৫) ফল চাষ করে সহজে এবং কম খরচে যাতে বাজারে বা চিহ্নিত স্থানে নিয়ে যাওয়া যায় সে বিষয়টি খেয়াল করতে হবে।
(১৬) বাগানের পরিচর্যার জন্য যন্ত্রপাতি যথা- কোদাল, নিড়ানি, ঝাঝরি, ফর্ক, রেফ, দা, প্রুনিং 'স', কাঁচি, বাডিং ছুরি, স্পেয়ার, একচাকার ঠেলাগাড়ি প্রভৃতির ব্যবস্থা রাখতে হবে ।
ফল বাগানের পরিকল্পনা তৈরি
অধিকাংশ ফলের বাগান দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় বাগান প্রতিষ্ঠার আগে সঠিক পরিকল্পনা ও নকশা তৈরি করা উচিত। কোন জায়গায় বাগান প্রতিষ্ঠার আগে সে জায়গার জমি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, জলবায়ু, মাটির গুণাগুণ, জনগণের চাহিদা, শ্রমিক প্রাপ্যতা, বাজার ব্যবস্থা, উন্নত জাত ও প্রযুক্তি প্রাপ্তি, আর্থ-সামাজিক অবস্থা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে বাগানের পরিকল্পনা করতে হয় । বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে পরিকল্পনা না করা হলে অযথা অর্থ ব্যয় হবে ও ফল চাষের ক্ষতি হবে । পূর্বেই সতর্ক হতে হবে যেন কোন ভুলত্রুটি না থাকে । ফল বাগানে গাছ নকশা করে লাগাতে হবে । বাগান নকশা করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন গাছের বৃদ্ধি ব্যহত না করে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে অধিক সংখ্যক গাছ লাগানো যায় এবং বাগানে আন্ত পরিচর্যা সুচারুভাবে করা যায় ও বাগান দেখতে সুন্দর হয় ।
ফল বাগানের জন্য সব সময় উচ, খোলামেলা, পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত এবং জলাবদ্ধতা হয় না এমন স্থান নির্বাচন করতে হয় । বিভিন্ন জাতের ফল গাছ বিভিন্ন আবহাওয়া ও মাটিতে ভালোভাবে জন্মাতে পারে । মাটির গুণাগুণ অনেক ক্ষেত্রে পরিচর্যার মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায় । কিন্তু আবহাওয়া পরিবর্তন করা যায় না। ফলের গাছ স্বল্প মেয়াদী, মধ্যম, মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদী ফল গাছ ৩০-৪০ বছর থেকে ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত ভালোভাবে ফল দিয়ে থাকে। মধ্যমেয়াদী ফল গাছ ১৫-২০ বছর ভালোভাবে ফল দিয়ে থাকে । স্বল্প মেয়াদী ফল গাছ ১-৩ বছর পর্যন্ত ফল দিয়ে থাকে। দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি ফল গাছ রোপনের সময় স্থান নির্বাচন, নকশা তৈরি, রোপণের দূরত্ব নির্ধারণ জাত বাছাই ইত্যাদিতে যদি ভুল হয়, আর তা যদি বাগান স্থাপনের কয়েক বছর পর জানা যায় । তাহলে তা সারিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না । বাগান লাভজনক করতে হলে দীর্ঘ ও মধ্য মেয়াদী বাগানে আস্ত ফসলের চাষ করা যেতে পারে। যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল প্রভৃতি ফল গাছ ৮-১০ বছরের আগে ভালো ভাবে ফল দেয় না। সেজন্য এ সময় পেঁপে, কলা, আনারস, জামরুল, আতা, সরিফা, কুল লাগিয়ে খরচ পুষিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আন্তফসল হিসাবে আলু, পিয়াজ, মরিচ, ডাল জাতীয় ফসল বা শাক সবজী চাষের চিন্তা করা যেতে পারে । ফল বাগান স্থাপন কল্পে পরিকল্পনার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়াবলি অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে।
ফল গাছের নকশার প্রকারভেদ গুলি বর্ণনা
বিজ্ঞানভিত্তিক ফল বাগান তৈরি করতে গেলে বাগানে গাছ লাগানোর নকশা ঠিক রাখা দরকার। একটি গাছ হতে অপরটির সঠিক দূরত্ব রাখলে স্বাভাবিকভাবে ফল ধারণ করে। নকশা করে গাছ লাগালে গাছ রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কম পড়ে, সেচ ব্যবস্থা সহজ হয় এবং কম জায়গায় সর্বোচ্চ সংখ্যক গাছ বসানো যায় । বাগানের নকশা রোপণ প্রণালীর ওপর নির্ভরশীল। ফল বাগানে ছয়টি পদ্ধতিতে নকশা করে গাছ লাগানোর হয় । এগুলো হলো (১) আয়তাকার পদ্ধতি (২) বর্গাকার পদ্ধতি (৩) কুইনকাংশ পদ্ধতি (৪) ত্রিভুজাকার পদ্ধতি ৫) ষড়ভুজী পদ্ধতি (৬) সময়াল ও সিড়ি বাঁধ পদ্ধতি ।
ফল বাগানে গাছ লাগানোর বিভিন্ন নকশার বিস্তারিত বর্ণনা নিম্নে প্রদান করা হলো
উন্নত পদ্ধতিতে এবং লাভজনক ফল বাগান করতে হলে বাগানে গাছ লাগানোর জন্য নকশা তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন । বাগান তৈরির আগে প্রথমে কাগজে নকশা তৈরি করে ভুলত্রুটি দেখে নিতে হবে । বাগানের নকশা তৈরি করে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাগানের অফিসঘর, গুদামঘর, গার্ডশেড, পানির পাম্পের স্থান, ভিতরের রাস্তা, সেচ ও নিকাশ নালা নির্দিষ্ট ফল গাছের জন্য নির্বাচিত স্থান, বেড়ার গাছ যথাস্থানে আছে বা করা যাবে কিন নিতে হয় । জমির সুষ্ঠু ব্যবহার এবং জমির অপচয় রোধে প্রত্যেকটি কাজের জন্য জমি চিহ্নিত করে ফল গাছের রোপণ পদ্ধতি অনুযায়ী রোপণ দূরত্ব ঠিক করে, সেচ পদ্ধতি, পরিচর্যা ইত্যাদি বিষয় বাগানের নকশায় উল্লেখ করতে হবে । বাগানের নকশা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে মাটির উর্বরতা ও অবস্থান দেখে সর্বাধিক সংখ্যক গাছ লাগানো যায় । তাতে প্রতিটি গাছ সুন্দরভাবে আলোবাতাস পেয়ে বড় হতে পারে। পরিকল্পনা মোতাবেক গাছ লাগালে পরস্পরে জড়িয়ে যায় না এবং একটি অন্যটির বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে না। বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফুল বাগানের নকশা বা পরিকল্পনা করা হয়।
এ পদ্ধতিগুলো যথা-
১। আয়তকার
২। বর্গাকার
৩ । পঞ্চম সংস্থান বা তারকাকৃতি বা কুইনকাংশ
৪ । ত্রিকোণী বা ত্রিভুজাকার
৫ ৷ ষড়ভুজী
৬ । কন্টুর বা সিঁড়িবাধ
উলিখিত ছয় প্রকার গাছ রোপণ পদ্ধতির প্রধান প্রধান বিষয়গুলো নিচে আলোচনা করা হলো। তবে রোপণ পদ্ধতি নির্ধারন করার সময় কতকগুলো বিষয় বিবেচনা করা উচিত । যথা-
(ক) নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে কত বেশি সংখ্যক গাছ রোপণ করা যাবে ।
(খ) জমি চাষ, পানি সেচ ও নিকাশ, গাছের পরিচর্যা কত সহজে ও সুষ্ঠুভাবে করা যাবে ।
(গ) চারা রোপণের পদ্ধতির কারণে যেন গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত না হয়
(ঘ) এমনভাবে গাছ লাগাতে হবে যাতে বাগান দেখতে সুন্দর দেখায় ।
চারা রোপণের জন্য নকশা প্রণয়নে করণীয় কাজসমূহ । যথা-
১। মূলরেখা চিহ্নিতকরণ: প্রতিটি জমিতে চারা রোপণের আগে জমির কিনারা বা আইল দিয়ে সীমানা রেখা টানতে হবে। এরপর একটি মূলরেখা টেনে নিতে হয়। সাধারণত প্রতিটি জমিতে গাছের প্রথম সারিটি মূল রেখা হিসেবে ধরে নেয়া হয়। এ সারিটি জমিতে সারি থেকে সারির যে দূরত্বে গাছ লাগানো হবে মূলরেখাটি জমির কিনারা বা আইল হতে তার অর্ধেক দূর দিয়ে নিতে হবে। এ সারিকে মূল সারি বা ভিত্তি সারি হিসেবে বিবেচনা করা হয় । এর উপর গাছ হতে গাছের দূরত্ব চিহ্নিত করে অপরাপর সারিগুলো এমনভাবে টানতে হবে যেন একটি আরেকটির সাথে পরস্পর সমান্তরালভাবে থাকে ।
২। জমিতে লম্বরেখা গঠন: জমির এক কোণে দাঁড়িয়ে বা মূল সারির এক প্রান্তে দাড়িয়ে যথাযথ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট একটি রশি ধরে ৩:৪:৫ অনুপাতে বা ১২, ১৩, ২০ মিটার হিসেবে জমির দুই দিকের আইল বরাবর রশি ধরে চিহ্নিত করতে হবে । অর্থাৎ কৌণিক স্থান হতে উভয় দিকের আইল বরাবর দুইদিকে রেখা টেনে একটিতে ১২ মিটার এবং অপরটিতে ১৬ মিটার দূরত্ব চিহ্নিত করতে হবে । এই চিহ্নতি ঘন দুইটি সোজাসুজি সংযোগ করা হলে সংযোজিত রেখাটি যদি ২০ মিটার হয় তাহলে সংযোগস্থলে ৯০ ডিগ্রী কোণ তৈরি হবে । এরপর উভয়দিকের রেখা সরল রেখা হিসেবে প্রসারিত করা হলে একটি অপরটির উপর লম্বরেখা হিসেবে অঙ্কিত হবে । এর একটিকে মুলরেখা ধরে সমান্তরাল রেখা টানতে হবে। তবে মুল রেখাটি জমির কিনারা বা আইলে না ধরে সারি হতে সারির অর্ধেক দূরত্বে ধরতে হয়।
৩ । মুকুরেখা প্রস্তুতকরণ: জমিতে আইল বরাবর লম্ব রেখা টেনে তারপর মুলরেখা তৈরি করা হয় । এ মুলরেখার উপর গাছ রোপণের চিহ্নিত স্থান হতে পরবর্তী রেখার বা সমান্তরাল রেখার চিহ্নিত স্থানে লম্ব রেখার উপর হতে মূল রেখার সমান্তরাল রেখা সংযোগ করা হলে মুক্ত রেখা তৈরি হয়। এ ভাবে মূলরেখার ওপর গাছের দূরত্ব অনুসারে প্রতিটি সারিতে সারি হতে সারির অঙ্কিত রেখায় যতগুলো সম্ভব স্থান চিহ্নিত করে সংযোগ করতে হবে । তবে মূলরেখার উপর এক দিক হতে বা উভয়দিক হতে গাছ রোপনের জন্য নির্ধারিত দূরত্বের অর্ধেক দূরত্ব হতে গাছ রোপণের জন্য উলিখিত রেখাগুলি তৈরির করতে চিহ্নিত করণ দণ্ড বা গোজ, দূরত্ব মাপার ফিতা রশি এবং গাছের স্থান চিহ্নিত করে রাখার জন্য চিকন কাঠির প্রয়োজন । ফল গাছ রোপণের পদ্ধতিগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো -
(১) আয়তকার পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে পাশাপাশি দুই বা ততোধিক সমান্তরাল সারির মধ্যে মূল সারিতে গাছের স্থান চিহ্নিত করতে হবে । এরপর মুল রেখার চিহ্নিত স্থান হতে পরবর্তী সারিগুলোকে লঘরেখায় চিহ্নতি করে মুক্ত রেখা চিহ্নিত করতে হবে। এর ফলে পাশাপাশি দু'সারির মধ্যে চারটি গাছের সমন্বয়ে একটি আয়তক্ষেত্রের সৃষ্টি হবে । সাধারণত আয়তকার পদ্ধতিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব গাছ থেকে গাছের দূরত্বের চেয়ে বেশি থাকে । এ পদ্ধতিতে লাগানো ফল বাগানে আন্তঃপরিচর্যা যেমন- চাষ, পানি সেচ, মাটি কোপানো ইত্যাদি কাজ সুবিধাজনক হয় । বাগানের জন্য রোপিত গাছ বড় হওয়ার আগে এর মাঝে শাক, আলু, তরমুজ, ফুটি, হলুদ, কচু ইত্যাদি ফসল কয়েক বছর করা যায় । এর ফলে বাড়তি আয় করা সম্ভব হয় ।
হেক্টর প্রতি গাছের সংখ্যা নির্ণয়ের পদ্ধতি (আয়তকার বা বর্গাকার পদ্ধতি)
এক হেক্টর জমিতে মোট গাছের সংখ্যা = এক হেক্টর জমি = ১০০০০ বর্গমিটার
সারি থেকে সারির দূরত্ব (ব:মি:) গাছ থেকে গাছের দূরত্ব(ব:মি:)
বা সারির সংখ্যা প্রতি সারিতে গাছের সংখ্যা
উদাহরণ: পেঁপে বাগানে ৫মিটার দূরত্বে সারি করে ২ মিটার দূরত্বে চারা রোপণ করলে এক হেক্টর জমিতে কতটি চারা রোপণ করা যাবে ।
(২) বর্গাকার পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে পাশাপাশি দুই সারির গাছগুলোকে এমনভাবে রোপণ করা হয়, যাতে সারি হতে সারি এবং গাছ হতে গাছের দূরত্ব পরস্পর সমান থাকে । অর্থাৎ পাশাপাশি দুই সারির চারটি গাছ মিলে একটি বর্গক্ষেত্র তৈরি করে । বর্গক্ষেত্রের চারকোণার স্থান গুলোতে গাছ রোপণ করা হয় । আম, কাঁঠাল, লিচু, সফেদা, জাম, জামরুল, পেয়ারা, পেঁপে প্রভৃতি ফল গাছের চারা এ পদ্ধতিতে রোপণ করা হয় । এ পদ্ধতিটি তুলনামূলকভাবে সহজ এবং মাঠে সহজে নকশা প্রণয়ন করা যায় ।
জমিতে মূলরেখা তৈরি করার পর নির্দিষ্ট দূরত্ব অনুসারে সম্পূর্ণ মুল রেখায় কাঠি বা গোজ পুঁতে চারা রোপণের স্থান চিহ্নিত করতে হবে । মূলরেখার সঙ্গে লরেখা টেনে সারি হতে সারির দূরত্ব চিহ্নিত স্থান হতে মুল রেখার সমান্তরাল রেখা টানতে হবে । এরপর প্রথম সারি বা মূলরেখার চিহ্নিত স্থান হতে লরেখা টেনে নিলে পরবর্তী সারিগুলোতে যেখানে অতিক্রম করবে সে স্থানগুলোতে কাঠি বা গোঁজ পুঁতে দিতে হবে। প্রত্যেকটি চিহ্নিত স্থানে গাছ রোপণ করা হলে প্রতি চারটি গাছ মিলে এক একটি বর্গক্ষেত্র তৈরি করবে। এ পদ্ধতিটি বেশি প্রচলিত এবং দেখতে সুন্দর দেখায় । এখানে উল্লেখ্য যে মূলরেখাটি জমির আইল হতে সারি হতে সারির দূরত্ব বাদ দিয়ে প্রথম গাছের স্থান চিহ্নিত করা হয় । বর্গাকার পদ্ধতিতে মোট গাছের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য আয়তকার পদ্ধতির অনুরূপ নিয়ম অনুসরণ করতে হবে ।
উদাহরণ: একটি আম বাগান করার জন্য ১০ মিটার দুরে দুরে সারি ও ১০ মিটার দূরে দূরে চারা/কলম রোপণ করা হলে এক হেক্টর জমিতে মোট কতটি চারার প্রয়োজন হবে ।
বা সারির সংখ্যা প্রতি সারিতে গাছের সংখ্যা
= ১০০০০ ব:মি: = ১০০ টি
১০০ ব:মি: ।
অর্থাৎ এক হেক্টরে ১০০টি চারা বা কলম রোপণ করা যাবে ।
(১) কুইনকাংশ বা পঞ্চম সংস্থান বা তারকাকৃতি পদ্ধতি: এ পদ্ধতিটি বর্গাকার পদ্ধতির একটি বিশেষ রূপ । বর্গাকার পদ্ধতির প্রতি চার কোণের চিহ্নিত স্থান হতে মূল রেখার উপর বা পরবর্তী সারিগুলোতে দুই গাছের চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে চিহ্নিত করতে হবে । অনুরূপভাবে মুক্ত রেখাগুলোর উপর প্রতি দুই সারির মধ্যবর্তী স্থানে চিহ্নিত করতে হবে । এখন মূল রেখা বা পরবর্তী সারিগুলোর মধ্যবর্তী স্থান এবং মুক্ত রেখার মধ্যবর্তী স্থানে চিহ্নিত করতে হবে । এখন মূল রেখা বা পরবর্তী সারিগুলোর মধ্যবর্তী স্থান এবং মুক্ত রেখার মধ্যবর্তী স্থান হতে সামনা সামনি দিকে রেখা টানলে বর্গক্ষেত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হবে । এই কেন্দ্র বিন্দু হলো পঞ্চম সংস্থান । কেন্দ্র বিন্দুর সংশ্যানকৃত গাছটিকে ফিলার বা পুরক বলে । বর্গাকার পদ্ধতিতে চারকোণে মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি গাছ লাগানো হয় এবং পুরক গাছটি স্বল্পমেয়াদি হিসেবে লাগানো হয়। যেমন- দীর্ঘমেয়াদি গাছ হলো আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, কামরাঙ্গা, তেঁতুল এবং স্বল্পমেয়াদি গাছ হলো লেবু, ডালিম, পেয়ারা, আতা, শরীফা, জাম্বুরা, কলা, জামরুল, করমচা, অরবরই ইত্যাদি । পূরক গাছগুলো যখন মধ্যম মেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদী গাছের সাথে আলো, বাতাস, খাদ্য উপাদান, পানি ইত্যাদির জন্য প্রতিযোগিতায় যাবে তখন পূরক গাছগুলো কেটে ফেলতে হবে । স্থায়ী গাছের দূরত্ব কমপক্ষে ৭ মিটার না হলে এ পদ্ধতি তেমন ফলপ্রসূ হিসেবে অনুশীলন করা যাবে না ।
কুইনকাংশ বা পঞ্চম সংস্থান পদ্ধতিতে জমিতে গাছের সংখ্যা নির্ণয় -
জমিতে মোট গাছের সংখ্যা = ( সারির সংখ্যা× সারিতে গাছের সংখ্যা) + পুরক গাছ
পূরক গাছ = (প্রধান সারিতে গাছের সংখ্যা - ১)×(সারির সংখ্যা -১)
উদাহরণ: কোন জমিতে ১২টি সারি তৈরি করে প্রতিটি সারিতে ১০টি করে চারা রোপণ করা হলে ঐ জমিতে পঞ্চম সংস্থান পদ্ধতিতে কতটি চারা রোপণ করা যাবে ।
জমিতে গাছের সংখ্যা = ( সারির সংখ্যা×সারিতে গাছের সংখ্যা) + পূরক গাছ
৪) ত্রিকোণী বা ত্রিভুজাকার পদ্ধতি: মূলরেখা তৈরি করে মূল রেখার উপর বর্গাকার পদ্ধতির ন্যায় গাছের দূরত্ব চিহ্নিত করতে হবে । এরপর দ্বিতীয় সারিতে জমির কিনারা হতে গাছের দূরত্বের পূর্ণ দূরত্বে চিহ্নিত করতে হবে।
এইভাবে পরবর্তী চিহ্নগুলো গাছের পূর্ণ দূরত্বে করতে হবে। এতে মূলরেখায় গাছের নির্ধারিত দুটি গাছের চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থান বরাবর দ্বিতীয় সারিতে গাছের চিহ্ন পড়বে । এ পদ্ধতিতে প্রতি একান্তর বা জোড়া সারিতে প্রথম সারির দুই গাছের মধ্যবর্তী স্থানে গাছ লাগানো হয় । এরপর প্রতি বেজোড় সারিতে বর্গাকার পদ্ধতির ন্যায় গাছ লাগানো হয় । এতে প্রথম বা মূলরেখার দুটি এবং একান্তর সারির একটি গাছের চিহ্ন যাগে করা হলে মাত্র একটি ত্রিভুজের সৃষ্টি করে । অনুরুপভাবে একান্তর বা জোড় সারির একটি গাছ তৃতীয় বা বেজোড় সারির দুটি গাছের চিহের সাথে যাগে করা হলে ত্রিভুজের সৃষ্টি করে । ত্রিভুজগুলো সমবাহু ত্রিভুজ হয় । ১ম, ৩য়, ৫ম বা বেজোড় সংখ্যক লাইনে বর্গাকার প্রণালিতে গাছ লাগানো হয় এবং ২য়, ৪র্থ, ৬ষ্ঠ বা জোড় সংখ্যক লাইনে বেজোড় লাইনের দুটি গাছের মধ্যবর্তী স্থানে গাছ লাগানো হয় । এ পদ্ধতিতে সারি হতে সারির দূরত্ব গাছ হতে গাছের দূরত্ব অপেক্ষা বেশি রাখা হয় । প্রতি এক সারি পর পর বা একান্তর সারিতে একটি করে গাছ কম হয় । এতে করে মোট জমিতে বর্গাকার পদ্ধতি অপেক্ষা গাছের সংখ্যা কমে যায় ।
ত্রিভুজাকার পদ্ধতিতে জমিতে মোট গাছের সংখ্যা নির্ণয় :
জমিতে মোট গাছের সংখ্যা = (প্রথম সারিতে গাছের সংখ্যা ঢ মোট সারির সংখ্যা)- একান্তর ক্রমিক (জোড় ) সারির সংখ্যা
৫। ষড়ভুজী পদ্ধতি: ষড়ভূজি পদ্ধতি একটি সমবাহু ত্রিভুজাকার পদ্ধতি । এখানে পাশাপাশি দুই সারির তিনটি গাছ মিলে একটি সমবাহু ত্রিভুজ তৈরি করে । পাশাপাশি তিন সারির ছয়টি গাছ মিলে একটি ষড়ভুজ তৈরি করে । এর কেন্দ্রস্থলে একটি গাছ থাকে । গাছের দূরত্ব নির্দিষ্ট রাখতে হলে সারি হতে সারির দূরত্ব কমিয়ে দিতে হয় । প্রকৃত পক্ষে ষড়ভুজ তৈরির সময় কিছুটা জটিল মনে হলেও গাছ লাগানো হলে দেখতে সুন্দর দেখায় । যে কোন দিক হতে তাকালে লাগানো গাছগুলো একটি সরল রেখায় দেখা যায় । একগাছ থেকে অপর গাছের দূরত্ব সমান থাকে । ফলে আলো, বাতাস, খাদ্য উপাদান, পানি ইত্যাদি সকল গাছ সমানভাবে পায় । আম, কলা, আপেল, পিচ, লেবু, পেয়ারা, নারিকেল কাজুবাদাম প্রভৃতি ফল গাছের চারা এই পদ্ধতিতে লাগানো হয় ।
ষড়ভুজী পদ্ধতিতে জমিতে চারা সংখ্যা নির্ণয়
জমিতে মোট চারার সংখ্যা = (মোট সারির সংখ্যা প্রধান বা প্রথম সারিতে গাছের সংখ্যা) - জোড় বা একান্তর ক্রমিক সারির সংখ্যা ।
উদাহরণ ও এক খণ্ড জমির দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার এবং প্রস্থ ৪০ মিটার । ৫ মিটার দূরে দূরে সারি এবং ৮ মিটার দূরে দূরে চারা রোপণ করা হলে ঐ জমিতে মোট কতটি চারা রোপণ করা যাবে ।
(৬) কন্টুর বা ঢাল এবং সিড়িবাঁধ পদ্ধতি পার্বত্য অঞ্চলে ঢাল এবং সিড়িবাঁধ নির্মাণ করে ঢালের আড়াআড়িভাবে ফলের চারা রোপণ করা হয়। জমিতে ঢাল ৩ শতাংশের বেশি এবং ১০ শতাংশের কম থাকলে সেখানে কন্টুর বা টাল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে জমির ঢাল অনুযায়ী সমান স্থানগুলোকে একই রেখা দ্বারা সংযোগ করে দেয়া হয়। যেখানে ভূমিক্ষয়ের সম্ভাবনা থাকে এবং সেচ দেয়া অসুবিধাজনক সেখানে এ পদ্ধতিতে গাছ লাগানো হয়। এখানে স্বাভাবিকভাবে লাগানো গাছের পারস্পরিক দূরত্ব কখনও সমান রাখা সম্ভব না ।
পাহাড়ের ঢাল ১০ শতাংশের বেশি হলে পাহাড় কেটে সমতল সিঁড়িবাধ তৈরি করা হয় এবং ঢালের সাথে আড়াআড়িভাবে সারি করে গাছ লাগানো হয় । এখানে প্রথম সারির দুটি গাছের মধ্যবর্তী স্থানে পরবর্তী সারিতে গাছ লাগিয়ে জমির ক্ষয়রোধ করা হয়। এর ফলে সিড়ি বাধ পদ্ধতিতে পানিসেচ ও ভূমি ব্যবস্থাপনা ঠিকমত করা যায় ও ভূমিক্ষয় রোধ করা যায়। এ কাজের জন্য ঢালের নিচের দিকে কিছুটা উঁচু করে আইল বা বাঁধ দিতে হয় ।
সকল প্রকার পদ্ধতিতেই গাছ লাগানোর স্থানে কাঠি বা গেজ দিয়ে চিহ্ন করতে হয়। গোজ তুলে দিয়ে ফল গাছের আকৃতি অনুসারে বিভিন্ন আকারের গর্ত খুড়ে পরিমাণ মত সার দিয়ে গর্ত পূরণ করতে হয় । সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে গর্ত পূরণ করে অন্তত ৩-৪ সপ্তাহ পরে ঐ গর্তে ফলের চারা রোপণ করতে হয় ।
ফল গাছ রোপনের জন্য নকশা বা রোপনের জন্য সঠিক দূরত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা অপর্যাপ্ত পরিসরে গাছ ভালোভাবে বাড়তে পারে না। ফল কম ধরে ও নিম্নানের হয়। গাছ কাছাকাছি হলে রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ সহজে বিস্তার লাভ করতে পারে । অন্যদিকে অধিক পরিসরে গাছ লাগালে মূল্যবান জমির অপচয় হয়, জমিতে বেশি আগাছা হওয়ার সুযোগ পায়, জমি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় ও ভূমির ক্ষয় হয়।
ফল গাছ লাগানোর নকশার সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ
বর্গাকার পদ্ধতি
সুবিধা
(১) এ পদ্ধতিটি তুলনামূলকভাবে সহজ। কেননা মাঠে নকশা প্রণয়নে কোন ঝামেলা হয় না ।
(২) বর্গক্ষেত্রের প্রতি কোণায় একটি করে গাছ লাগানো হয় । তাই প্রতিটি গাছ সমান দূরত্ব পায় এবং সহজে বেড়ে উঠতে পারে ।
(৩) স্বল্পমেয়াদি ও দ্রুতবর্ধনশীল ফল গাছের জন্য এ পদ্ধতি উপযোগী ।
অসুবিধা
(১) সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি এবং বর্ধনশীল ফসলসমূহ এ পদ্ধতিতে লাগানো বিশেষ উপযোগী নয় ।
(২) ফল গাছ লাগানোর কিছু কিছু নকশায় বেশি গাছ লাগানো যায় কিন্তু এ পদ্ধতিতে কম সংখ্যক গাছ লাগানো যায়।
(৩) গাছ গোলাকার ভাবে চতুর্দিকে বাড়ে ফলে বর্গক্ষেত্রের চার কোণায় লাগানো গাছ হতে বর্গক্ষেত্রের কেন্দ্র বিন্দু বা মাঝখানের জায়গা অব্যবহৃত থাকে ।
আয়তকার পদ্ধতি সুবিধা ও অসুবিধা বর্গাকার পদ্ধতির অনুরূপ
পঞ্চম সংস্থান পদ্ধতি
সুবিধা
(১) এ পদ্ধতিতে কোন নির্দিষ্ট জমিতে বর্গাকার বা আয়তকার পদ্ধতি অপেক্ষা বেশি সংখ্যক গাছ লাগানো যায় ।
(২) জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় ।
(৩) এ পদ্ধতিতে দীর্ঘমেয়াদি গাছের সাথে স্বল্পমেয়াদি গাছের সমন্বয় করা যায় ।
(৪) ফিলার গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায় ।
অসুবিধা
(১) দীর্ঘমেয়াদি গাছের সাথে স্বল্পমেয়াদি গাছের সমন্বয় করে না লাগানো হলে বাগান লাভজনক হয় না ।
(২) পঞ্চম স্থানের ও চার কোণার গাছের ফল বিভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করতে হয় ।
(৩) এক জাতীয় রোগ ও পোকামাকড় অন্য জাতীয় গাছে পরজীবী হতে পারে ।
ত্রিকোণী বা ত্রিভুজ পদ্ধতি
সুবিধা
(১) তিনদিক থেকে গাছের আন্ত পরিচর্যা সহজে করা যায় ।
(২) বাগান দেখতে সুন্দর দেখায় ।
অসুবিধা
(১) এ পদ্ধতিতে অন্যান্য পদ্ধতি অপেক্ষা গাছের সংখ্যা কম হয় ।
(২) নকশা করা কিছুটা ঝামেলাপূর্ণ ।
(৩) জমির অপচয় হয় ।
ষড়ভুজী পদ্ধতি সুবিধা
(১) এ পদ্ধতিতে এক গাছ হতে অন্য গাছের দূরত্ব সমান থাকে ।
(২) তিন দিক থেকে বাগানের গাছে আস্ত পরিচর্যা করা যায় ।
(৩) বর্গাকার পদ্ধতি অপেক্ষা ১৫% গাছ বেশি লাগানো যায় ।
(৪) এ পদ্ধতিতে লাগানো বাগান দেখতে সুন্দর দেখায় ।
অসুবিধা
(১) এ পদ্ধতিতে অন্যা পদ্ধতি (ভাকার বাদে) অপেক্ষা গাছের সংখ্যা কম হয় ।
(২) নকশা তৈরি কিছুটা ঝামেলাপূর্ণ ।
(৩) জমির অপচয় হয় ।
ঢাল বা সিড়ি বাধ পদ্ধতি
সুবিধা
(১) এ পদ্ধতিতে সুষ্ঠ নকশা প্রণয়ন করে গাছ লাগিয়ে ভূমির ক্ষয় কমানো যায় ।
(২) এ পদ্ধতিতে বর্গাকার পদ্ধতি অপেক্ষা দ্বিগুণ গাছ লাগানো যায় ।
(৩) গাছ লাগানোর জন্য রেখা তৈরির ফলে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে বিভিন্ন দিকে চলাফেরা করা যায় ।
(৪) উঁচু দিক হতে পাইপ দ্বারা নিচের দিকে সহজে সেচের পানি প্রবাহিত করা যায় ।
অসুবিধা
(১) এ পদ্ধতিতে অন্যান্য পদ্ধতি অপেক্ষা গাছের সংখ্যা কম হয় ।
(২) নকশা তৈরি কিছুটা ঝামেলাপূর্ণ ।
একক ও মিশ্র ফল বাগান তৈরির পরিকল্পনা
বাংলাদেশে বর্তমানে ৮২.৯০ লাখ হেক্টর জমি থেকে খাবার আসছে প্রায় ১৫ কোটির অধিক জনগাষ্ঠেীর । গত ত্রিশ বছরে জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়েনি । বর্তমানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করছে গড়ে ৯২৬ জন মানুষ । ফলে মাথা পিছু জমির পরিমাণ একদিকে যেমন কমে যাচ্ছে সেই সাথে কমছে চাষযাগ্য জমির পরিমাণও। অন্যদিকে মোট খাদ্য শস্যের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সে জন্য অতিরিক্ত খাদ্য ঘাটতি মেটাতে নির্ভর করতে হচ্ছে বিদেশি খাদ্য আমদানি এবং দাতা গোষ্ঠির সাহায্যের ওপর। অন্যদিকে আমাদের জনসংখ্যার প্রায় ৮০% নানান ভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে । মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ইত্যাদির মত দামি খাবার এই দরিদ্র জনগাষ্ঠেীর নাগালের বাইরে । তাই বেশি পরিমান ফল উৎপদান করে পুষ্টিহীনতা দূর করা সম্ভব । একজন মানুষের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থতার জন্য প্রতিদিন ৮৫ গ্রাম করে ফল খাওয়া প্রয়োজন । কিন্তু আমরা খাই মান ৫-৩৮ গ্রাম, যা প্রয়োজনরে তুলনায় অনেক কম । বাংলাদেশে বিভিন্ন রকমের ফলের প্রজাতি রয়েছে । ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের অন্যতম উৎস । মানুষের দৈহিক বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য ভিটামিন বা খাদ্য প্রান ও খনিজ লবণের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেশের ফল মৌসুমভিত্তিক । অধিকাংশ ফলই যেমন আম, কাঁঠাল, জাম, লিচু, আনারস এসব বৈশাখ জৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে পরিপক্ক হয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই এদের প্রাপ্যতা শেষ হয়ে যায় ।
দেশীয় অনেক অপ্রচলিত ও স্বল্প প্রচলিত ফল যেমন- কুল, আমড়া, আতা, আমলকী, বেল, জলপাই, সফেদা, ডালিম, কামরাঙ্গা, ডেউয়া, কদবেল, জাম্বুরা, কাউ, পেয়ারা, সরিফা ইত্যাদি বছরের বিভিন্ন সময় উৎপাদিত হয়ে থাকে । কাজেই প্রধান ফলের সাথে এসব অপ্রধান ফলের মিশ্র বাগান তৈরি করা গেলে এদিকে যেমন অল্প জমিতে। অধিক ফল পাওয়া যাবে তেমনি সারা বছর ফল ও পুষ্টি জোগানের মাধ্যমে দারিদ্র বিমাচেনেও তা সহায়ক হবে।
কিভাবে মিশ্র অঙ্গ বাগান তৈরি করবেন
মিশ্র ফল বাগান তৈরির আগে যে বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে তা হচ্ছে এ বাগান থেকে সারা বছরই যাতে কোন না কোন ফল সংগ্রহ করা যায় । বাড়তি আয় করা যায় এবং পারিবারিক পুষ্টি সরবরাহ করা যায় । এ জন্য আগাম, মধ্য ও নাবী জাত লাগিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ফল সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে । নিচের ছকে এ ধরনের কিছু জাত উল্লেখ করা হলো ।
মিশ্র বহুতর বাগান কি ?
মুলত মিশ্র বহুস্তর বিশিষ্ট বাগান হচ্ছে বিভিন্ন চাষযাগ্য বৃক্ষ, বিরুৎ ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ প্রজাতির বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ ৩-৪ স্তর বিশিষ্ট উলম্ব ক্যাপনাপি সহযোগে গঠিত উদ্ভিদগুলোর একটি নিবিড় সহাবস্থান ।
মিশ্র বহুস্তর বিশিষ্ট ফল বাগান কাঠামো
আমাদের দেশের ক্রমহ্রাসমান মাথাপিছু জমির কথা চিন্তা করে এই বহুস্তরী ফল বাগান তৈরির কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে । বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয় এই বহুত্তুরী মিশ্র (ফল) বাগানের প্রবর্তক। এখানে ফলদ ও বনজ গাছের সাথে উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের মিশ্র চাষের সমন্বয় ঘটানো হয়। এতে কয়েকটি স্তর বিশিষ্ট উলম্ব চাষ বিন্যাস রূপান্তরের মাধ্যমে বহুস্তর বিশিষ্ট ফল বাগান তৈরি করা হয়। এ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত বৃক্ষরাজি বিভিন্ন স্তর থেকে সূর্যালোক গ্রহন করে এবং এদের মূল বিভিন্ন গভীরতা থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে । ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের (আলো, পানি, পুষ্টি উপাদান) সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা পাবে ।
বাংলাদেশের জন্য উপযোগী বহুস্তর, বিশিষ্ট মিশ্র বাগান হতে পারে এরকম ভূমি সংলগ্ন লতাপাতা সমৃদ্ধ নিম্নস্তর, বৃক্ষ সমৃদ্ধ উপরের স্তর এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী স্তর নিয়ে বসতবাড়ির বহুস্তর বাগান ।
নিচের স্তরটিকে দুটি ভাগে ভাগ করে ১ মিটারের কম উচ্চতা বিশিষ্ট সর্ব নিম্ন স্তরে আনারস, তরমুজ, শাকসবজি ও ঔষধী গাছ এবং ১-৩ মি: উচ্চতায় কলা, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু ইত্যাদি চাষ করা যেতে পারে । ওপরের স্তরটি দুটি ভাগে ভাগ করে ২৫ মি: এর বেশি উচ্চতায় সুউচ্চ বা মন ফলবৃক্ষ যেমন- আম, কাঁঠাল, নারিকেল এবং ১০-১২ মি: উচ্চতায় মাঝারি উচ্চতার ফল যেমন- বামন আকৃতির আম, লিচু, সফেদা ইত্যাদি চাষ করা যেতে পারে ।
বহুতর বিশিষ্ট মিশ্র বাগানের জন্য উদ্ভিদ/ফসল নির্বাচন
বহুস্তর বিশিষ্ট মিশ্র বাগানের জন্য উদ্ভিদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে । বাগানের গাছ লাগানোর জন্য ছায়া পছন্দকারী বা ছায়া সহকারী উদ্ভিদ ফসল চিহ্নিত করতে হবে । নির্বাচিত বিভিন্ন ফসল/উদ্ভিদের সমন্বয় এমন হতে হবে যেন ফসল উৎপাদন চক্র এবং মাত্রা সারাবছর নিয়মিত উৎপাদন বজায় রাখতে পারে । আবহাওয়া ও জলবায়ুগত কারণে বছরে বিভিন্ন সময় ফসল সংগ্রহের পরিমান কম বা বেশি হতে পারে, কিন্তু প্রত্যেকটি কিছু না কিছু উৎপাদন যেন থাকে অর্থাৎ বছরের প্রায় সবসময়ই যেন ফলন এবং উপজাত হিসেবে জ্বালানি ও অন্যান্য উপকরন পাওয়া যায়। বহুস্তর বিশিষ্ট মিশ্র বাগানে উৎপাদিত সামগ্ৰী কৃষকের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে, অতিরিক্ত আয় নিশ্চিত করতে এবং অন্যান্য কৃষি ফসল হানিতে ও দু ফসলের মধবর্তী সময়ে কৃষককে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হবে ।
পারিবারিক সদস্যদের ন্যূনতম শ্রমের মাধ্যমেই যেন বাগানে ফসল পরিচর্যা ও ফসল সংগ্রহ সম্পন্ন করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাগান রচনার জন্য যে কোন নার্সারী থেকে চারা সংগ্রহ না করে সফল মাতৃগাছের বাগান থেকে বা বিশ্বস্ত নার্সারি থেকে চারা কলম সংগ্রহ করা উচিত ।
মিশ্র বহুতর বাগানের সুবিধা
এ ধরনের বাগান পদ্ধতিতে ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশের মতো ভূমি স্বল্পতার দেশে এ পদ্ধতির বাগান কৃষিতে এক যুগান্তগাকারী উৎপাদন ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে ।
ভূমি ছাড়াও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন- আলো, মাটির পুষ্টি উপাদান, পানি ইত্যাদির সর্বাধিক ব্যবহার এ পদ্ধতিতে সম্ভব । এ ধরনের বাগান পদ্ধতিতে চাষকৃত বিভিন্ন উদ্ভিদ উলম্বভাবে বিভিন্ন স্তর থেকে সূর্যালোক গ্রহন করে । আমাদের মোট যে সুর্যের আলো পৃথিবীতে আসে তার ২০-৩০ ভাগ ব্যবহার করে উপরের স্তরের ০-৪০ ভাগ ব্যবহার করে মধ্য স্তর অর্থাৎ বিরৎ এবং সর্ব নিম্ন স্তরে থাকে ছায়া পছন্দকারী উদ্ভিদ যা বাকি ২০-৩০ ভাগ সূর্যের আলো গ্রহণ করে ।
অন্যদিকে এদের মূলতত্র মাটির বিভিন্ন গভীরতা থেকে মৃত্তিকা পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে যেমন-ছায়া পছন্দকারী উদ্ভিদ যা মাটির ওপরের স্তর থেকে পুষ্টি নেয় । মধ্যম স্তরের উদ্ভিদ মাটির আরো গভীরে থেকে পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করে । এতে করে প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্যও রক্ষা হয়।
এ উৎপাদন পদ্ধতি আর্থিকভাবে কৃষকের জন্য ঝুঁকিমুক্ত । কেননা কোন কারনে কৃষক এক স্তরের ফসল প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হলেও অপরস্তর থেকে ফলন পায়। এছাড়াও বছরব্যাপি এ ধরনের বাগান থেকে অর্থ পাওয়া সম্ভব । কেননা একই জমিতে বিভিন্ন ফসল থাকায় বছরের বিভিন্ন সময়ে তা সংগ্রহ ও প্রয়োজনে বিক্রি করা যায় । এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সম্ভব। একই জমিতে বছরের প্রায় সব সময়ই বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের উপস্থিতি ফসল চাষের বহুমুখিতার পাশাপাশি ফসল তথা উদ্ভিদের বৈচিত্র্যতা আনায়ন করে । নিবিড় চাষ করা হয় বিধায় বসত বাড়ির মহিলারা বা বেকার যুবকরা উৎপাদন কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে, ফলে বেকার সমস্যা দূরীকরণের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নেও এ ধরনের বাগান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে ।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যাল প্রবর্তিত সফল বহুস্তর/মিশ্র বাগানের মডেলের উদাহরণ- নারিকেল বাগানে ৩ স্তর বিশিষ্ট ফসল চাষ : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ এই ৩ স্তর বিশিষ্ট মিশ্র বাগান তৈরি করেছে । এতে ১ম স্তরে আনারস/আদা/হলুদ, ২য় স্তরে কলা, লেবু, পেঁপে, পেয়ারা এবং ৩য় স্তরে নারিকেল গাছের সমন্বয়ে ৩ স্তর বিশিষ্ট বাগান তৈরি করা হয়, যা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক ।
চার বছর গবেষণার পর দেখা গেছে নারিকেল থেকে প্রতি বছর হেক্টর প্রতি ৪০,০০০/- টাকার মত আয় হতো। সেই একই বাগানের বহুস্তরী ফসল বিন্যাস (নারিকেল+কলা+আনারস/আদা/কছু) থেকে প্রায় ১,৩০,০০০/- হতে ১,৮০,০০০/- টাকার মতো আয় করা যায়।
আম বাগানে তিনস্তর বিশিষ্ট ফসল চাষ
আম বাগানে পেঁপে এবং আনারস ভালো জন্মে। আম বাগানে পেঁপে গাছের নিচে আনারস চাষ সফলভাবে সম্ভব হয়েছে । এতে আর্থিক লাভও প্রচুর ।
চার বছর গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রতি বছর শুধুমাত্র আম থেকে হেক্টর প্রতি ৮০ হাজার টাকার মতো আয় হয় । কিন্তু বহুস্তর বিশিষ্ট ফল বাগান (আম+পেঁপে+আনারস) থেকে আমের অনুৎপাদন মৌসুমে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং আমের উৎপাদন মৌসুমে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার মতো লাভ পাওয়া যায় ।
বহুস্তর বিশিষ্ট মিশ্র ফল বাগান পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা
সর্বাধিক ও সারা বছর ফল পেতে বহুতর বিশিষ্ট ফল বাগানের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। চারা রোপণ থেকে সর্বশেষ ফল/ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত সঠিক উদ্যানতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা আবশ্যক। গাছের নিয়মিত অঙ্গ ছাঁটাই, সার, সেচ, পানি নিষ্কাশন ইত্যাদি কাজগুলো সঠিকভাবে করা গেলে প্রতিটি গাছ থেকে ফল ও বিভিন্ন উপজাত সহ সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যাবে (ছক-২)।
ফল, জ্বালানি, আসবাবপত্র তৈরির কাঠ ও বহুবিধ কৃষি সামগ্রী পাওয়ার সাথে সাথে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য বসতবাড়িতে এবং ফলের বাগানে বহুস্তর বিশিষ্ট মিশ্র ফসল চাষ করা দরকার। উদ্ভাবিত মডেল বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের আম, পেয়ারা, সুপারি এবং লিচু বাগানে, পুর্বাঞ্চলের কাঁঠাল বাগানে এবং বাংলাদেশের বনাঞ্চলের জন্য অত্যন্ত উপযোগী ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ফল বাগান পরিকল্পনার বিবেচ্য বিষয় কী কী ?
২। ফল বাগানের জন্য কেন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ?
৩ । ফল গাছ লাগানোর পদ্ধতিগুলোর নাম লেখ ।
৪ । মিশ্র বহুস্তর বাগান কি ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ফল বাগানের জন্য কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় সে সম্পর্কে লেখ ।
২। ষড়ভুজী পদ্ধতিতে ফল বাগানের নকশা বুঝিয়ে লেখ ।
৩ । ফল বাগান পরিকল্পনার বিবেচ্য বিষয় সম্পর্কে লেখ।
৪ । ফল গাছ লাগানোর পদ্ধতিগুলোর নাম লেখ ।
৫ । পঞ্চম সংস্থান পদ্ধতির সুবিধা অসুবিধাগুলো লেখ ।
৬। বর্গাকার পদ্ধতির সুবিধা অসুবিধাগুলো লেখ ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ফল বাগান পরিকল্পনার নীতিমালা বর্ণনা কর ।
২। ফল গাছ লাগানোর নকশাগুলোর নাম লেখ। চারা রোপণের জন্য নকশা প্রণয়নের করণীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে আলাচনা কর ।
৩। বর্গাকার পদ্ধতি সম্পর্কে লেখা একটি আম বাগান করার জন্য ১০ মিটার দূরে দূরে সারি ও ১০ মিটার দূরে দূরে চারা রোপণ করা হলে ৫ হেক্টর জমিতে বর্গাকার পদ্ধতিতে কতটি চারা রোপণ করা যাবে ?
৪ । কুইনকাংশ প্রনালীর ব্যাখ্যা কর ।
৫ । একক অথবা মিশ্র বাগান তৈরির পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা কর ।
৬। ফল বাগানের গাছ রোপণ প্রণালির গুরুত্ব কী ? ফল বাগানের বিভিন্ন গাছ রোপণ প্রণালি বর্ণনা কর ।
বাগানে পরিমিত পরিমাণ ফলন পেতে হলে চারা রোপণের জন্য গর্ত করা এবং গর্তে পরিমাণ মত সার প্রয়োগ করা অপরিহার্য। চারা গাছ লাগানোর সময় নির্দিষ্ট আকারের গর্ত খনন করা আবশ্যক। তবে গর্তের আকার নির্ভর করে চারার আকার ও গাছের প্রজাতির ওপর। জমিতে গর্ত করার আগে চারা রোপনের প্রণালি মোতাবেক ফিতা বা মাপ কাঠির মাধ্যমে নির্ধারিত দূরত্বে খুঁটি পুঁতে চারা রোপণের জন্য স্থান চিহ্নিত করতে হবে । এরপর সঠিক স্থানে গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্ত খনন করে খননকৃত মাটি চার পাশে ছড়িয়ে রাখতে হবে । যেন গর্তের মাটি ভালোভাবে রোেদ শুকায়। চারা লাগানোর কম পক্ষে দু সপ্তাহ আগে গর্ত তৈরি করা উচিত । এতে করে গর্তের মাটি উন্মুক্ত থাকে এবং রোেদর তাপে জীবাণুসমূহ মারা যায় ও অনেক বিষাক্ত পদার্থ অপসারিত হয় । এর ফলে চারা লাগানোর পর রোপণজনিত ধকল সহ্য করে গাছ বেড়ে উঠতে পারে।
গর্তে সার প্রয়োগ
গর্ত তৈরির এক সপ্তাহ পরে গর্তের মাটির সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণ সার মিশিয়ে মাটি ও সারের মিশ্রন দ্বারা গর্ত পূরণ করতে হবে । প্রতি গর্তে সারের পরিমান নির্ভর করে মাটির উর্বরতা, গাছের প্রজাতি, গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ইত্যাদির উপর । সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত পূরণ করতে হবে। সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে গর্ত পূরণ করার পর গর্তে গাছ লাগানোর জন্য কমপক্ষে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে ।
ফল গাছ রোপণের জন্য গর্ত তৈরির কৌশল
বাগানে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ফলন পেতে হলে চারা রোপণের জন্য গর্ত করা এবং গর্তে পরিমাণ মত সার প্রয়োগ করা অপরিহার্য । চারাগাছ লাগানোর সময় পরিমিত আকারের গর্ত খনন করা আবশ্যক। তবে গর্তের আকার নির্ভর করে চারার আকার ও গাছের প্রজাতির ওপর ফল গাছের চারা রোপণের জন্য অন্তপক্ষে ৩টি কাজ করা আবশ্যক। যথা
(ক) সঠিক সময়ে ও সঠিক মাপে গর্ত খনন ।
(খ) গর্তে উপযুক্ত পরিমাণ সার প্রয়োগ ও
(গ) গাছের বৈশিষ্ট্য মোতাবেক চারা রোপণ ও পরিচর্যা ।
ক) গর্ত খনন: চারা রোপনের জন্য গর্ত খননের গভীরতা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মতামত আছে । গর্ত বর্গাকার ও অগভীর হলে চারার শিকড় কুন্ডলী পাকিয়ে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় । তবে যতদূর সম্ভব গর্ত যথেষ্ট গভীর ও চওড়া হওয়া বাঞ্চনীয় । চারা অবস্থায় শিকড় দুর্বল থাকে তাই গর্তের চারিপাশের শক্ত মাটিভেদ করে সহজে খাদ্য ও রস সংগ্রহ করতে পারে না। গর্তের আকার বড় করে এবং উপরের মাটি নিচে দিয়ে গর্ত ভর্তি করে দিতে হয় । এতে দুর্বল ও নরম মূলসমূহ নরম মাটি হতে সহজে রস নিয়ে তাড়াতাড়ি বড় হতে পারে । অনুর্বর মাটিতে এই পদ্ধতি অনুশীলন অত্যন্ত ফলপ্রসু । শুষ্ক ও বৃষ্টিপাতহীন অঞ্চলের মাটিতে শক্ত ও অপ্রবেশ্য স্তর থাকে । এক্ষেত্রে শক্তিশালী বিস্ফোরক ব্যবহার করে শকুন্তর ভেঙ্গে দিয়ে ভালভাবে গাছ জন্মানো যায় ।
বৃক্ষ জাতীয় গাছের জন্য ৫ ফুট ব্যাস ও ৪ ফুট গভীর করে গর্ত করা যায় । গর্ত খননের পর উপরের মাটি নিচে দিয়ে গর্ত পুরণ করতে হয়। এতে গাছের শিকড় খুব ভালোভাবে বিস্তার লাভ করতে পারে। বড় গর্তে রোপণকৃত গাছের শিকড় ১ বৎসরে ৭.৫ ফুট গভীরে এবং পাশে ৬ ফিট পর্যন্ত ছড়াতে পারে । অথচ ছোট গর্তে রোপণকৃত গাছের শিকড় ১ বৎসর ২ ফুটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
চারা রোপণের জন্য এক সপ্তাহ হতে প্রায় একমাস পূর্বে গর্ত খননে অনেকক্ষেত্রেই তেমন কোন গুরুত্ব বহন করে । বেশি আগে গর্ত খনন করে রাখলে গর্তের পাশের ও তলদেশের মাটি শক্ত হয়ে যায়। এরূপ ক্ষেত্রে চারা রোপনের আগে পুনরায় গর্ত খনন করে নিতে হয় ।
অনুর্বর মাটিতে গর্তের উপরের মাটির সাথে সার মিশিয়ে নিচে দিয়ে গর্ত ভরাট করা হলে গাছের তেজ বেশি হয় । কিন্তু চারার গোড়ার চারপাশে যদি নিয়মিত সারযুক্ত মাটি প্রয়োগ না করা হয়, তাহলে গাছের বৃদ্ধি আস্তে আস্তে কমে যায় ।
ফল গাছ রোপণের জন্য জ্ঞাত ভেদে গর্ত করার সময়
বর্ষাকাল অর্থাৎ মে থেকে জুলাই মাস জাত ভেদে সকল ধরনের চারা লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময় । চারা লাগানোর পর এ সময় সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না । বর্ষা বেশি হলে বর্ষার পরও চারা লাগানো যেতে পারে । মেঘলা দিনে বা বিকালের দিকে চারা লাগানো ভালো। পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে বসন্তের প্রথমে ও চারা লাগান যায় । জাতভেদে সকল ধরনের ফল গাছ রোপণের জন্য বর্ষার আগে অর্থাৎ বৈশাখ জৈষ্ঠ মাসে গর্ত - করা উত্তম । গাছের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ এবং শিকড়ের বৃদ্ধির জন্য গাছ রোপণের আগে গর্ত করা একান্ত প্রয়োজন । ভিন্ন ভিন্ন গাছের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বের এবং আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে । সাধারণত কোন গাছের জন্য কি আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে, তা নিম্নোক্ত বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে । যথা
ক) গাছের আকৃতি
খ) শিকড়ের গভীরতা
গ) শিকড়ের বিস্তৃতি
ঘ) চাষের মেয়াদকাল
ঙ) গাছের খাবারের চাহিদা ইত্যাদির ওপর
গাছের আকার, মৌসুম ও মাটি ভেদে গর্ভের আকার ও আয়তন
জমি তৈরি সম্পন্ন হলে রোপণ প্রণালি নির্বাচিত করে নির্দিষ্ট দূরত্বে গাছ লাগান উচিত। গাছ লাগানোর জন্য নির্বাচিত স্থানে গর্ত করা উচিত । গর্ত তৈরির জন্য নিম্নবর্ণিত ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবে ।
গর্ত তৈরির ধাপ : গর্ত তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যেমন- কোদাল, বেলচা, খুন্তি ইত্যাদি আগেই যোগাড় করতে হবে।
১) জমিতে গর্ত করার আগে চারা রোপণের নকশা মোতাবেক ফিতা বা কাঠির সাহায্যে মাপ দিতে হবে । মাপ দিয়ে নির্ধারিত দূরত্বে খুঁটি পুঁতে চারা রোপণের স্থান চিহ্নিত করতে হবে ।
২) চারা রোপণের ২০-৩০ দিন আগে গর্ত তৈরি করে প্রতি গর্তে পরিমাণ মত সার দিয়ে মাটি ভরাট করে দিতে হবে । গর্তের মাটি এমন ভাবে চেপে দেওয়া দরকার যাতে মাটি আলগা না থাকে ।
৩) যে সব জায়গায় উইপোকার আক্রমণের সম্ভাবনা থাকে সেখানে উইপোকা প্রতিরোধক ঔষধ ব্যবহার করতে হবে।
৪) গাছের আকৃতি বিবেচনা করে গর্ভের ব্যাস ও গভীরতা নির্ণয় করতে হবে। যেমন- (ক) ছোট আকারের গাছের জন্য গর্ভের ব্যাস হবে ৫০ সেমি এবং গভীরতা হবে ৫০ সে:মি: (খ) মাঝারি আকারের গাছের জন্য গর্তের ব্যাস হবে ৬০ থেকে ৭৫ সেমি এবং গভীরতা হবে ৬০-৭৫ সে:মি: (গ) বড় বা বৃক্ষজাতীয় গাছের জন্য গর্তের ব্যাস হবে প্রায় ১ মিটার এবং গভীরতা হবে প্রায় ১ মিটার ।
মাটির বুনট বুঝে গর্ভের আকার কম বা বেশি করা যেতে পারে। যেমন- বেলে দোঁআশ মাটির জন্য গর্তের আকার কিছুটা ছোট করা যেতে পারে। কেননা বেলে মাটিতে গর্ত বড় করা হলে চারিপাশের পাড় ভেঙ্গে গর্ত ভরাট হয়ে যেতে পারে। আবার এটেল বা এটেল দোআঁশ মাটির জন্য গর্ভের আকার কিছুটা বড় করা যেতে পারে । বক্ষ শ্রেণীর গাছের জন্য ৫ ফুট ব্যাস ও ৪ ফুট গভীরতাবিশিষ্ট গর্ত খনন করা যেতে পারে। বড় গর্তে রোপণকৃত চারার শিকড় ১ বছরে ৭.৫ ফুট গভীরে এবং পাশে ৬ ফুট পর্যন্ত ছড়াতে পারে। অথচ ছোট গর্ভে রোপণকৃত গাছের শিকড় ১ বছরে ২ ফুটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কারন ছোট গর্ভের চারদিকের শক্ত মাটির তুর থাকে।
৫) গর্ত খনন করার সময় গর্তের খননকৃত মাটি ছড়িয়ে রেখে শুকারে নেওয়া ভাল। গর্তের উপরিভাগে ১৫ সেমি দুইভাগ মাটি (ছবি 'ক' অংশ) একদিকে রাখতে হবে। অনুরূপভাবে গর্ভের নিচের দিকের ভাগ মাটি (ছবি 'খ' অংশ । অন্য দিকে রাখতে হবে । গর্ভের উপরের দিকের মাটিতে জৈব পদার্থ বেশি পরিমাণে থাকে ।
(৬) গর্তের উপরের মাটির সাথে প্রয়োজনীয় সার মিশানোর পর গর্ত ভরাট করার সময় উপরের অংশের মাটি নিচে দিতে হবে। আর নিচের অংশের আলাদা করে রাখা মাটি গর্তের উপরিভাগে দিতে হবে। জমির উপরিভাগের মাটি বেশি উর্বর । উপরের মাটি নিচে দিলে গাছ দ্রবত বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান তাড়াতাড়ি পাবে ।
গর্তে সার প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা
ফল গাছে সার প্রয়োগের মাধ্যমে পুষ্টি সরবরাহ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । অন্য গাছের চেয়ে ফল গাছে মাটি হতে প্রচুর খাদ্য ও পুষ্টি টেনে নেয় এবং এই পুস্টি ক্রমাগত কমার ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যায় । ফলে মাটির উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস পায়, ফলশ্রুতিতে ফলন কমে যায় ।
সব গাছের সমান পরিমাণ খাবার লাগেনা । আবার গাছের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন পরিমাণ পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন হয় । নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর ওপর ফল গাছের সারের মাত্রা নির্ভর করে ।
১। ফল গাছের ধরন ২ । গাছের আকার ও বয়স ৩ । ফলের জাত ৪ । গাছের বৃদ্ধির স্বভাব ৫ । গাছের বৃদ্ধির পর্যায় ৬ । আবহাওয়া ৭। উৎপাদন মৌসুম ৮। মাটির প্রকৃতি উর্বরতা শক্তি ৯ । সার ব্যবহার পদ্ধতি ১০ । চাষাবাদ পদ্ধতি ১১ । সেচ ব্যবস্থাপনা ১২। জমির ফসল বিন্যাস
সার ব্যবহারে গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় এবং ফলের উৎপাদন বেড়ে যায় কিন্তু মনে রাখা প্রয়াজোন যে ত্রুটিপূর্ণ সার ব্যবহারের ফলে গাছের ক্ষতিও হতে পারে । অসময়ে গাছে সার ব্যবহার কররে গাছের ফল ধারন ব্যহত হতে পারে । তাই সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে পরিমাণে সার ব্যবহার করা উচিত ।
গর্তে সার প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
গাছের (ছোট বা বড় আকৃতির ওপর নির্ভর করে ছকে (ছক-১) বর্ণিত ও অন্যান্য নিয়ম মোতাবেক গোবর বা কম্পাস্টে সার, হাড়ের গুড়া বা টিএসপি সার, ছাই বা এমপি সার মাটির সাথে মিশাতে হবে ।
চারার উপযুক্ত বৃদ্ধির জন্য গর্তে সময়মত সার ব্যবহারের ফলে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি তাড়াতাড়ি হয় এবং ফল ধরার পরিমান বেড়ে যায়। এছাড়া অসময়ে সার ব্যহার করা হলে সারের অপচয় হয় এবং গাছের ফল ধারণে অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করার পর মাটি শুকনা থাকলে হালকা সেচ দিতে হবে । ১০-১২ দিন পর গাছ লাগাতে হয় । কেননা সার প্রয়োগের পর পর চারা লাগানো হলে রাসায়নিক সারের বিক্রিয়ায় চারা মারা যেতে পারে। রাসায়নিক সার গর্ভের নিচের ৩০ সেমি. মাটির সাথে মিশানো উত্তম । গাছের আকার বিবেচনা করে হাড়ের গুড়ার পরিবর্তে তার অর্ধেক পরিমান টিএসপি এবং ছাই এর পরিবর্তে প্রতি কেজি ছাই এর জন্য ১০০ গ্রাম এমপি সার ব্যবহার করা যেতে পারে ।
ছক— ১ গাছের আকৃতির ওপর নির্ভর করে গর্ত তৈরির সময় সার প্রয়োগের পরিমাণ
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১ । ফল বাগানে চারা রোপনের জন্য গর্ত খনন এবং গর্তে পরিমাণমত সার প্রয়োগ অপরিহার্য কেন ?
২। চারা রোপনের জন্য গর্তের আকার কী কী বিষয়ে উপর নির্ভর করে ?
৩ । গর্তে সার প্রয়োগের মাত্রা কিসের উপর নির্ভর করে ।
৪ । চারা কলমের ফুল ভেঙে দেওয়া হয় কেন ।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ফল বাগানে গর্ত তৈরির কৌশল বর্ণনা কর ।
২ । ফল বাগান গর্ত খননের দূরত্ব ও গর্তের আকার আকৃতি কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভর করে লেখ ।
৩ । ফল বাগান গাছ রোপণের জন্য জাত ভেদে গর্ত করার সময় উল্লেখ কর ।
৪ । ফল বাগানে গর্তে সার প্রয়োগের মাত্রা কী কী বিষয়ের উপর নির্ভর করে লেখ ।
৫। কীভাবে চারা লাগানোর জন্য গর্ত করতে হয় আলোচনা কর ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ফল বাগানে গাছ লাগানোর জন্য গতকরণ ও সার প্রয়োগ সম্পর্কে লেখ ।
২ । ফল চাষে গর্ত তৈরির ধাপগুলো বর্ণনা কর ।
৩ । ফল বাগানে চারা রোপনের জন্য গাছের আকার, মৌসুম ও মাটি ভেদে গর্তের আকার ও আয়তন সম্পর্কে বর্ণনা করা ।
৪ । ফল চাষে গর্তে সার প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর ।
৫ । গর্তে সার প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি বর্ণনা কর ।
বর্ষাকাল অর্থাৎ মে- জুলাই মাস চারা লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময় । কারণ চারা লাগানোর পর এ সময় সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। বর্ষা বেশি হলে বর্ষার পরও চারা লাগানো যেতে পারে। মেঘলা দিনে বা বিকেলের দিকে চারা লাগানো ভালো । নার্সারি হতে চারা সংগ্রহ করে লাগাতে দেরি হলে ছায়ায় রেখে দেওয়া যেতে পারে ।
রোপণের জন্য চারা/কলমের বৈশিষ্ট্য
সতেজ চারা থেকেই সব সময় সবল ও পর্যাপ্ত ফলনের আশা করা যায় । কখনই দুর্বল, রোগাক্রান্ত চারা ভালো শেকড় গঠনের জন্য নির্বাচন করা উচিত নয় । কলম থেকে চারা বা বীজ থেকে চারা তৈরি করার পর দু' এক বছর নার্সারিতে পালন করা দরকার । নার্সারি থেকে তোলা চারা বেশ সবল ও দু তিন বছরের পুরানো হওয়া দরকার । চারা গাছ মূল জমিতে বসানোর আগে গাছের দূরত্ব ঠিক রাখা দরকার । যাতে গাছ বড় হয়ে পরস্পর লেগে না যায় । যে গাছ বড় হয়ে পাশে যতটা জায়গা দখল করে বিস্তার লাভ করে সেই গাছের জন্য ততটুকু জায়গা বা দূরত্ব রাখা প্রয়োজন । গাছের আকৃতি বা মাপ অনুযায়ী চারা বসানোর গর্তের মাপও বড় বা ছাট হবে।
রোপণের জন্য চারা/কলম নির্বাচনের সময় নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে ।
১। নির্বাচিত চারা/কলম সুস্থ, সবল ও সতেজ হতে হবে
২। চারা/কলম রোগ ও পোকার আক্রমণ মুক্ত হতে হবে ।
৩ । চারাটি/কলমটি স্বাভাবিক আকৃতির হতে হবে ।
৪ । চারা/কলমের কাণ্ড সোজা ও পাতা স্বাভাবিক সবুজ হতে হবে ।
৫। চারার/কলমের গোড়া সুঠাম হওয়া উচিত ।
৬। নার্সারি হতে সংগ্রহীত চারা দুই/তিন বছরের পুরনো হওয়া দরকার ।
৭ । চারার শিকড় দুর্বল হলে ছায়ায় ২/১ বছর পালন করে শিকড় শক্ত করে নিতে হবে ।
৮। নির্বাচিত স্থানের মাটির গুণাগুণ অনুসারে চারার প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে । যেমন- রাজশাহীতে আম, লিচু, সিলেটে কমলালেবু, আনারস ইত্যাদি ।
৯ । চারার গোড়ার মাটি ও মুল ভেজা থাকবে এবং প্রধান শিকড় অঞ্চল থাকবে ।
১০ । নির্বাচিত স্থানটি ছায়াযুক্ত হলে ছায়া সহ্যশীল চারা নির্বাচন করতে হবে ।
১১। চারার কাণ্ড সোজা হতে হবে এবং চারা কলম খুব বেশি বয়সের হবে না ।
বীজ তলা থেকে চারা/কলম উঠানো এবং কষ্ট সহিষ্ণুতা বাড়ানোর জন্য করণীয় বিষয়গুলো
বীজতলা হতে চারা উত্তোলনের জন্য অন্তত একমাস পূর্বে চারাকে সতর্ক করে নিতে হবে। যাতে চারাটি লাগানোর জন্য উঠানোর ঝুঁকি সহ্য করতে পারে। প্রথমে যে চারাটি ভুলতে হবে তার পাড়ার চারদিকে কতদূর পর্যন্ত এবং কি পরিমান মাটিসহ বল আকারে ভালো হবে তা আগেই চিহ্নিত করতে হবে। এরপর চিহ্নের চারদিকে না খুড়ে চারার বা বেশি চারা লাইনে থাকলে, লাইনের কেবল একদিকে অর্ধবৃত্তাকার ভাবে খুড়ে বা চারার অবস্থাভেদে দূরত্ব কম বেশি করে প্রধান শিকড়ের সাথে খাড়াভাবে গর্ত করতে হবে। এই গর্তটি সাধারনত চারার পোড়া হতে ১০ সেঃমিঃ দূর দিয়ে ৩০ সে:মি: গভীর পর্যন্ত হতে পারে। গর্তটি যথেষ্ট নিচে গেলে চারার প্রধান মূলটি পাশ দিয়ে খুড়ে বের করে কেটে দিতে হবে।
প্রধান মূল কাটার এ পদ্ধতিকে চারা খাসি করন বলে। যে স্থানে মুলটি কাটা হবে সেখানে সাধারণত ২.৫৪ সেঃমিঃ পরিমাণ কেটে সরিয়ে দিতে হবে। অতঃপর পতটি ঝুরে ঝুরে মাটি দিয়ে হালকাভাবে ভরাট করে দিতে হবে ।চারার প্রধান মূল কেটে সর্তকীকরনের পর প্রায় তিন সপ্তাহ কাল অপেক্ষা করতে হবে । এর মধ্যে মূলের কাটাস্থানের চারদিকে অনেক গুলো শিকড় পচ্ছাবে। চারা উঠানোর সময় চিহ্নিত স্থান বরাবর পূর্বে যেদিকে গর্ভ খুঁড়া হয়েছিল তার বিপরবীতে দিকে অনুরুপ ভাবে অর্ধবৃত্তাকার ভাবে পর্ত খুঁড়তে হবে । এভাবে দ্বিতীয়বার পত খুঁড়ার পর খুপরি বা অগারের সাহায্যে মাটির বলসহ চারা অনায়াসেই উঠানো যাবে। চারা বড় হলে মাটির বলের আকার বড় হবে এবং চারা ছোট হলে মাটির বলের আকার ছোট হবে। আবার বড় চারা বেশি দূরে নিতে হলে মাটির বলের আকার যতদূর সম্ভব ছোট করতে হবে। চারার প্রধান শিকড় পাছের বৈশিষ্ট্য এবং পাশে শিকড়ের বিস্তৃতির ওপর নির্ভর করেও বলের আকার ছোট বড় করতে হবে । সাধারনত বৃক্ষ জাতীর গাছের ২ থেকে ৩ বছরের চারার জন্য ২৫ থেকে ৩০ সে:মি: ব্যাস বিশিষ্ট এবং ২০ থেকে ২৫ সে:মি: গভীর মাটির বলই যথেষ্ট ।
যে সব চারার শিকড় খোলা বা পোড়ায় মাটি থাকবে না সেগুলো উঠানোর আগে কোদাল বা খুরপি দিয়ে মাটি আলগা করে নিতে হবে। এরপর সাবধানে চারা টান দিয়ে উঠাতে হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে চারার গোড়ার ছোট শিকড় গুলো যেন ছিড়ে না যায় বা নাড়া চাড়ায় লোমশ শিকড়গুলো শুকায়ে না যায় । ছেটি এবং লোমন শিকড় গুলোকে রক্ষা করতে হলে কাদামাটি দিয়ে শিকড় আবৃত করে দেওয়া যেতে পারে চারা দুরে স্থানান্তর করা হলে চারাগুলোকে ছায়াযুক্ত জায়গায় রাখতে হবে এবং খড়কুটা দিয়ে পোড়া ঢেকে হালকা সেচ দিতে হবে।
চারা উঠানো বা স্থানান্তরের সময় কোন শিকড় ভেঙ্গে বা দুমড়ে মুচড়ে গেলে তা কেটে দিতে হয়। চারার শিকড় যদি পাকানো বা কুণ্ডলী আকারে থাকে তাহলে কিছু কিছু শিকড় ছেটে দিয়ে লাগাতে হয়। অন্যথায় চারা লাগানোর পর মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
চারার কুণ্ডলী পাকানো শিকড় কেটে দেওয়া চারা লাগাতে দেরি হলে বা চারা দূরে স্থানাস্তর করতে হলে কতগুলো বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। যেমন চারার গোড়ার মাটির বল কলার শুকনো খালে, খড়, নাড়া, নারিকেলের শুকনো পাতা বা চট দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে। এমনকি শুকনো ঘাস জড়িয়েও বেধে দেওয়া যাবে। এতে চারার গোড়ার মাটির বল ভাঙার কোন সম্ভাবনা থাকে না এবং চারা বেশিদিন ধরে রাখা যায়।
চারা/করম রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা
প্রথমে চারা রোপণের জন্য স্থান চিহ্নিত করে নিতে হবে। তারপর চিহ্নিত স্থানে গর্ত করে সার মিশানো মাটি দিয়ে ভরাট করে প্রায় দু সপ্তাহ রেখে দিয়ে চারা লাগাতে হবে। পর্বের স্থানটি শনাক্ত করার সুবিধার্থে রোপণ তক্ষা/পান্টিং মার্তে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ তক্তার মাঝখানে ১টি এবং দু মাথায় ২টি ছিদ্র থাকে । গত তৈরির পূর্বে তার মাঝের ফুটোতে চারার স্থান নির্দেশক খুটি ঢুকায়ে তক্তা মাটিতে বসাতে হবে। এরপর তার দু মাধায় ছিদ্রে ২টি খুঁটি ঢুকিয়ে তা উঠায়ে মাঝখানের খুটির স্থানে গর্ত খোড়া যায়। চারা লাগানোর সময় খুটি দুটো তার দুপাশের ছিদ্র দিয়ে ঢুকালে মাঝখানের ফুটো দিয়ে চারার চিহ্নিত স্থান পাওয়া যাবে ।
চারা পর্কে রোপণের সময় সার মিশ্রিত মাটি গর্তে আগে থেকে যা ভরাট করে রাখা ছিল তা আলগা করে নিতে হবে। এরপর চারার শিকড় যতটুকু পাশে এবং গভীর বিস্তৃত ছিল পর্কে ততখানি বিস্তৃত ও গভীর দিয়ে আস্তে আস্তে ঝুর ঝুর মাটি চাপা দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন চারার গোড়া পূর্বে যতটুকু মাটির গভীরে ছিল এখানেও যেন ততটুকু গভীরে থাকে। চারা গর্ভে লাগানোর সময় কোন শিকড় উপরের দিকে উল্টায়ে থাকলে চারার বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। লাগানো চারার গোড়ার মাটি চারিপাশ থেকে সামান্য উঁচু করে দিতে হয় ।
কেনান চারার গাড়া নিচু হলে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা হতে পারে, যা ক্ষতিকর। আবার লাগানো চারার গোড়ার মাটির ভালভাবে চেপে না দিলে বৃষ্টির । পানিতে চারার গোড়া নিচু হয়ে যেতে পারে। ঝড়ে বা অন্য কোন কারণে চারা নড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে খুঁটি পুতে চারা বেঁধে দিতে হবে ।
চারা লাগানো পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত চারার যত্ন নিতে হবে। তাতে চারা তাড়াতাড়ি মাটিতে সহজে লেগে যেতে পারে । চারা লাগানো পর পরই প্রথম কিছুদিন ঝাঁঝরি দিয়ে চারার পোড়ায় হালকাভাবে সেচ দেয়া উচিত । লাগানো চারা নতুন অবস্থায় মাটি হতে রস শোষণ করে তার পাতার সাহায্যে যে বাস্পীভবন হয় তা সমতা রক্ষা করতে পারে । আর তাই পাতার সাহায্যে বাষ্পীভবনের চেয়ে রস শাষেন কম হলে চারা ঝিমিয়ে পড়ে । এমনকি পাতার বাষ্পীভবন হার নিয়ন্ত্রণ করা না হলে চারা মারা যেতে পারে। বাষ্পীভবন নিয়ন্ত্রণের জন্য চারার উপর ছায়ার ব্যবস্থা করা এবং গোড়ার মাটি শুকনো খড়কুটা দিয়ে ঢেকে দেওয়া যেতে পারে । এছাড়া পাতা কেটে কিছু কিছু ডাল ছেটে দিয়েও বাষ্পীভবনের হার কমানো যেতে পারে।
চির সবুজ (আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি) জাতীর গাছের চারা লাগানোর সময় প্রধান কাজ ছাড়া অন্যান্য ডাল পালা ও পাতা ছেটে দেয়া যায় । তবে ডালপালা ছাঁটার সময় ফল জাতীয় পাছের আকৃতিও বিবেচনা করতে হয়। চির সবুজ (আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি) জাতীয় পাছের চারা লাগানোর সময় প্রধান কাণ্ড ছাড়া অন্যান্য ডালপালা ও পাতা হেঁটে দেয়া যায়। তবে ডালপালা ছাটার সময় ফল জাতীয় গাছের আকৃতি ও বিবেচনা করতে হয়। রোপণের জন্য নির্বাচিত চারার শুধু একটি প্রধান কাঞ্চ রেখে অনেক সময় অন্যান্য ডাল পালা হেঁটে দেওয়া যেতে পারে। ফল সংগ্রহের সুবিধার জন্য ভূ-পৃষ্ঠ হতে অন্তত ৪৫ সে:মি: বা তার চেয়ে উপরে প্রধান কাজ কেটে দিতে হবে। প্রধান কাণ্ড বেশি লম্বা হলে সূর্যের ভাগে পুড়ে যেতে পারে। এ ধরনের কাওকে সূর্য পোড়া হতে রক্ষার জন্য কাগজ বা খড় কুটা দ্বারা জড়ায়ে বেঁধে দিতে হবে ।
অথবা চুনের গোলা দিয়ে লেপ দিতে হবে । খড়কুটার চেয়ে চুনের গোলা ব্যবহার করা উত্তম । কেননা খড়কুটায় উই পোকার আক্রমণ হতে পারে। চারা রোপণের অব্যবহিত পরে কয়েকদিন চারার গোড়ায় ঝাঝরি দিয়ে পানি দেওয়া উচিত। চারার গোড়ার শুকনা খড় দিয়ে ঢেকে দিলে রস সংরক্ষণ হয় এবং উপরে ছায়ার ব্যবস্থা করলে উপকার হয়। চির সবুজ জাতীয় গাছের চাইতে পাতা ঝরা (বেল, আফা, শরিফা, আমড়া ইত্যাদি) জাতীয় পাছের চারা উঠানোর পর দেরিতে লাগালেও তেমন অসুবিধা হয় না।
চারার গোড়ার মাটি যাতে শক্ত হতে না পারে সে জন্য মাঝে মাঝে নিড়ানী দিয়ে আলগা করে ঝুরঝুরে করে দিতে হয়। চারার গোড়ার চারিদিকে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হয়। বিশেষ করে অগভীর মূলবিশিষ্ট চারার জন্য এক মৌসুমে ঘন ঘন পানি সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয়।
নারিকেল গাছের জন্য পানির প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। পানি সেচের তেমন সুযোগ না থাকলে চারার পাড়ার মাটি মালটিং করে শুকনো ঘাস বা খড়কুটা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে । ভাতে অনেকদিন ধরে মাটিতে রস সংরক্ষণ হবে।
কলমের চারায় অনেক সময় নতুন অবস্থায় ফুল আসে, চারার গোড়া হতে নতুন ডালপালা গজায়। গাছের প্রকৃতি বুঝে ডালপালা ছেটে দিতে হয়। নতুন অবস্থায় চারাগাছে ফুল আসলে পাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই এসময় ফুল ভেঙে দিতে হয়। দুই তিন বছর পর্যন্ত চারার কলমের ফল ভেঙে দিতে হয়।
চারা লাগানোর সাথে সাথেই চারার সমান্তরাল করে পাশই একটি খুঁটি পুঁতে রশি দিয়ে চারাটি বেঁধে দিতে হবে । এর ফলে ঝড়ো বাতাস, বৃষ্টিপাত বা গরু ছাপলের ধাক্কায় চারাটি কাত হয়ে পড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না ।
পাছে সার প্রয়োগ করা যায়। সার দেয়ার পর মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। গর্ভ বা নালা করা হলে তা সারমিশ্রিত মাটি দিয়ে ভরাট করে দিতে হবে। সার দেয়ার পর হালকা পানি দেয়া উচিত। তাহলে সার থেকে খাদ্য উপাদান গাছ সহজেই গ্রহণ করতে পারবে।
ছক: চারা লাগানোর পর থেকে উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত গাছ প্রতি জৈব সারের পরিমাণ (কেজিতে)
গাছের আকৃতি | রোপণের এক বছর পর গোবর সার | প্রতি বছর বাড়াতে হবে গবর সার | ১৫ বছর পর গোবর সার |
১। বড় গাছ | ১০ | ১০ | ২৫ |
২। মাঝারি গাছ | ৫ | ৭ | ২০ |
৩। ছোট গাছ | ৫ | - | - |
৪। খুব ছোট গাছ | ২ | - | - |
সাধারণত চারা রোপণের পূর্বে গর্ভে যে পরিমাণ সার দেয়া হয় তার অর্ধেক পরিমাণ সার বর্ষার শুরুতে একবার এবং বর্ষার শেষে বাকি অর্ধেক দিতে হবে। পরবর্তীতে চারার বৃদ্ধির সাথে সাথে বৎসরওয়ারী সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে । এভাবে চারা লাগানার পর হতে ফলবান হওয়া পর্যন্ত যত্ন নিতে হবে, যাতে গাছ সুস্থ, সবল ও সতেজ থাকে।
সার প্রয়োগের সময় চারার একেবারে গোড়ায় সার দেওয়া উচিত নয়। চারা বা ছোট গাছের ক্ষেত্রে চারার গোড়া বা কমপক্ষে ০.৫ মিটার ও বড় গাছের ক্ষেত্রে ১ মিটার দূর দিয়ে সার ব্যবহার করতে হবে। তবে সাধারণত চারা পাতা যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে ঠিক ততদূর পর্যন্ত দূর দিয়ে সার দিতে হবে । কারণ পাতার বিস্তৃতির সাথে সাথে শিকড়ের বিস্তৃতির একটা সম্পর্ক আছে । শুধু মাটির উপর সার দিলে সারের অপচয় হবে । তাই দুপুর বেলায় যত গাছের ছায়া পড়ে ততদূর দিয়ে বৃত্তাকারে দাগ দিয়ে নিয়ে সেটুকু স্থানের মাটি আলগা করতে হবে । মাটি আলগা করার সময় কোদালন বা খুরপি ব্যবহার করতে হবে । চারার চারিদিকে বৃত্তাকারভাবে ঘুরে ঘুরে মাটি আলগা করতে হবে । এতে চারার শিকড় কম কাটার সম্ভাবনা থাকে । এছাড়া স্থানে স্থানে গর্ত করে বা চিকন চিকন নালা কেটে রাসায়নিক সারের ক্ষেত্রে টি এসপির পরিবর্তে হাড়ের গুড়া সার এবং এমপির পরিবর্তে ছাই ব্যবহার করা যেতে পারে । তবে এক্ষেত্রে টিএসপি সার যে পরিমাণ ব্যবহার করা হয় তার দ্বিগুণ পরিমাণ হাড়ের গুড়া সার ব্যবহার করতে হবে । আর এমপি সার যে পরিমান ব্যবহার করা হয় তার আটগুন পরিমান ছাই ব্যবহার করতে হবে । সারের মোট পরিমাণ কে দুই ভাগে ভাগ করে একভাগ গ্রীষ্মের শুরুতে এবং একভাগ বর্ষার শেষে প্রয়োগ করা ভালো ।
ছক: চারা লাগানোর পর থেকে উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত গাছপ্রতি রাসায়নিক সারের পরিমাণ (গ্রাম) ।
ইউ = ইউরিয়া, টিএসপি = ট্রিপল সুপার ফসফেট এমওপি মিউরিয়েট অব পটাশ
অঙ্গ ছাঁটাই: বেশির ভাগ বৃক্ষজাতীয় ফল গাছের চারা অবস্থায় কিছু কিছু অঙ্গা ছাঁটাই করার প্রয়াজন হয় । চারা অবস্থায় ছাঁটাই করা হলে চাহিদা মোতাবেক গাছের আকৃতি সুগঠিত ও সুন্দর করা যেতে পারে । কলমের চারার ক্ষেত্রে অঙ্গ ছাঁটাই বিশেষভাবে উপকারী । অনেক সময় বয়স্ক গাছের অঙ্গও ছাটাই করার প্রয়োজন পড়ে । যেমন কুল, পেয়ারা, লিচু, কাঁঠাল, গাছ এর উপযুক্ত উদাহরণ । মূলত অঙ্গ ছাঁটাই বলতে গাছের অপ্রয়োজনীয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে গাছ বড় হলে সমস্যা হতে পারে এমন অংশ কেটে বাদ দেওয়াকে বুঝায় । অঙ্গা ছাঁটাই করা হলে ফলন বাড়ে এবং গাছকে সুন্দর দেখায় । ঘটাই এর সময় চারা গাছের ছোট ছোট অংশ/ডালপালা হেঁটে ছোট করে দেওয়া হয় । কোন গাছের একই সাইজের দুটো ডালের মধ্যে যদি একটি অপেক্ষা আরেকটি বেশি ছাঁটাই করা হয় তাহলে বেশি ছাঁটাই করা ডালটি কম বাড়ে! গাছের আকৃতি সুন্দর ও ফল বেশি হওয়ার জন্য অনেক সময় ডালপালা ছাঁটাই করে কমিয়ে দেওয়া হয় । ছাঁটাই এর সাথে ফল উৎপাদনের সরাসরি সংযোগ আছে । অনেক ফলবতী গাছে বেশি ছাঁটাই করা হলে দীর্ঘদিন ধরে ফলন কম হবে । তাই গাছ বিশেষে সতর্কতার সাথে সঠিকভাবে ছাঁটাই করতে হবে । লতানো গাছে ফলন বৃদ্ধি ও সঠিক আকার দেওয়ার জন্য ঘটাই অপরিহার্য । আঙ্গুরের মত লতানো ফল গাছকে ছেটে মাচায় দিলে বেশি ফলন দেয়। এছাড়া অনেক সময় বড় গাছের ডাল ঘেঁটে ছোট করে রাখলে ফল পাড়তে, যত্ন নিতে ও মাধ্যমিক পরিচর্যার সুবিধা হয় । কিছু কিছু চারা গাছ লাগানোর পর প্রধান কাণ্ড বা ডগা তাড়াতাড়ি বেড়ে লম্বা হয় এবং ডালপালা কম হয় বা আদৌ হয় না । এসব ক্ষেত্রে প্রধান কাণ্ড বা ডগা কেটে দিলে ডালপালা গজিয়ে ঝাঁকড়া হয়, যা ফলন বৃদ্ধির জন্য সহায়ক । গাছের ভারসাম্য রক্ষার জন্য চারদিকে সমদূরত্বে তিন থেকে পাঁচটি ডাল রাখলে ভালো হয় । বড় গাছের ভেতরের ছোট ছোট ডালে ফল কম হয় এবং গাছের ভিতরে বাতাস ও রোদ চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি করে । গাছের কাণ্ড মজবুত করা এবং ফলন বাড়ানোর জন্য চারা লাগানোর দুই তিন বছরের মধ্যে প্রধান কাণ্ডের সাথে পাশের ডালের বিন্যাস ঠিক করে হেঁটে দিতে হয় । যেমন- রোগাক্রান্ত ও দুর্বল ডাল সব সময় হেঁটে দিতে হয় । কেননা রোগাক্রান্ত ডাল থেকে সব সময় রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে ।
মুল ছাঁটাই: কখনও কখনও গাছের মূল ছাঁটাই করে উপকার পাওয়া যায় । বর্ষার শেষে গাছের চারিপাশে মাটি চাষ করে বা কোপায়ে দিলে মূল ছাঁটাই এর কাজ অনেকটা হয়ে যায় । গাছের গোড়া হতে ১ থেকে ৩ মিটার দূর দিয়ে হালকা করে নালা কাটা হলে মুল ছাঁটাই হয়। নালাটি গাছের চারিপাশ দিয়ে সম্পূর্ণ চক্রাকারে- বর্গাকারে, এক চতুর্থাংশ চক্রাকারে বা বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের, প্রস্থের ও বিভিন্ন গভীরতার হতে পারে । এছাড়া গাছের গোড়া হতে কিছু । দূরে স্থানে স্থানে গর্ত করলেও মূল ছাঁটাই এর কাজ হয় । যে সব গাছের দৈহিক বৃদ্ধি বেশি সে সব গাছের মুল ছাঁটাই করা হলে ফল বেশি ধরতে সাহায্য করে ।
স্থানান্তরকালীন পাতা ছাঁটাই- বীজতলা বা হাপর হতে চারা স্থানান্তরের সময় চারার মুল ক্ষতিগ্রস্ত হয় । এতে মূলের সাহায্যে রস গ্রহন ও পাতার সাহায্যে প্রশ্বেদনের সামর্থ থাকে না এবং চারা মারা যেতে পারে । এ জন্য বীজতলা হতে চারা উঠানোর আগেই কিছু পাতা হেঁটে কমায়ে দিলে গাছ বাঁচানো সহজ হয় ।
ফুল ও ফল পাতাল করা: গাছে খুব বেশি ফুল আসলে কিছু কিছু ফুল ভেঙে দিতে হয় । তাতে অন্যান্য ফুলে পরিপূর্ণতা লাভে সহায়ক হয় । অতি ছোট গাছে ফুল হলে তা ভেঙ্গে না দিলে ফল হলে গাছ দুর্বল হয় । অনেক সময় গাছে বেশি ফল ধরলে ফলের আকার ছোট হয় এবং গুনগত মানও কমে যায় । এক্ষেত্রে ফল কিছু কিছু পাতলা করে দিলে অন্যান্য ফলগুলো আকারে বড় হয় এবং মানসম্মত গুণাগুণ বজায় থাকে।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১ । আমাদের দেশে চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় কখন ?
২। চারা রোপণের পর ছায়া প্রদান করা হয় কেন ?
৩। চারা গাছের ডাল পালা কেন হেঁটে দিতে হয় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১ । বাগানে কী ভাবে চারা/কলম রোপণ করতে হয় আলোচনা কর ।
২ । বীজ তলা থেকে চারা/কলম উত্তোলনের পদ্ধতি বর্ণনা কর
৩ । বীজ রোপণের পর থেকে চারা তালোর আগ পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ ।
৪ । বাগানে রোপণের পূর্বে ফলের চারা/কলমের কষ্ট সহিষ্ণুতা বাড়ার কৌশল বর্ণনা কর ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ফল বাগানে চারা রোপণ ও পরবর্তী পরিচর্যাসমূহ বর্ণনা কর ।
২ । বীজতলা থেকে ফলের চারা/কলম উত্তোলনের জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় ব্যাখ্যা কর ।
৩ । বীজ তলা থেকে চারা/কলম উঠানো এবং কষ্টসহিষ্ণুতা বাড়ানোর জন্য করণীয় বিষয়গুলো উল্লেখ কর ।
মানুষের ক্ষেত্রে যেমন বলা হয় পানির আর এক নাম জীবন, গাছ পালার ক্ষেত্রেও বচনটি সমান ভাবে প্রযোজ্য । গাছ শিকড়ের সাহায্য মাটিতে সংরক্ষিত প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে। গাছ কঠিন কোন খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করতে পারে না। পানির সাহায্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য গুলিয়ে তরল অবস্থায় গ্রহণ করে । পানির সাহায্যে গাছ সমস্ত খাদ্য বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পাঠাতে সক্ষম হয়। পানির অভাব থাকলে গাছ খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করতে পারে না । গাছকে তখন উপবাস থাকতে হয়। পানির অভাব গাছ বাড়তে পারে না। আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানিও গাছের জন্য ক্ষতিকর । মাটিও অতিরিক্ত পানি ধরে রাখতে পারে না। অতিবৃষ্টির সময় অতিরিক্ত পানি মাটির উপর দিয়ে গড়িয়ে নদীনালায় খাবার সময় গাছের অনেক খাদ্য গলিয়ে ধুয়ে নিয়ে যায়। মানুষ যেমন পানিতে ডুবে শ্বাস বন্ধ হয়ে অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় । গাছের শেকড়ও তেমনি ভাবে পানিতে ডুবে শ্বাস বন্ধ হয়ে অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় । মাটিতে রসের অভাব হলে খরা মৌসুমে গাছে পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে । গাছের প্রকার ভেদে পানির চাহিদা সমান নয় । তাই কোন ধরনের গাছ কত দিন পর কি পরিমাণ সেচ দিতে হবে তা অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। পক্ষান্তরে বর্ষাকালে কোন অবস্থায় যেন গাছের গোড়ায়, বেড়ে, টবে/পলিব্যাগে সংরক্ষিত চারার গোড়ায় পানি জমে না থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে । সুতরাং পানির অভাব হলে গাছে পরিমাণ মতো পানি দেওয়া আর অতিরিক্ত পানি থাকলে মাটি থেকে তা সরিয়ে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন । সেচ হলো পানির অভাব হলে গাছে কৃত্রিম উপায়ে পানি সরবরাহ করে চাহিদা পূরণ করা । আর নিষ্কাশন হলে অতিরিক্ত পানি সরিয়ে দিয়ে গাছের জন্য উত্তম পরিবেশ সৃষ্টি করা। গাছের জন্য উভয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
ফল গাছে পানি সেচের গুরুত্ব
কৃষি কাজের জন্য অন্যতম এবং অপরিহার্য উপাদান হল পানি। বাংলাদেশের শস্য (ফলসহ ) উৎপাদন মৌসুমী জলবায়ু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । শীতকালে এদেশে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে । ফসলের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য মৃত্তিকাস্থ উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানসমূহ অপরিহার্য । পানি মৃত্তিকাস্থ খাদ্যোপাদানসমূহকে দ্রবীভূত করে গাছের বিভিন্ন অঙ্গে সঞ্চালন, অংগার আত্মীকরণ, শস্যের সজীবতা সংরক্ষণ, প্রয়োজনীয় হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সরবরাহ প্রভৃতি কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাটিতে পর্যাপ্ত রসের অভাব হলে গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয় । বাংলাদেশে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত অধিক হলেও এটি বার মাস সমভাবে বিস্তৃত নয় । উদ্ভিদের জন্য পানি একটি অত্যাবশীকীয় উপাদান। যখনই পানির অভাব ঘটে তখনই ঘটে অত্যাবশ্যকীয় উদ্ভিদে নানারূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘ সময় পানির অভাব হলে গাছ মারা যেতে পারে। মাটিতে যখন গাছের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সহজলভ্য অবস্থায় থাকে না, তখন কৃত্রিম উপায়ে পানি সরবরাহ করাকেই সেচ বলে । গাছে কখন কিভাবে কতটুকু সেচ দিতে হবে তা ঐ গাছের বিভিন্ন অবস্থা, আবহাওয়া ও মাটির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মত একটি অতি জনবহুল দেশের সীমিত জমিতে উৎপাদ বৃদ্ধির জন্য একর প্রতি ফলন এবং ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি অপরিহার্য । আবার উচ্চ ফলনশীল আধুনিক উন্নত জাতের ফসল চাষাবাদ সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া সম্ভব নয় । তাছাড়া অনাবৃষ্টি, অল্পবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টিপাত ইত্যাদি কারণে ফসলের ক্ষতি এড়াতে হলে সেচ ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই । শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ করতে হলে তা হবে সম্পূর্ণ সেচ নির্ভর । এমনকি বর্ষা মৌসুমেও সাময়িক অনাবৃষ্টি এড়িয়ে সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে হলেও সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে । এসব কারণে বাংলাদেশে সেচের গুরুত্ব অপরিসীম।
ফল গাছের পানি নিষ্কাশনের গুরুত্ব
ফসলের জমিতে বা ফলের বাগানে পানি সেচ দেয়া যেমন দরকার তেমনি অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাকরণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । কোন কোন ফলদ গাছে যেমন-পেঁপে, আনারস, কাঁঠাল, তরমুজ, কলা ইত্যাদি পানির প্রতি বেশি সংবেদশীল অর্থাৎ এসব গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে গাছের খুব ক্ষতি হয় । এমনকি গাছ মারা যেতে পারে। তাই কাঁঠাল বাগানে কোন গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে তা সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। সুন্দর ভাবে পানি নিষকাশনের জন্য বাগানের চারদিকে নিকাশন নালা থাকা আবশ্যক যে সেচের অতিরিক্ত পানি বা অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে অতিরিক্ত পানি অনায়সে বের হয়ে যেতে হয় । ফসলের সর্বাধিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে শিকড়ের পরিবেশকে প্রয়োজনীয় সরস অবস্থায় রাখাই নিষ্কাশনের প্রধান উদ্দেশ্য । এছাড়া ফসলের জমি থেকে অতিরিক্ত পানি অপসারন করা হলে গাছের শিকড়ের সহজ বৃদ্ধি, ক্ষতিকর দ্রব্য হ্রাস, আহরণযোগ্য নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি, সময়মত চাষাবাদ ও উপকারী অনুজীবের কার্যকারিতা ইত্যাদি বৃদ্ধি পায় ।
ফল গাছে পানি সেচের সময় ও পানির পরিমাণ
জমিতে বা ফলের বাগানে কখন সেচ দিতে হবে এবং কী পরিমাণ সেচ দিতে হবে এ দুটি প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ সেচের পানি প্রদানের লক্ষে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে
উলেখিত বিষয়গুলো বিবেচনার জন্য মৃত্তিকা, উদ্ভিদ, আবহাওয়া, সেচের পানির উৎস ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত উপাত্ত ও তথ্যাদির প্রয়োজন ।
মৃত্তিকার যে সব তথ্যাদি বিশেষ ভাবে জানা ও বিশেষণ আবশ্যক সেগুলো হচ্ছে মাটির বুনট, গভীরতা, সংযুক্তি, লবণাক্ততা বা ক্ষারত্ব, বায়বীয়তা, নিষ্কাশন, অনুপ্রবেশ, অনুস্রবণ, চুয়ানো, ভূ-গর্ভস্থ পানি তলের গভীরতা এবং পানি ধারন ক্ষমতা ইত্যাদি ।
উদ্ভিদ সম্পর্কিত জরুরি তথ্যাদি হচ্ছে ফসলের প্রকার, শেকড়ের বৈশিষ্ট্য, বর্ধনের সময়ে বিভিন্ন ধাপে পানির ব্যবহার, মৃত্তিকায় পানি স্বল্পতার কারণে উদ্ভিদের যে ধাপ সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইত্যাদি ।
আবহাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে চাষাবাদের ঐতিহ্যগত পদ্ধতি বীজ বপন অথবা চারা রোপণের তারিখ, গাছের ঘনত্ব, সারির দূরত্ব, সার ব্যবহার, আগাছা অথবা পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ।
উদ্ভিদের ক্ষরা সহনীয়তা বলতে বোঝায় মৃত্তিকাস্থ শিকড় অঞ্চলে যে পরিমাণ সঞ্চিত পানি (%) গাছ ব্যবহার করলে গাছের বিশেষ কোন ক্ষতি হয় না। অধিকাংশ ফসলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, গাছ মৃত্তিকায় সঞ্চিত পানির ৫০% ব্যবহার করার পরে যদি সেচ দেয়া হয় তা হলে ফসল উৎপাদনের মাত্রা কমে যায় না । এ ক্ষেত্রে সেচ কে বলা হয় মৃত্তিকাস্থ প্রাপ্য পানির ৫০% কমতিতে সেচ প্রদান । কোন কোন ফসলের ক্ষেত্রে ৭৫% পানি কমতিতে ও ফসলের উৎপাদনের ক্ষতি হয় না। তবে ৫০% মাত্রাকেই সাধারন সেচের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে । তিনটি প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে সেচের সময় ও পরিমাণ নির্বাচন করা যায় যথা-
ক) মৃত্তিকা সম্পর্কিত খ) উদ্ভিদ সম্পর্কিত গ) আবহাওয়া সম্পর্কিত
ক) মৃত্তিকা সম্পর্কিত:
পদ্ধিতে প্রধানত মাটিতে পানির প্রাপ্যতা মাপা হয় । জমি থেকে মাটির নমুনা সগ্রহের সময় মনে রাখতে হবে যেন এই নমুনা যে জমি থেকে মাটি নেয়া হবে মোটামুটি ভাবে সেই জমির মাটির প্রতিনিধিত্বমূলক হয় । এক্ষেত্রে অনুভব পদ্ধতি এবং অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাটিতে পানির প্রাপ্যতা নির্ধারন করা যায় ৷
১ । অনুভব পদ্ধতি (Feel method) - এ পদ্ধতিতে মৃত্তিকার অবস্থা দেখে এবং স্পর্শ করে মৃত্তিকার পানির পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা করা হয় । মৃত্তিকার পানি ধারণ বা রসের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য ফসল ভেদে ৩০-১০০ সে:মি: নিচ থেকে অথবা সংশিষ্ট ফসলের শিকড়ের গভীরতার ৬০-৭০% নিচ থেকে মাটি খুঁড়ে মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয় । সংগৃহীত নমুনা থেকে এক মুঠো মাটি হাতের মুঠিতে চেপে বল বানানো হয় এবং স্পর্শের অনুভূতি ও অবস্থা সারণি-১ প্রদত্ত অবস্থার সাথে তুলনা করে পানি সেচের উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা যায় ।
হাতের সাহায্যে মৃত্তিকার পানি পরিমান পদ্ধতি ও সেচের সময় নির্ধারণ
সারণি-১
খ) উদ্ভিদ সম্পর্কিত পদ্ধতি
উদ্ভিদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেও সেচের প্রয়োজনীয়তা যায়। যখন মৃত্তিকা পানির পরিমাণ কমে যায় তখন গাছের পাতার রং বদলে যেতে পারে (যেমন- সবুজ থেকে হলুদ বর্ণ ধারণ), পাতা কুঁকড়িয়ে যেতে পারে । এ ছাড়াও গাছের বৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে। কোন উদ্ভিদের এ জাতীয় উপসর্গ সেচের আবশ্যকতা নির্দেশ করে । তবে এই পদ্ধতির সমস্যা এই যে, এ সমস্ত উপসর্গ দেখা দেয়ার বেশ আগেই গাছ অতিরিক্ত পানি পীড়নের শিকার হয়, ফলে গাছের যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে যায় এবং ফলন কমে যায় ।
গ) আবহাওয়া সম্পর্কিত পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে আবহাওয়ার বিভিন্ন দিক যেমন- বৃষ্টিপাত, সোলার রেডিয়েশন, তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, বাষ্পীভবন ইত্যাদি মাপা হয়। সেই সাথে বিভিন্ন গাণিতিক সমীকরণ নির্ণয় করা হয়। বাষ্পীয় প্রস্বেদন, বৃষ্টিপাত, অনুপ্রবেশ, চুয়ানোসহ অন্যান অপচয় ইত্যাদির ভিত্তিতে সেচের আবশ্যকতা ও সময় নির্ধারণ করা যায়।
সেচের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলোর বর্ণনা
জমিতে সেচের পানি বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করা যায়। ফসলের পানির প্রয়োজনীয়তা, পানির উৎস ও প্রাপ্যতা, পানির গুণাগুণ, মাটির প্রকার, জমির অবস্থান, চাষাবাদের ধরন ইত্যাদির ভিত্তিতে সেচের পদ্ধতি নির্বাচন করা হয় । আধুনিক সেচ পদতিকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায় যথা-
১। ভূ-উপরিস্থ (Surface)
২। ভূ-মধ্যস্থ (Sub-surface)
৩। প্রিংকলার (Sprinkler)
৪ । ট্রিকল (Trickle)
১ । ভূ-উপরিস্থ সেচ পদ্ধতি (Surface irrigation system) এ পদ্ধতিতে পানি সরাসরি জমিতে দেয়া হয় ও সেচের পানি জমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এক্ষেত্রে জমিতে কয়েক সে:মি: পানি দিয়ে পরীবিত করা হয় । পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জমিকে প্রথমে মসৃণ এবং পরে জমিতে বর্ডার (পাড় বা কিনার) ফারো (লাঙলের ফলার গভীর দাগ), করোগেশন (ঢেউ খেলানো আকৃতি) ইত্যাদি তৈরি করা হয় । ভূ-পরিস্থ সেচ পদ্ধতিকে নিম্নলিখিত ৩ ভাগে ভাগ করা যায় ।
১ । অনিয়ন্ত্রিত পাবন পদ্ধতি (Uncontrolled flooding)
২ । নিয়ন্ত্রিত পাবন পদ্ধতি (Controlled flooding)। এ পদ্ধতি আবার ৩ প্রকার । যেমন-
ক) বর্ডার স্ট্রিপ (Border Strip )
খ) চেক পাবন (Check flooding)
গ) বেসিন (Basin)
৩ । ফারো পদ্ধতি (Furrow Method)। এ পদ্ধতি আবার ২ প্রকার । যেমন-
ক) ফারো (Furrow)
খ) করোগেশন (Corrugation )
১। অনিয়ন্ত্রিত পাবেন পদ্ধতি (Uncontrolled flooding) যখন নালা থেকে পানি কোন রকম বাধ অথবা তাইক অথবা অন্য কোন রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই জমিতে দেয়া হয় তখন তাকে অনিয়ন্ত্রিত পরাবান পদ্ধতি বলে । যেখানে অত্যন্ত সস্তায় প্রচুর পরিমাণে সেচের পানি পাওয়া যায় সেখানে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় ।
সুবিধা
অসুবিধা
২। নিয়ন্ত্রিত পরাবন পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে মুক্ত পাবনের পানিকে নিয়ন্ত্রণ বা বাধ দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রবাহিত করা হয় ।
ক) বর্ডার স্ট্রিপ পদ্ধতি (Border strip )
এ পদ্ধতিতে মাঠকে অনেকগুলো খণ্ড বা ভাগে বিভক্ত করা হয় । এই খণ্ড গুলো সাধারণত ১০-২০ মি: প্রশস্ত ও ১০০-৪০০ মিটার লম্বা হয় । একটি খণ্ড থেকে অন্য খণ্ড নিচু বাঁধ বা ডাইক দ্বারা বিচ্ছিন্ন করা হয় । সরবরাহ নালা থেকে পানি এই খণ্ডসমূহে সরবরাহ করা হয় । পানি নিচের দিকে প্রবাহিত যে সমস্ত খণ্ডের জমিকেই ভিজিয়ে দেয় । প্রতিটি খন্ডে আলাদাভাবে সেচের পানি দেয়া হয় । সব ধরনের মৃত্তিকাতেই এই পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যায় ।
খ. চেক পাবন পদ্ধতি (Check Flooding)
এ পদ্ধতিতে চারদিকে নিচু বাঁধ দ্বারা ঘেরা তুলনামূলক সমতল জমিতে বেশি পানি দেয়া হয়। অভ্যন্ত পরিশোষক মৃত্তিকা ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বেশি উপযাগী। এছাড়াও ভারি মৃত্তিকা যেখানে পানি হার কম সেখানেও এ পদ্ধতি কার্যকর । বতুত এই পদ্ধতি বর্ষার স্ট্রিপ পদ্ধতির একটি রূপান্তর।
গ) বেসিন পদ্ধতি
নিচু বাধ দ্বারা পরিবেষ্টিত সমতল জমিতে দ্রুত পানি দেয়া হয় এবং জমি শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত পানি ধরে রাখা হয় । ধান চাষের জন্য এ পদ্ধতি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও ফল বাগান সেচ প্রদানের জন্য এ পদ্ধতি বিশেষ উপযোগী । একটি বেসিনের আওতায় ১ থেকে ৫ অথবা বেশি পরিমাণ সেচ দেয়া হয়।
সুবিধা
অসুবিধা
৩ । ফারো পদ্ধতি ফারো পদ্ধতি
দু'ধরনের যথা ফারো ও করোগেশন
ক) ফারো: ফারো পদ্ধতিতে শস্য/গাছের সারির মধ্যবর্তী ফারো (ছোট নালা) তে পানি সরবরাহ করা হয় । নালা গুলো সাধারণত প্রায় সমান্নেত ভূমি অথবা জমির ঢাল অনুযায়ী করা হয় । যে সমস্ত শস্য সারিবদ্ধ ভাবে চাষ করা হয় তাদের জন্য এ পদ্ধতি বিশেষ উপযোগী ।
খ) করোগেশন:
এটি ফারো পদ্ধতিরই একটি রূপান্তরিত অবস্থা । এ পদ্ধতিতে পানি ছোট নালায় দেয়া হয় এবং এই নালা গুলো সমস্ত মাঠ জুড়ে নির্মাণ করা হয় । পানি এই নালার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং চুবিয়ে দুই নালার মধ্যবর্তী এলাকাতে সেচ প্রদান করে ।
সুবিধা
অসুবিধা
২। -ভু মধ্যস্থ সেচ পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে মাটির বুনট এবং ফসলের শিকড়ের গভীরতার ভিত্তিতে ভূ-পৃষ্ঠের নিচে পানি প্রবাহিত করা হয় । ক্রিয়ার পানি শিকড় অঞ্চলে পৌছায়। গভীর নালা, মাটিতে প্রোধিত সিমেন্ট বা ধাতু নির্মিত ছিদ্রযুক্ত পাইপ, টাইল ড্রেন ইত্যাদির মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠের নিচে গাছের শিকড় অঞ্চলে পানি সরবরাহ করা হয়। অর্থাৎ এ পদ্ধতিতে ভূ অভ্যন্তরে এমন একটি কৃত্রিম পানির ভল তৈরি করা হয় যেখানে গাছ প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করতে পারে।
সুবিধা
অসুবিধা
৩। স্প্রিংকলার / ছিটানো পদ্ধতি/শিঞ্চন পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে পানি পাইপ ও স্প্রিংকলার নান এর মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং তা বৃষ্টির মতই মাটিতে পড়ে। এ পদ্ধতি প্রায় সব রকম ফসল ও মৃত্তিকার জন্যই উপযোগী ।
সুবিধা
অসুবিধা
৪। ট্রিকল বা ড্রিপ পদ্ধতি এটি ড্রিপ পদ্ধতি হিসেবেও পরিচিত। এ পদ্ধতিতে ছোট ব্যাসযুক্ত পাইপের একটি বিস্তারিত নেটওয়ার্ক থাকে। যা দ্বারা পানি সরাসরি গাছের গোড়ায় ফোটায় ফোটায় দেয়া হয়। এই পদ্ধতি ফল বাগান ও গ্রিন হাউসের জন্য বিশেষ উপযোগী ।
সুবিধা
অসুবিধা
গড় এলাকায় সেচ দেওয়া সুবিধাজনক নয়।
স্থাপন বেশ ঝামেলাপূর্ণ ও ব্যয় বহুল
পানির নল ও পানি নিঃ সরক প্রায়ই বন্ধ হতে পারে
খুবই পরিষ্কার পানির দরকার
পানির প্রবাহ অবিরাম পর্যবেক্ষণ করতে হয়
নিষ্কাশনের বিভিন্ন পদ্ধতি
নিষ্কাশন নালা বা নর্দমার মাধ্যমে ফসলের শিকড় অঞ্চল থেকে অপ্রয়াজনীয় বা অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়াকে নিষ্কাশন বলে । নিষ্কাশন নালা প্রধানত দুই ধরনের হয় প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম কার্য পদ্ধতি অনুসারে নিষ্কাশন নালা তিন প্রকার । যথা-
(১) ভূ-পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা (Surface)
(২) ভূ-নিম্নস্থ নিষ্কাশন নালা ( Sub - Surface or tile)।
৩) সম্মিলিত ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূ-নিম্নস্থ নিষ্কাশন নালা (Combinaton of surface and sub surface drains )
(১) ভূ-পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন নালা
যে সমতল জমিতে উপরিতরের গভীরতা কম এবং ভূ-পৃষ্ঠের অল্প নিচেই অপ্রবেশ্য তর যেমন-লাঙল তল, শক্ততল বা এটেল মাটির স্তর রয়েছে সে সব জমির জন্য ভূ-পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন নালা উপযোগী ।
ভূ- পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন নালা তিন রকমের যেমন—
ক) স্টর্ম নিষ্কাশন ব্যবস্থা বা গভীর নালা ব্যবস্থা
খ) চুয়ানো নিষ্কাশন ব্যবস্থা
গ) সম্মিলিত স্টর্ম ও চুয়ানো নিষ্কাশন ব্যবস্থা
ক) স্টর্ম বা গভীর নিষ্কাশন নালা:
এ নালা সাধারণত অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি নির্দিষ্ট সময়ে বের করে দেওয়ার জন্য গভীর করে তৈরি করা হয় ।
(খ) চুয়ানো নিষ্কাশন নালা ( Seepage drain): সেচ নালার বা খালের পানি পাশের জমির চাইতে উঁচু দিয়ে প্রবাহিত হলে পাড় চুইয়ে জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে । চুয়ানো পানি নিষ্কাশনের জন্য সেচ খালের পাড়ের পাশেই চুয়ানো খাল খনন করা হয় । খাল গভীর করে খনন করতে হয় । চুয়ানো পানি জমা হলে এখান দিয়ে নিষ্কাশত হয় ।
(গ) সম্মিলিত স্টর্ম ও চুয়ানো নিষ্কাশন নালা: এ নালা প্রথমে চওড়া ও অগভীর করে তৈরি করে মাঝখান দিয়ে কম চওড়া করে অগভীর নালা করা হয় । এতে বৃষ্টির পানি এবং চুইয়ে আসা পানি উভয়ই বের হতে পারে ।
ভূ-পৃষ্ঠ নিষ্কাশন নালা ব্যবস্থার প্রকার
পাঁচ ধরনের ভূ-পৃষ্ঠস্থ নিষ্কাশন নালা ব্যবস্থা আছে । ফসল ক্ষেভের অবস্থা বিবেচনা করে এ পাঁচ প্রকার ব্যবস্থা থেকে দুটি বা ততোধিক ব্যবস্থা সম্মিলিত ভাবে ব্যবহার করতে হতে পারে। ব্যবস্থাগুলো নিম্নরূপ
ক) এলাপোখাড়ি নালা ব্যবস্থা (Random)
খ) প্রবাহ পথে অটিক করন নালা ব্যবস্থা (Interception)
গ) ভিন্নদিকে প্রবাহিত করান নালা ব্যবস্থা (Diversion)
ঘ) উপরিভাগ মালা ব্যবস্থা (Bedding)
ঙ) মাঠ নালা ব্যবস্থা (Field drain)
২। ভূ-মধ্যস্থ বা ভূ-নিম্নস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা/টাইল (Sub Surface or file) :
এ পদ্ধতিতে মাটির অভ্যন্তর থেকে পানি টাইল অথবা মালে (এরষঃব তৎ সড়ঘর) নালার মাধ্যমে নিষ্কাশন করে ভূ-গর্ভস্থ পানির তল গাছের শিকড় অঞ্চলের নিচে নামানা হয়। এই নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে টাইল নিষ্কাশন ব্যবস্থাও বলে। এই নিষ্কাশন ব্যবস্থায় ভূ-পৃষ্ঠের নিচে নিষ্কাশন নালা স্থাপন বা তৈরি করা হয় । ভূ-গর্ভস্থ পানি তলের অবস্থান গাছের শিকড় থেকে গভীরে নামিয়ে শিকড়ের পর্যাপ্ত বৃদ্ধি ও শিকড় অঞ্চলে প্রয়োজনীয় বায়ু চলাচলের সুবিধার জন্য এ নিষ্কাশন ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকরী। বাংলাদেশে উঁচু জমিতে আবাদকৃত কসলের জন্য এই ধরনের নিষ্কাশন নালা ব্যবহার করা যেতে পারে।
বিভিন্ন উপাযািেগতা বিবেচনায় টাইল নালা পদ্ধতিতে কয়েক ধরনের বিন্যস্ততা দেখা যায় । সাধারন টাইল নিষ্কাশন পদ্ধতিসমূহ হলো -
১ । ইন্টারসেপশন (Interception)
২। র্রানডম (Random)
৩ । ডাবল মেইন (Double main )
৪ । প্যারালাল (Parallel)
৫ । গ্রিড আয়রন (Gridiron )
৬। হেরিং বানে (Herring bone)
(৩) সম্মিলিত ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূনিম্নস্থ বা ভূ মধ্যস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা
এই পদ্ধতিতে উপরে বর্ণিত উভয় প্রকার নিষ্কাশন পদ্ধতি একত্রে ব্যবহার করা হয় । এ ব্যবস্থায় ভু পৃষ্ঠস্থ পানি নিষ্কাশনের নালার তলদেশের মাটির নিচে নিষ্কাশন নালা তৈরি করা যায় । এ নালার চতুর্দিকে ফিল্টার দ্রব্য ব্যবহার করা হয় ।
অতি সংক্ষিত প্রশ্ন
১। ফল গাছে সেচের প্রয়োজন হয় কেন ?
২। কৃষি কাজের জন্য অন্যতম এবং অপরিহার্য উপাদান কোনটি ?
৩ । ফল বাগানে নিকাশের প্রয়োজনীয়তা কী ?
সংক্ষিত প্রশ্ন
১। পানি সেচ বলতে কী বোঝায় লেখ ।
২। ফল বাগানে পানি নিকাশের উপকারিতা লেখ ।
৩ । ফোয়ারা বা বর্ষণ সেচ পদ্ধতির সুবিধা অসুবিধাগুলো লেখ ।
৪। সেচ ও নিকাশের পদ্ধতিগুলোর নাম লেখ ।
৫ । ফল বাগানে সেচের সুফল বর্ণনা কর ।
৬। সঠিক সময়ে সেচের পানি প্রদানের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়সমূহ কি কি ?
রচনামূলক প্রশ্ন
১ । সেচের প্রধান প্রধান পদ্ধতিগুলোর নামসহ যে কোন একটি পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা লেখ ।
২। পানি নিষ্কাশনের উদ্দেশ্য এবং সুবিধা অসুবিধা লেখ।
৩ । বাগানে সেচের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণের বিষয়াবলি বর্ণনা কর ।
৪ । ফল বাগানে সেচ ও নিষ্কাশনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর ।
৫ । ফল গাছে পানি সেচের সময় ও পরিমাণ কিভাবে নির্ধারণ করা যায় লেখ ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে কতগুলো ইউরোপীয় মিশন ব্রিটিশ (বৃটেন), ফ্রান্স এবং ইষ্ট ইন্ডিয়া হতে ফলের নতুন নতুন জাত প্রবর্তনের মাধ্যমে বেশ কিছু সংখ্যক বাণিজিক ফলের বাগান এদেশে প্রতিষ্ঠিত করে ।
কলা, কাঁঠাল, বাতাবি লেবুর, কয়েকটি জাত এবং আম, ভারতের দেশীয় ফল । লিচু, কমলা, লেবু প্রভৃতি চীন দেশ হতে পেঁপে, আনারস, সফেদা আমেরিকা হতে আঙ্গর, ডালিম প্রভৃতি এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অবিভক্ত ভারতবর্ষে প্রবর্তিত হয়েছিল। বাংলাদেশে বর্তমানে (২০০৫-০৬) প্রায় ১.৩৯ লাখ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফলের চাষ হয় । তন্মধ্যে আম কাঁঠাল, কলা, লিচু, কাগজিলেবু, বাতাবি লেবু, কমলা লেবু, আনারস, পেয়ারা, পেঁপে, আতাফল, তরমুজ, ইত্যাদি প্রধান। এছাড়া বাংলাদেশে আরও অন্যান্য ফলের চাষ এলাকা ভিত্তিক কম বেশি হয়ে থাকে। বিভিন্ন সমস্যার মাতা ফল ও ফুল গাছ পোকা মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয় । প্রতিবছরই বাংলাদেশে এই সব অনিষ্টকারী পোকামাকড় আমাদের মূল্যবান ফল ও ফল গাছের ব্যাপক হারে ক্ষতি করে । ফুল ও ফলগাছের অধিকাংশ পোকামাকড় আকারে ছোট কিন্তু তাদের দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি ।
ক্ষতির প্রকৃতি এবং স্বভাব বিবেচনা করলে দেখা যায় বিভিন্ন পোকা ফল ও ফলগাছের চারা ফলগাছ, কাণ্ড, পলব, ফুল ও কুঁড়ির যথেষ্ট ক্ষতি করে। এর ফলে অনেক সময় ফল উৎদানকারী ও ফল জাত দ্রব্যের ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ হয়ে দাড়ায় । ফল ও ফল গাছের অনিষ্টকারী পোকামাকড় যথাযথভাবে প্রতিরোধ ও তাদের আক্রমণে প্রতিহত করতে হলে এদের স্বভাব, প্রকৃতি, বিস্তৃতি, জীবনবৃত্তান্ত, আবির্ভাবের সময় ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন ।
আমাদের জানা প্রয়োজন, কোন সময় ফল বা ফল গাছ পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয় । ক্ষতির প্রকৃতি বা ধরন সম্পর্কেও জানা দরকার । সেই সাথে ঋতুভেদে পোকামাকড়ের সংখ্যাধিক্য, স্থায়ীত্ব, আবির্ভাবের সময় এবং বিস্তৃতি কেমন হয় তাও জানা প্রয়োজন । এসব তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে পোকামাকড়ের আক্রমণের পুর্বাভাস দেয়া সম্ভব হতে পারে । সম্ভব হলে ফল ও ফল গাছ রক্ষায় আগাম ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে । সারা বিশ্বে এক হাজারের বেশি পোকা ও তার প্রজাতি ফল ও ফল গাছের অনিষ্ট করে থাকে । বাংলাদেশে শত শত পোকামাকড় প্রতি বছর ফল ও ফল গাছের ক্ষতি করে থাকে ।
ফল ও ফল গাছের আক্রমণকারী প্রধান প্রধান পোকা
বালাদেশের প্রধান প্রধান ফলে ও ফল গাছে নানা ধরনের পোকা মাকড় আক্রমণ করে থাকে । নিম্নের সারণিতে ফল ও ফল গাছে আক্রমণকারী প্রধান প্রধান পোকামাকড়ের তালিকা দেওয়া হলো ।
ফল ও ফুল গাছের আক্রমণের ধরন দেখে পোকা শনাক্ত
ফল ও ফুল গাছের অনিষ্টকারী পোকামাকড় দমন করতে হলে এর স্বভাব, প্রকৃতি, বিস্তৃতি, জীবন বৃত্তান্ত আবির্ভাবের সময় ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। নিম্নের বর্ণিত ফলের প্রধান প্রধান পোকার আবির্ভাবের সময় ও ক্ষতির লক্ষণ দেখে শনাক্তকারী পোকার বাংলা ও ইংরেজি নাম দেওয়া হলো ।
পোকা দমন পদ্ধতিগুলোর বর্ণনা
ফসলকে বিভিন্ন প্রকার পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য পোকা দমন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে । প্রধানত দুই প্রকার পদ্ধতিতে পোকা দমন করা হয় । যেমন-
১) প্রাকৃতিক দমন ও ২) ফলিত বা কৃত্রিম দমন
প্রাকৃতিক দমন (Natural Control)
১. জলবায়ুগত উপাদান সমূহ দ্বারা
২. ভূমির বন্ধুরতা বৈশিষ্ট্য দ্বারা
৩. শিকারি জীব দ্বারা
৪. পোকার রোগ দ্বারা
ফলিত বা কৃত্রিম দমন (Applied or Artificial Control)
১. যান্ত্রিক দমন
২. ভৌত দমন
৩. কৃষিজ পরিচর্যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ
৪. জৈবিক দমন
৫. রাসায়নিক দমন
৬. কৌলিকভাবে দমন
৭. আইনগত নিয়ন্ত্রণ
প্রাকৃতিক দমন (Natural Control)
জলবায়ুগত উপাদানের মধ্যে তাপমাত্রা, আদ্রতা, আলো, বাতাস ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য। এ সকল উপাদানের বিভিন্ন মাত্রা বিভিন্ন পোকা সহ্য করতে পারে ও বংশ বিস্তার করে থাকে। এসব উপাদানের পরিবর্তন ঘটলে বংশবৃদ্ধি ও বিস্তার মারাত্মকভাবে হ্রাস পায় । যেমন গ্রীষ্মের সময় অত্যধিক তাপমাত্রায় বা খরায় পোকার মৃত্যু ঘটে । অল্প আর্দ্রতায় শোষক পোকার মৃত্যু ঘটে । আর্দ্রতা বেশি হলে পোকার দেহে ছত্রাকজনিত রোগ বেশি হয় এবং পোকা মারা যায়। এছাড়া খাদ্য, বাসস্থান ইত্যাদির জন্য একই অথবা একাধিক প্রজাতির মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে প্রাকৃতিক ভাবে পোকা দমন হয় ।
ফলিত বা কৃত্রিম দমন (Applied or artificial control) মানুষ কতৃক গৃহীত দমন ব্যবস্থাকে কৃত্রিম বা ফলিত দমন বলে । প্রাকৃতিক ভাবে দমন কার্যকরী না হলে কৃত্রিম দমন ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হয় ।
ক. যান্ত্রিক দমন (Mechanical control): যান্ত্রিক উপায়ে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ হলো বিশেষ কোন ধরনের কোন যন্ত্র, মানুষের শ্রম ও কোন বিশেষ দ্রব্যের সাহায্যে কীটপতঙ্গ দমনের কৌশল । অথাৎ হাত দ্বারা ধরে এবং বিভিন্ন প্রকার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পোকা মাকড় দমন পদ্ধতিকে যান্ত্রিক দমন বলে । যান্ত্রিক দমন পদ্ধতি গুলো হলো। নিম্নরুপ:
১. হাতে ধরা এ পদ্ধতিতে মাজরা পাকার ডিম, মথ ও পূর্ণাঙ্গা পোকা দমন করা যায় । হাতের সাহায্যে এগুলো সংগ্রহ করে পিটিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে হবে ।
২, পাতার অগ্রভাগ কাটা: পামরি পোকাসহ কতিপয় পোকা এবং তাদের ডিম ও গ্রাব পাতার অগ্রভাগে মোড়ানো অবস্থায় বা পাতার শিরার মাঝখানে থাকে। এ অবস্থায় পাতার অগ্রভাগ এবং মোড়ানো অংশ কেটে মাটিতে পুতে বা আগুনে পুড়ে ফেলা যায় ।
৩. আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলা : আক্রান্ত গাছগুলো বিশেষ করে ভাইরাস আক্রান্ত গাছ গুলো তুলে আগুনে পুড়িয়ে বা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে ।
৪. আলোর ফাঁদ: হ্যাজাকলাইট, হারিকেন, বৈদ্যুতিক বাতি ইত্যাদি দ্বারা আলোর ফাদ তৈরি করে ক্ষেতের মধ্যে বা পাশে ঝুলিয়ে রাখলে বিভিন্ন পোকা আলোর দিকে আকৃষ্ট হয়। বাতির নিচে রক্ষিত একটি কেরোসিন বা কীটনাশক মিশ্রিত পানির পাত্রে পোকাগুলো পড়ে মারা যায় ।
৫. আঠা লাগানো ফাঁদ ও কয়েকটি হার্ডবােের্ডর টুকরায় আঠা বা গাম লাগিয়ে জমিতে বিছিয়ে রাখলে পোকা চলাচলের সময় বােের্ডর আঠায় আটকিয়ে যায়। এ ধরনের ফাদে সবুজ পাতা ফড়িং ও বাদামি গাছ ফড়িং বেশি ধরা পড়ে । হলুদ রঙের দিকে বাদামি গাছ ফড়িং এবং সাদা রঙের দিকে থ্রিপস বেশি আকৃষ্ট হয় ।
খ, আধুনিক চাষাবাদ বা পরিচর্যা পদ্ধতির মাধ্যমে দমন (Cultural method )
১. রোগবালাই প্রতিরোধী জাত ( Resistant variety) চাষের মাধ্যমে দমন: রোগ প্রতিরোধী জাতের ফসল চাষ করে পোকা মাকড়ের আক্রমণ বহুলাংশে রোধ করা যায়। যেমন- আই আর- ২০, ব্রি ধান-৫, ব্রিধান-৩৩, বিআর-৩১, বিআর-৬, চান্দিনা জাতগুলো ডিসেম্বর মাসের মধ্যে রোপণ করলে বাদামি গাছ ফড়িং এর আক্রমণ থেকে ধানের জমি রক্ষা করা সম্ভব। বিআর-১, ১০, ১১ ও ১২ মাজরা পোকা সহনশীল জাত হিসাবে চিহ্নিত (সুত্র: আধুনিক ধানের চাষ: ব্রি)।
২. রোদ শুকানো জমি চাষ করে আলগা অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা রোেদ শুকাতে দিলে অনেক পোকা মারা যায়।
৩, , গভীরভাবে চাষ: গভীর ভাবে চাষ দিলে পোকা উপরে ওঠে আসে । তারপর রোেদ শুকিয়ে মারা যায় বা পাখি খেয়ে নেয় ।
৪. মুড়িয়ে ফসল কাটা: ধান কাটার পর যদি অবশিষ্ট অংশ বেশি থাকে। তবে তার মধ্যে মাজরা পোকা, লেদা পোকার পুত্তলী আশ্রয় নেয় ।তাই মুড়িয়ে ফসল কাটতে হবে যাতে পোকা আশ্রয় নিতে না পারে ।
৫. পর্যায়ক্রমে ফসলের চাষ: একই জমিতে একই ফসল প্রতি বছর আবাদ করলে সে ফসলে পোকার আক্রমণ বেড়ে যায় । কিন্তু যদি পর্যায়ক্রমে ফসলের চাষ করা হয় যেমন- কলার পরে পেঁপে বা আনারস এতে পোকার আক্রমণ কমে যায় । ধানের ক্ষেতে পাট বা গম ইত্যাদি ।
৬. পানি ব্যবস্থাপনা: পানি সেচ দিয়ে উড়চুঙ্গা, শীষকাটা লেদা পোকা ইত্যাদি পোকা মারা যায় । আবার পানি সরিয়ে দিয়ে ধানের জমি হতে চুঙ্গি ও ঘাস ফড়িং এর আক্রমণ কমানো বা রোধ করা যায় ।
৭. আগাছা মুক্ত জমি: আগাছা পাকামাকড় ও রোগবালাই এর আশ্রয় স্থল এবং বংশবিস্তারের মাধ্যম আগাছা মুক্ত রাখার মাধ্যমে পোকামাকড়ের আক্রমণ কমানো যায় ।
গ. রাসায়নিক দমন (Chemical Control)
পোকা মাকড় এবং রোগবালাই দমন পদ্ধতির মধ্যে রাসায়নিক দমন হলো সর্বশেষ বহুল ব্যবহৃত দমন পদ্ধতি । বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এ পদ্ধতির প্রয়োগ না করাই ভালো। এ পদ্ধতি তখনই ব্যবহৃত হয়, যখন অন্য কোন উপায়ে পোকা দমন সম্ভব নয় । এতে করে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুর বিশেষ ক্ষতি হয়। রাসায়ি নক পদ্ধতি কার্যকর এবং দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে কীটনাশকের সঠিক প্রয়োগ পদ্ধতি ও সময় জানা প্রয়োজন । এ দমন পদ্ধতিতে ডায়াজিনন, সুমিথিয়ন, সেভিন, ফুরাডান, ফাইফানন ইত্যাদি রাসায়নিক দ্রব্য, এলটুসিড, ডিমিলিন ইত্যাদি কৃত্রিম হরমোন, নিম, বিষকাঁঠালী, নিশিন্দা ইত্যাদি ভেষজ বিষ হিসাবে পোকা দমনে ব্যবহার হয় । রাসায়নিক বালাইগুলো ব্যবহারের পূর্বে নিমের বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে ।
(i) ফসলে কী ধরনের পোকার আক্রমণ হয়েছে তা পরীক্ষা করা
(ii) ওষুধ ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতিতে দমন করা সম্ভব কিনা যাচাই করা
(iii) সঠিক বা অনুমোদিত সর্বনিম্ন মাত্রায় প্রথম বার বালাইনাশক প্রয়োগ
(iv) সঠিক সময়ে সঠিক নিয়ম ও পদ্ধতি প্রয়োগ করা
(v) ফসলের উপকারী পোকামাকড় যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে নজর রাখা
(vi) ফসলের আর্থিক ক্ষতির নিম্নতম পর্যায় অতিক্রম করলেই কেবল প্রয়োগ করা ইত্যাদি
ঘ. জৈবিক দমন (Biological Control); এই পদ্ধতিতে পোকার প্রাকৃতিক শর্তসমুহ যেমন- পরভোজী, পরজীবী এবং রোগজীবাণু কৃত্রিম উপায়ে বৃদ্ধি করে আক্রান্ত শস্য ক্ষেতে ছেড়ে দিয়ে দমন করা হয় । অর্থাৎ ফসলের মাঠে/বাগানে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গা সমূহকে বিভিন্ন প্রকার রাগজীবাণু, পরভোজী ও পরবাসী কীটপতঙ্গ, পোকা খাদক পাখি, ব্যাঙ, ইত্যাদি উপকারী জীব দ্বারা দমন করার পদ্ধতিতে জৈবিক দমন পদ্ধতি বলে । জৈবিক দমন পদ্ধতিগুলো নিম্নরূপ :
(i) পরভোজী পোকা সংরক্ষণ: যে সব পোকা অন্য পোকাকে খেয়ে বেঁচে থাকে তাদেরকে পরভোজী পোকা বলে। এদের মধ্যে রয়েছে লেডিবার্ডবিটল, মেরিড বাগ, মাকড়সা ইত্যাদি। এরা ফসলের অনিষ্টকারী পোকা যেমন- সবুজ পাতা ফড়িং, বাদামি গাছ ফড়িং ইত্যাদি খেতে ভালাবাসে। এছাড়া টাইগার বিটল, ড্রাগন ফ্লাই ইত্যাদি পরভোজী পোকাগুলো অন্যান্য অনিষ্টকারী পোকা খেয়ে জৈবিক দমনে সাহায্য করে। কাজেই এসব পরভোজী পোকা সংরক্ষণ করা অতীব জরুরী।
(ii) প্রবাসী পোকা সংরক্ষণ: ফসলের অনিষ্টকারী পোকার সাথে টেলিনমাস, ব্রাকনিড ইত্যাদি কতগুলো পরবাসী পোকা বাস করে । ব্রাকনিড হল ধানের পামরি পোকার এবং টেলিনমাস হল হলুদ মাজরা পোকার ডিমের প্যারাসাইট । এরা আগষ্ট হতে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৬০ থেকে ১০০ ভাগ পোকার ডিম নষ্ট করে ।
(iii) পাখি বসার ডাল: শালিক, ময়না, দোয়েল ইত্যাদি পাখি পোকা খায় । ক্ষেতের মধ্যে গাছের ডাল বা বাঁশের আগা ইত্যাদি পুঁতে দিয়ে পাখি বসার সুযোগ করে দিলে বিভিন্ন অনিষ্টকারী কীটপতঙ্গ দমনে সাহায্য করে । নির্দিষ্ট দূরত্বে ধৈঞ্চা লাগিয়েও পাখি বসার সুযোগ করে দেয়া যায় ।
(iv) মাছ ও হাঁসের চাষ: বোরো ও রোপা আমন ধানের ক্ষেতে মাগুর, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছের চাষ করলে মাছ পোকা খেয়ে ধানের উপকার করে। আবার ধানের জমিতে হাঁস ছাড়লে জমির পোকা খেয়ে হাঁস ধানের উপকার করে ।
(v) ব্যাঙঃ ফসলের ক্ষেতে বিশেষ করে ধানের জমিতে ব্যাঙ ছেড়ে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করলে ব্যাঙ পোকামাকড় ধরে খায়।
(ঙ) কৌশিক ভাবে দমন: গামা রশ্মি প্রয়োগে কীট পতঙ্গের প্রজনন ক্ষমতা রহিত করে এবং পোকার সংখ্যা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় । এ পদ্ধতিতে পুরুষ পাকাগুলোকে গামা রশির মাধ্যমে বন্ধা করে স্ত্রী পোকাগুলোর সহিত স্বাভাবিক যৌন মিলনের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয় । এদের মিলনের ফলে সব ডিমই বা হয় এবং বাচ্চা হয় না ।
(চ) আইনগত নিয়ন্ত্রণ: কোন ক্ষতিকর পোকা কোন দেশ বা অঞ্চলে যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য আইনগত ভাবে বাধা প্রদান করা হয়। আক্রান্ত গাছের অংশ ও বীজ এক দেশ থেকে অন্য দেশে বা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চলাচলে আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করে অনেক পোকা ও রোগের ব্যাপক বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
যান্ত্রিক পোকা দমনের পদ্ধতি ও উপকারিতা
যান্ত্রিক পদ্ধতির উপকারিতা
১. পরিবেশ দূষণ হ্রাসে সহায়তা করে বা কমিয়ে আনে ।
২. অল্প খরচে সামান্য কিছু উপকরণ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পাকার বংশ প্রাথমিক অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।
৩. এই পদ্ধতি পরিবেশ বান্ধব, কোন রকম দূষণ সৃষ্টি না করে পোকা দমন করা যায় ।
৪. এই পদ্ধতি কম ব্যয় বহুল
৫. কৃষকের উৎপাদন খরচ কমিয়ে দেয়। কম খরচে বেশি ফলন পেতে সহায়তা করে ।
৬, অল্পতেই কৃষককে এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগ সম্পর্কে সেখানে যায় ।
৭. উপকারী পোকা মাকড়, মাছ, ব্যাঙ, পশুপাখি ইত্যাদির সংরক্ষনে সহায়তা
৮. প্রাকৃতিক ভাবে বিদ্যমান জৈবিক ভারসাম্যের কোন ক্ষতি করে না
৯. ক্ষতিকর বালাই নাশকের ব্যবহার কমিয়ে কৃষকের আর্থিক সাশ্রয় করে ।
পোকাদমনে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থার উপকারিতা
সমন্বিত বালাই দমনের বহুবিধ সুবিধার মধ্যে কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো :
১. উপকারী পোকামাকড়, মাছ, ব্যাঙ, পশু-পাখি প্রভৃতি সংরক্ষণ করা যায়
২. বালাইনাশকের যুক্তিসংগত ব্যবহার নিশ্চিত করা, যাতে করে উৎপাদন খরচ কমে যায়
৩. ক্ষতিকারক পোকা মাকড়, বালাইনাশক সহনশীলতা অর্জন করার সুযোগ পায় না
৪. বালাই নাশ ক্রিয়া রোধ করা। এতে করে বালাইনাশক হজেই এড়ানো যায় ।
৫. বালাইয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা কমে যায় ।
৬. পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় ।
৭. কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনা যায় ।
৮. জনস্বাস্থ্য ভালো রাখা যায়।
৯. ফসল সংরক্ষণ খরচ কমিয়ে আনা যায় ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। সারা বিশ্বে কত প্রজাতির পোকা মাকড় ফল ও ফল গাছের অনিষ্ট করে থাকে ?
২। পোকা মাকড়ের প্রাকৃতিক দমন বলতে কী বোঝায় ?
৩। কাঁঠালের ফল ছিদ্রকারী পোকার নাম কী ?
৪ । পোকা দমনে যান্ত্রিক পদ্ধতির উপকারীতা কী ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। আম ছিদ্রকারী পোকার অপর নাম কী ? এ পোকা দমনের উপায় বর্ণনা কর ।
২। কলার পাতা ও ফলের বিটলের বৈজ্ঞানিক নাম কী?
৩। নারিকেলের গল্ডার পোকার অপর নাম কী ? এ পোকাকে গন্ডার পোকা বলা হয় কেন ? এ পোকা দমনের উপায়গুলো লেখ ।
৪ । পোকা দমনের বিভিন্ন পদ্ধতির নাম লেখ ।
৫ । প্রাকৃতিক দমন ও কৃত্রিম দমনের মধ্যে পার্থক্য লেখ ।
৬। যান্ত্রিক ও জৈবিক পদ্ধতিতে পোকা দমনের উপকারিতা লেখ ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। কলার পাতা ও ফলের বিটল কোন অবস্থায় কলা গাছের ক্ষতি করে । এ পোকার ক্ষতির নমুনা ও দমনের উপায় সংক্ষেপে বর্ণনা কর ।
২। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পোকা দমন কৌশলগুলার বর্ণনা কর ।
৩। জৈবিক উপায়ে পোকা দমন পদ্ধতির বিবরণ দাও ।
৪ । ফল ও ফল গাছে পাকার আক্রমণের ধরন দেখে আম, কাঁঠাল কলা, নারিকেল ও পেয়ারার ২টি করে প্রধান পোকা শনাক্ত করার পদ্ধতি বর্ণনা কর ।
৫ । সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বলতে কী বোঝায় ? এর উপকারিতা বা সুবিধাগুলো লেখ ।
খাদ্যপ্রাণে ভরপুর ফল অতি গুরুত্বপূর্ণ ফসল । ফল স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী । ফলের মধ্যে যেসব উপাদান আছে তা আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজন । আমাদের শরীর রক্ষার্থে যে সব ভিটামিন প্রয়াজন তার সবগুলো ফলে রয়েছে । শরীরিক সুস্থতা ও সুঠাম দেহ রক্ষায় ফলের ভূমিকা অপরিসীম । খাদ্য হিসাবে ফলের সুবিধা হলো যে রান্না ছাড়াই ফল খাওয়া যায় । বাংলাদেশের আবহাওয়া ফল চাষের খুব উপযোগী এবং একর প্রতি গড় ফলন যে কোন মাঠ ফসলের তুলনায় বেশি। মাঠ ফসলের তুলনায় ফল উৎপাদনে বেশি হওয়ায় ফলচাষে আর্থিক দিক দিয়ে কৃষকের আরও বেশি লাভবান হতে পারে ।
বাংলাদেশে সারাবছরই বিভিন্ন জাতের ফল হয় । কিন্তু বিভিন্ন রোগের দরুন ফলের উৎপাদন অনেক স্থানে আশাতীত হয় না । তাছাড়া রোগ ফলের গুণাগুণও নষ্ট করে । ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ফলের বিভিন্ন রোগ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক ।
বাংলাদেশের ফল ও ফল গাছের প্রধান প্রধান রোগের তালিকা
ফল ও ফল গাছের রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকার
বৈজ্ঞানিক কৃষির বিকাশ ও উদ্ভিদ রোগের বিকাশ ফসল চাষাবাদের শুরু থেকে সমান্তরালভাবে চলছে । জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খাদ্য ঘাটতি মেটানোর জন্য কৃষি বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ শুরু করে। যেমন-
১। নতুন জাতের আবাদি ফসল / গাছ
২। অধিক ফলনশীল ফসলের জাত
৩। উন্নত সার আধুনিক সারের উদ্ভাবন ও ব্যবহার
৪ । অঢেল সেচের পানি এবং
৫ । পতিত না রেখে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার
কিন্তু রোগব্যাধির প্রতি বিশেষ নজর না রেখে এসব প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। ফলে বিভিন্ন মাধ্যমে রোগ বালাই বিস্তার লাভ করে । যেমন-
১। বীজ ও অন্যান্য অঙ্গজ বংশবৃদ্ধির উপকরণের সাথে শক্তিশালী রোগজীবাণুর আবির্ভাব
২। নতুন শস্য জাত চাষের ফলে পূর্বের রোগ জীবাণুর অধিকতর শক্তি সঞ্চয়
৩। বিরাট এলাকা জুড়ে একই ফসল ও একই জাত চাষ, নিবিড় চাষ এবং সারা বছর ফসল দ্বারা মাঠ আচ্ছাদিত থাকায় রোগজীবাণু বেঁচে থাকার বংশ বৃদ্ধি ও বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ পায় ।
৪ । সার ও পানি নির্বিচারে ব্যবহার রোগজীবাণু বিস্তারে সহায়ক। সুতরাং যে প্রযুক্তি বা কৌশল আমরা ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োগ করছি তা রোগ জীবাণু বৃদ্ধির জন্য অনুকূল। আধুনিক প্রযুক্তি রোগ জীবাণু সম্পর্কিত বিপদ বৃদ্ধির যেমন সহায়ক, তেমনি বৈজ্ঞানিক ভাবেই রোগজীবাণু নিয়ন্ত্রনও সম্ভব । জনসংখ্যা বৃদ্ধির মাকোবিলায় অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োজন । একই ভাবে রোগ বালাই নিয়ন্ত্রণে ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে । এই দুই পরিস্থিতি হতে ফসলের রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার অথাৎ সংরক্ষনের উপর গুরুত্ব অনুধাবন করতে যাতে অধিক উৎপাদনের মাঝে সাথে রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হলো
১। মাঠে বা বাগানে যা রোপণ বা বপন করা হবে তা শস্য/গাছে পরিণত হবে ।
২। যা আবাদ করা হবে তা থেকে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যাবে ।
৩ । যা উৎপন্ন হবে তা নিরাপদে বাজারে আসবে এবং অবশেষে তাই গ্রাহকের নিকট পৌছুবে।
উপরোক্ত তিনটি বাক্য হতে এটা বোঝায় যে, ফসল চাষাবাদের প্রত্যেকটি বা যে কোন ধাপে রোগ সৃষ্টি হয় । এ রোগ দমনের প্রয়োজন রয়েছে, উৎপাদনের স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রেখে লক্ষ্য মাত্রায় পৌঁছার জন্য । উদ্ভিদ রোগ দমনের মূলনীতি (Principles of plant disease control) একটি কার্যকরী উদ্ভিদ রোগ দমন কর্মসুচী প্রনয়নে নিম্নলিখিত মুল বিষয়গুলো মনে রাখা দরকার ।
১। শস্যের প্রকার : লতা, গুল্ম গাছ, অর্থকরী ফসল, খাদ্য শস্য ইত্যাদি শস্যের বৃদ্ধির পর্যায়
২। রোগজীবাণুর প্রকৃতি ও ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি রোগ জীবাণুর জীবনচক্র, বীজ, মাটি বা । বায়ু বাহিত, বিস্তারের ধরন ইত্যাদি ।
৩। রোগের প্রকৃতি ও অভ্যন্তররীণ/বাহ্যিক, বীজ, মূল, ফুল, পাতায় আক্রমণ এ সকল বিষয় মনে রেখে উদ্ভিদ রোগ দমন কর্মসূচি নিম্নলিখিত ৪টি মূলনীতির ভিত্তিতে প্রনয়ন করা যায় ।
ক. রোগজীবাণু বর্জন (Exclusion of pathogen)
খ. রোগ জীবাণু নিমূল (Eradication of the pathogen)
গ. রোগ জীবাণুর হাত থেকে ফসলকে বাঁচানো
ঘ. রোগ প্রতিরোধী জাত উন্নয়ন (Resistant variety)
উপরোক্ত ৪(চার) মূলনীতির উপর ভিত্তি করে উদ্ভিদের রোগ দমনে নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়
১ । আইন প্রয়োগের মাধ্যমে (Legislative measures )
২ । চাষাবাদ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে (Cultural practices)
৩ । রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার (Use of Chemicals)
৪ । রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার (Use of resistant variety)
৫ । জৈবিক দমন (Biological control)
৬। সমন্বিত রোগ দমন (IPM - Integrated Pest Management)
রোগ দমন ব্যবস্থা কোন সময় নেওয়া হলো তার উপর ভিত্তি করে রোগ দমন পদ্ধতি দুই প্রকার
১ । প্রাফোইলক্সিস - রোগ যাতে সৃষ্টি না হয় তার ব্যবস্থা নেওয়াকে প্রিভেনটিভ ব্যবস্থা বলে ।
২ । থেরাপি ও রোগ শুরু হওয়ার পর রোগের বৃদ্ধি রহিত করার ব্যবস্থাকে কিউরেটিভ ব্যবস্থা বলে ।
সারণি— ১ উদ্ভিদের রোগ দমন পদ্ধতিগুলো নিম্নে ছকে দেখানো হলো
(Plant Quarantine) সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত একটি আইন যার মাধ্যমে কোন এলাকায় কোন নতুন বা অধিকতর শক্তিশালী রোগ জীবাণু প্রবেশে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্য কৃষিজাত পণ্যের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয় । একে উদ্ভিদ সংগনিরোধ বলা হয় ।
১৬৬০ সালে কারবারী গাছ নিষিদ্ধ করে ফ্রান্সে প্রথম উদ্ভিদ সংগনিরোধ আইন চালু করে । পরবর্তীতে ১৯১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল কোয়ারেন্টাইন আইন চালু হয় । বাংলাদেশে ১৯৬৬ সালের ক্ষতিকর বালাই আইন প্রণীত হয় যা ১৯৮৯ সালে সংশোধিত ও ১৯৯২ সালে বর্ধিত আকারে অনুমোদিত হয়ে চালু রয়েছে ।
কোয়ারেন্টাইল বা সংগনিরোধ ব্যবস্থাকে ২ ভাগে প্রয়োগ করা যায় ।
ক) Exclusive quarantine এটা সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা ও নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে কার্যকরী করা হয়। যেমন: আলুর মড়ক রোগ দেখা দিলে কোন দেশ ইচ্ছা করলে সে বৎসর পৃথিবীর যে কোন দেশ থেকে আলু বীজ আমদানি বন্ধ রাখতে পারে। অথবা নির্দিষ্ট কোন দেশ থেকে আলু বীজ আমদানীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে ।
খ) নিয়ন্ত্রিত কোয়ারেন্টাইন: এটা কিছুটা শিথিল আইন। পরিদর্শন সনদপত্র প্রদান, বীজ পরিশোধন ও সনদপত্র প্রদান এবং অন্তরণ সনদপত্র প্রদানের মাধ্যমে বীজ আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। উপরোক্ত আইন সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগের জন্য দরকার পোষক ও রোগজীবাণুর প্রাকৃতি ও রোগ বিস্তারের ধরনের উপর সম্যক জ্ঞান ।
কোয়ারেন্টাইন আইন কোন দেশের প্রবেশ পথে (বিমান বন্দর, সামুদ্রিক বন্দর, স্থল বন্দর ইত্যাদি) কার্যকরী করা যায় । ঐ সব পথে কোয়ারেন্টাইন বস্তু পরীক্ষা করা হয় । কোয়ারেন্টাইন বতু বলতে বুঝায়, চারা গাছে গাছের পাতা, ফুল, ফল, কাণ্ড, মূল বা মূল সমষ্টি, বীজ সমষ্টি, বীজ, মাটিস্থ টবের গাছ ইত্যাদি, যাদের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত রোগজীবাণু বাহিত হতে পারে ।
প্রবেশ পথে রোগজীবাণুকে তিনটি শ্রেণিতে বিবেচনা করে কোয়ারেন্টাইন বস্তু পরীক্ষা করা হয় । যথা-
শ্রেনী কঃ যে রোগজীবাণু কোন এলাকায় সম্পূর্ণ নতুন ও শক্তিশালী । যেমন- বাংলাদেশের জন্য Septoria nodorum (সেপটোরিয়া নডরাম) (গমের বরচ রোগ), সিনকাইট্রিয়াস এন্ডাবোয়োটিকাম (আলুর ওয়াট রোগ)।
শ্রেণি খঃ যে রোগজীবাণু নতুন নয় কিন্তু অধিকতর শক্তিশালী যেমন: ফাইটোপথরা ইনফেসটানস (আলুর মড়ক রোগ)।
শ্রেণি গঃ যে রোগ জীবাণু সব সময় কিছু না কিছু রোগ ছড়ায় তবে মারাত্মক নয় । বাইপালারিস অরাইজি (ধানের বাদামি দাগ রোগ)।
চাষাবাদ পদ্ধতি (Cultural practices)
চাষাবাদ পদ্ধতির মাধ্যমেও ফসলের রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় । যেমন ভালো এবং সুস্ববীজ বাছাই করে বপন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে জমি তৈরি, ভালো ভাবে জমি চাষ দেয়া, সুষম সার ব্যবহার, শস্য পর্য্যায় বা জমি পতিত রেখে, আগাছা দমন করে, পরিষ্কার সেচের পানি ব্যবহার, পরিপক্ক ফসল কাটা, ফসলের আবর্জনা পরিষ্কার, ফসল সঠিকভাবে শুকানো ইত্যাদি পদ্ধতি অবলম্বন করে রোগ-জীবাণু এড়িয়ে চলা যায় । উদাহরন স্বরুপ বলা যেতে পারে সুস্থ বীজ বপন করলে বীজ বাহিত রোগের তীব্রতা কমে । জমিতে পটাশ সারের অভাব হলে ধানের কাণ্ড পচা রোগ যেমন বেশি হয়, তেমনি নাইট্রোজেনের আধিক্যে ধানের বাস্ট ও ব্যাকটেরিয়াল ব্লাইট রোগ বেশি হয়।
আগাছা অনেক রোগজীবাণুকে আশ্রয় দেয়। যেমন বন্য বেগুন গাছ কেটে ফেললে আলুর মড়ক রোগ এড়ানো যায় । শস্য পর্যায় অবলম্বন করে বায়ুবাহিত রোগ লিফ রাষ্ট পাউডারি মিলডিউ, অলটরনারিয়া বাইটের তীব্রতা কমানো যায় । জমি পতিত রেখে কৃমিজনিত শিকড়-গিট, গোড়াপচা ও মূল পচা রোগ দমন করা যায় ।
উচ্ছেদ (Eradication): প্রধান পোষক বা বিকল্প পোষক ধ্বংসের মাধ্যমে রোগ দমন করা যায় ।
জৈবিক দমন (Biological Control)
উদ্ভিদ রোগ জীবাণুকে জীবিত এজেন্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রণকে জৈবিক দমন বলে। এ সমত এজেন্টকে এস্টাগনিস্ট বলে । ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি কৃত্রিম এন্টাগনিস্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয় । এস্টাগনিষ্ট এর বৈশিষ্ট্য হলো এরা উদ্ভিদের রোগ উৎপাদন করে না ।
মাটিতে বা পত্রপৃষ্ঠে রোগজীবাণু ও এন্টাগনিষ্ট একত্রে বাস করে। এ দুয়ের মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষিত হয়। ভারসাম্য বজায় থাকলে ফসলে রোগ হয় না বা তীব্রতা কম থাকে। কিন্তু ভারসাম্য ক্ষুন্ন হলে অর্থাৎ এন্টাগনিস্ট যদি শক্তি হারিয় ফেলে তাহলে ফসলের রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় । এমনকি মহামারী দেখা দিতে পারে । এন্টাগনিস্ট-এর শক্তি বৃদ্ধি করে এন ভারসাম্য পুনরায় স্থাপন করা যায় ।
বিভিন্ন পদ্ধতিতে এটা করা যায়। যেমন:
১। হাইপার প্যারাসিটিজম: এখানে এন্টাগনিষ্ট রাগজীবাণুর রোগ সৃষ্টি করে ।
২। আরোপিত প্রতিরোধঃ রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাশীল ভাইরাস স্ট্রেন অনুপ্রবেশের দ্বারা উদ্ভিদের প্রতিরোধ সৃষ্টি করলে পরবর্তীতে অধিকতর শক্তিশালী ভাইরাস ঐ গাছের রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। রোগ জীবাণু দমনের এ কৌশলকে Cross Protection বলে ।
৩। ব্যাকটেরিয়াও কাজ প্রয়োগ: ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী ভাইরাস প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস।
৪। ফাঁদ শস্য: কিছু শস্যের সংস্পর্শে আসলে কৃমি খাদ্যাভাবে মারা যায় । তিতা বেগুন জমিতে লাগালে কৃমির সংখ্যা কমে যায় ।
৫। বৈরিভাবাপন্ন গাছ: এসপারাগাস ও মেরিগাল্ডে প্রভৃতি গাছের মূল থেকে বিষাক্ত পদার্থ (পটাসিয়াম সায়ানাইড বের হয় বলে সংবেদনশীল শস্যের সাথে এদের মিশ্র ফসল চাষ করলে কৃমির সংখ্যা কমে যায় ।
৬। মিশ্র ফসল: পোষক ও অপোষক শস্য মিশ্র ফসল হিসাবে চাষ করলে অপোষক গাছ রোগজীবাণুর সহায়ক নয় বলে পোষাকের রোগের তীব্রতা কমে যায় ।
৭। বীজ বাহিত রোগ: এন্টাগনিস্ট ব্যাকটেরিয়া পাউডার বীজের সাথে মিশ্রিত করে বীজ বপন করলে বীজের পচন, চারার বাইট ইত্যাদি রোগ কমে যায় ।
৮। মাটির জৈব সংশোধন: সবুজ সার, করাতের গুঁড়া, হাড়ের গুঁড়া, সরিষার খৈল, ছাই ইত্যাদির দ্বারা মাটি পরিশোধন করলে মাটিতে উপকারী অনুজীবের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি পেয়ে ফসলের রোগের তীব্রতা কমে যায়।
পোকা দমনের মত উদ্ভিদ রোগের জৈবিক দমন এখনও কার্যকরীভাবে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ব্যবহৃত হচ্ছে না। কিনতু ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া হিসাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। যেমন- Trichodernoa harzianum নামক ছত্রাক ।
উদ্ভিদ নির্যাস দ্বারা রোগ দমন (Plant extract) উদ্ভিদের নির্যাস ব্যবহার করে উদ্ভিদের রোগ দমন একটি আধুনিক প্রযুক্তি । সাম্প্রতিককালে বাংলাদশেও উদ্ভিদ রোগ দমনে উদ্ভিদ নির্যাস সফলতার সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে । যেমন- রসুনের রস (পানি: রসুন = ১৪১ ) কিংবা মান্ডা
পাতার রস (পানি ও পাতা = ১ : ১) দ্বারা বীজ শাধেন করলে চযড়সড়ংরং বিহীধং অনেক বীজবাহিত ছত্রাককে দমন করা যায় ।
রোগ প্রতিরোধজাত ব্যবহার (use of disease Resistant variety)
রোগ প্রতিরোধী বলতে পোষাকের দ্বারা পরজীবির আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতোক বুঝায় । পাষকের এই ক্ষমতা নিজস্ব বংশ পরম্পরায় স্থায়ী । এটা জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উদ্ভিদের রোগ প্রতিরাধী ক্ষমতা প্রকট (dominant) ও রোগ সংবেদনশীল প্রচ্ছন্ন বিশিষ্ট। প্রকট জিন যে জাতে থাকে সে জাত রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা সম্পন্ন । বিভিন্ন পদ্ধতিতে (নির্বাচন, সংকরায়ণ, টিস্যু কালচার, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি) এ প্রকট “জিন” সংবেদনশীল জাতে স্থানান্তর করা যায়। রোগপ্রতিরোধী জাত ব্যবহারই হচ্ছে উদ্ভিদ রোগ দমনে উত্তম ও আধুি নক পন্থা ।
রাসায়নিক দমন (Chemicals Control) উদ্ভিদ রোগ সৃষ্টির পূর্বে বা পরে রোগনাশক প্রয়োগে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় । কার্যকারিতার উপর ভিত্তি করে রোগনাশককে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায় যথা
১) প্রতিরক্ষামূলক রোগনাশক ২) নিরাময়কারী রোগনাশক এবং অ্যান্টিবায়োটিক
প্রতিরক্ষামূলক (Preventive) রোগনাশক
এগুলো প্রতিরোধের লক্ষ্যে রোগাক্রমণের পূর্বে বা শুরুতে প্রয়োগকরা হয় । প্রতিরক্ষামূলক রোগনাশক অজৈব ও জৈব রাসায়নিক প্রকৃতির হতে পারে । রোগ দমনের ঔষধগুলোকে মোটামুটি পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায় । যথা- তাম্র- ঘটিত রোগ নাশক, গন্ধক ঘটিত রোগনাশক, জৈব রোগনাশক (ঔষধ), পারদ ঘটিত রোগ নাশক এবং ধুম্র উৎপাদক মাটি পরিশোধক। অধিকাংশ ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট রোগ ঔষধ প্রয়োগে দমন করা যায় । ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ ঔষধ ব্যবহারে তেমন ফল লাভ হয় না বরং বীজ পরিশোধন দ্বারা রোগ বিস্তার রোধ করা হয় । ভাইরাস রোগ আক্রান্ত গাছকে সুস্থ করার কোন ঔষধ নেই, কেবল মাত্র আক্রান্ত গাছকে ধ্বংস করে কীটনাশক ছিটিয়ে জাবপোকা, হপার প্রভৃতি দ্বারা রোগ বিস্তৃতি রোধ করা যায় । ভাইরাস হতে পরিত্রাণের লক্ষ্যে সুস্থ গাছ হতে বীজ নেয়ার ব্যবস্থা করা হয় । নেমাটোডজনিত রোগ ও অন্যান্য কোন কোন রোগের বেলায় মাটি পরিশোধন করতে হয় ।
সাধারণত আক্রান্ত গাছ কিংবা অঙ্গকে রক্ষা করা ও রোগকে সরাসরি দমন করার উদ্দেশে তাম্র ঘটিত, গন্ধক ঘটিত ও জৈব ঔষধ ছিটানোর ব্যবস্থা করা হয়। পারদ ঘটিত ঔষধ গুঁড়ার আকারে ডাষ্টিং এর কাজে ব্যবহার করা হয় বীজ শোধনের জন্য। ফিউমিগ্যান্ট বা ধুম্র উৎপাদক ঔষধ ব্যবহৃত হয় মাটি শোধনের জন্য । বোর্দোমিকচার সহ কয়েকটি ঔষধ নিজেরাই তৈরি করে নেয়া যায় । যে সব স্থানে বোর্দোমিকচারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে বোর্দো মিকচারের স্থানে অন্যান্য তাম্র ঘটিত ঔষধ যেমন কপার অক্সিক্লোরাইড, কপার-এ- কম্পাউন্ড, কুপ্রাভিট ও পেরেনকসের যে কোনটি প্রযোজ্য ।
উপরে বর্ণিত রোগনাশকগুলো গাছ বিশাষেন করেনা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা করলেও তা সর্বাঙ্গে ছড়ায় না । সাধারণত এগুলো স্থানীয় ভিত্তিতে কাজ করে। এগুলো গাছের রোগের আক্রমণ কমায় তাতে কোন সন্দেহ নেই ।
কিন্তু আক্রান্ত গাছকে রোগমুক্ত করে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে না কিছু কিছু রোগ-নাশক আছে যা গাছে বিশোষিত হয়ে সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে এবং গাছের দেহের মধ্যে জীবাণু থাকলে অথবা প্রবেশ করতে চেষ্টা করলে তাকে ধ্বংস করে এবং রোগ নিরাময় করে গাছকে সুস্থ করে। নিরাময়কারী রোগনাশক সিস্টেমিক বা সর্বাঙ্গবাহী, অক্সামিন, পিরাসিডিন ও বেঞ্জি মিডাজেল শ্রেণির, সিস্টেমিক প্রকৃতির অক্সামিন, ভিটাভেক্স ও পন্ট ভ্যাক্স। পিরামিডিন-মিলকার্ব, মিলটেক্স বেঞ্জিমিডাজেল - বেনামিল এবং ব্যাভিস্টিন অ্যান্টিবায়োটিক রোগনাশক- এটি অণুজীব থেকে উৎপন্ন এক প্রকার দ্রব্য যা অন্যান্য অণুজীবের ক্ষতি কারক। সিস্টেমিক রোগনাশকের ন্যায় এটিও সর্বাঙ্গীয় প্রকৃতির। স্ট্রেপটোমাইসিন, এগ্রিমাইসিন এক্টিডাওন, ব্লাস্টিসিডিন, কাসুমিন বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য অ্যান্টিবায়োটিক রোগনাশক ।
সমন্ধিত রোগ দমন (Integrated Pest Management ) - IPM
উদ্ভিদের সবগুলো রাগ দমন পদ্ধতি সমানভাবে কার্যকরি নয় এবং রাসায়নিক পদ্ধতি তাৎক্ষণিক কার্যকর হলেও রোগনাশক পরিবেশ দুষন করে । রোগ প্রতিরোধীজাত উন্নয়ন সময় সাপেক্ষ ও অন্যান্য পদ্ধতি ব্যয় বহুল । প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষিত না করে উদ্ভিদ রোগ দমনের সকল কার্যকর উত্তম পদ্ধতিগুলোর সমন্বয় সাধন করে রোগ দমনের যে পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা তাই সমন্বিত রোগ দমন। এতে থাকতে পারে সুস্থ সবল রোগ, জীবাণুমুক্ত বীজ ব্যবহার, পরিচ্ছন্ন ভাবে জমি তৈরি, আগাছা দমন, সুষম সার প্রয়োগ, রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার, , মাঠে রোগ দমনে কার্যকর রোগনাশকের ন্যূনতম ব্যবহার ও উপযুক্ত সময় ফসল উত্তোলন ।
ফল ও ফল গাছের রোগের নামগুলো বর্ণনা
ফল ও ফল গাছের প্রধান প্রধান রোগের নামের বর্ণনা প্রথম পত্রের অষ্টম অধ্যায়ের ৮.১ এ বিস্তারিতভাবে দেয়া হয়েছে।
ফল ও ফল গাছের রোগের লক্ষণ দেখে শনাক্তকরণ
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান ফল ও ফল গাছের রোগ ও রোগের লক্ষণ দেখে শনাক্তকরণের বিস্তারিত বিবরণ প্রথম পত্রের অষ্টম অধ্যায়ের ৮.২ এ দেয়া হয়েছে ।
রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা ব্যাখ্যা
ফল ও ফল গাছের প্রধান প্রধান রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বর্ণনা প্রথম পত্রের অষ্টম অধ্যায়ের ৮.৩ এ দেওয়া হয়েছে।
রোগনাশকের নাম ও প্রয়োগ মাত্রা
ফল ও ফল গাছের রোগ দমনের জন্য যে সকল বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেগুলোর নাম, প্রয়োগ মাত্রা এবং কোন কোন রোগের জন্য ব্যবহার করা হয় তার বিস্তারিত বর্ণনা প্রথম পত্রের অষ্টম অধ্যায়ের পৃষ্ঠা- ৭৪-৭৫ সারণি ১, ২ এ দেয়া হয়েছে ।
প্রধান প্রধান ফল গাছের প্রধান প্রধান রোগগুলোর নাম, লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো আমের-এনথ্রাকনোজ, স্যুটি মোল্ড, পাউডারি মিলডিউ ।
১. অ্যানথ্রাকনোজ (Anthracnose)
লক্ষনঃ পাতা ও কচি ডালে ফোসকা পড়ে। আক্রান্ত স্থানের তত্ত্ব ফেটে যায়। আক্রান্ত কচি ডাল ও পুষ্পদণ্ড কাল হয়ে শুকিয়ে ঝরে পড়ে। মুকুল কালো রং ধারন করে শুকিয়ে যায় পরিণত আমের গায়ে কাল দাগ পড়ে ।
প্রতিরোধ ও প্রতিকার ও আম বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। জানুয়ারি - ফেব্রুয়ারি মাসে ০.২ % ব্যাভিস্টিন টিল্ট (০.০৫) নোইন ভালকান ৭২ ডব্লিউপি (০.২%) ৩/৪ বার প্রে করলে এবং মার্চ- এপ্রিল ও আগষ্ট – সেপ্টেম্বর মাসে অনুরূপ স্প্রে করলে গুটি ও পরিপক্ক আমের আক্রমণ দমন করা যায় ।
২, রোগের নাম : পাউডারি মিলডিউ (Powdry mildew )
লক্ষণ: কচি পাতা ও পুষ্পমঞ্জরীতে পাউডারের মত গুড়া দেখা যায় । রোগের ব্যাপক তা বৃদ্ধি পেলে গাছের আক্রান্ত অংশ সাদা পাউডারে আবৃত হয়ে যায়। আক্রান্ত পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে। পুষ্প দণ্ড বা ফল দণ্ড শুকিয়ে যায় এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আগা মরা লক্ষণ দেখা দেয়।
কারণ: অইডিয়াম গিফেরি নামক ছত্রাক ।
প্রতিরোধ ও প্রতিকারঃ আম বাগান পরিষ্কার ও পরিছন্ন রাখতে হবে। ফুল আসার আগে ও পরে থিওভিট (০.৩%) সালফোটক্স (০.২%) টিস্ট (০.০৫%) ৩৪ বার ছিটালে এ রোগ দমন সম্ভব ।
৩. রোগের নাম (Shooty mould)
লক্ষণ: পাতার উপরি ভাগ কাল পাউডারের আবরণে ঢেকে যাওয়াই হচ্ছে এ রোগের লক্ষন । পোকা নিঃসৃত মধুতে ছত্রাক আটকে যায় । ঐ অবস্থায় ছত্রাক কর্তৃক উৎপাদিত প্রচুর কাল ভারে পত্রপৃষ্ঠে লেগে যায় এবং কাল আস্তরণের সৃষ্টি করে ।
কারণ: ক্যাপননাডিয়াম ম্যাংগিফেরি নামক ছত্রাক, জাব পোকা, হপার বা স্কেল পোকা যৌথভাবে স্যুটি মোল্ড রোগের সৃষ্টি করে ।
প্রতিরোধ ও প্রতিকার: ম্যালাথিয়ন (০.০৩%) এর সাথে ব্যভিষ্টিন বা গোল্ডেন এম ৪৫ (০.২%) মিশ্রিত করে ২/৩ বার ছিটালে পাতার কাল তর দূর হয় ।
কলার রোগ- সিগাটোকা, পানামা, গুচ্ছ মাথা
৪. রোগের নাম: সিগাটোকা (Sigatoka )
লক্ষণ: রোগের প্রথমদিকে ঈষৎ হলুদ থেকে সবুজাভ হলুদ বর্ণের ছোটদাগ বয়স্ক পাতার শিরার সমান্তরালে সৃষ্টি হয় । কালক্রমে পাতার দাগ আকারে বড় হয় ও গাঢ় বাদামি বর্ণ ধারণ করে পাতার কিনারা আক্রান্ত হয় এবং পাতা পোড়া বা ঝলসানো ভাব ধারণ করে ।
কারন: সারকোসপোরা মিউসি নামক ছত্রাক
প্রতিরোধ ও প্রতিকার
১. নির্দিষ্ট দুরত্বে গাছ লাগানো ও রোগমুক্ত সাকার ব্যবহারে এ রোগের আক্রমণ কমানো যায় ।
২. রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত ও বয়স্ক পাতা কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে ।
৩. বর্ষার প্রারম্ভে ও বর্ষার শেষে নিয়মিত টিল্ট (০.০৫%) বা ব্যাভিস্টিন (০.১%), ৩/৪ বার স্প্রে করলে সিগাটোকার আক্রমণ হ্রাস করা সম্ভব ।
(ii) রোগের নাম: পানামা (Panama or Fusarium with )
লক্ষণ: রোগের প্রথমে আক্রান্ত গাছের বয়স্ক পাতার কিনারায় হলুদ বর্ণের দাগ পড়তে থাকে । কালক্রমে পাতা সম্পূর্ণ হলুদ হয়ে যায় ও পরে বাদামি বর্ণ ধারণ করে। শেষে আক্রান্ত পাতার বৃত্তের মাঝখানে ভেঙে যায় এবং নিচের দিকে ঝুলে পড়ে।
কারণ: ফিউজেরিয়াম অক্সিসপোরাম নামক ছত্রাক
প্রতিরোধ ও প্রতিকার:
১। চারা লাগানোর আগে গর্তে ৫% ফরমালডিহাইড দ্বারা গর্তের মাটি নির্জীব ( শোধন) করতে হবে ।
২। চারা লাগানার পূর্বে হেক্টর প্রতি ২.২৫ টন চুন জমিতে ছিটিয়ে মাটির অম্লত্ব কমালে রোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা কমে যায়।
৩। আলু, টমেটো ও বেগুন ব্যতিত অন্য ফসলের সাথে শস্য পর্যায় অবলম্বন করে রোগের তীব্রতা কমানো সম্ভব।
(iii) রোগের নাম ও গুচ্ছ মাথা (Bunchy top)
লক্ষণ: এ রোগের প্রথম লক্ষণ হলো পাতায় গাঢ় সবুজের মধ্যে হালকা সবুজ বা অতি হালকা হলুদ রঙের ডোরা। পাতা ফ্যাকাশে হয় এবং গাছের মাথা থেকে একযোগে গুচ্ছাকারে বের হয়। পাতার আকার স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট এবং তলায়োরের মতো সোজা হয় । গাছের উচ্চতা ২-৩ ফুটের বেশি হয় না ।
কারণ: মাইকোপ্লাজমা ও জাব পোকা এ রোগ ছড়ায় ।
প্রতিরোধ ও প্রতিকার
১। রোগমুক্ত এলাকা ও গাছ থেকে চারা সংগ্রহ করতে হবে ।
২ । আক্রান্ত গাছ দেখলে তা তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে ।
৩। হেক্টর প্রতি ২-২.৫ মন চুন প্রয়োগে রোগের তীব্রতা কমায়
পেঁপের রোগ - মোজাইক, এনথ্রাকনোজ, কাল্ড বা গোড়া পচা ও চারা ঢলে পড়া
(i) রোগের নাম : পেঁপের মোজাইক (Papaya Mosaic )
লক্ষণ : সকল বয়সের গাছে মোজাইকের আক্রমণ ঘটে। গাছের শীর্ষ কচি পাতায় গাঢ় সবুজ বর্ণের জ্যাবড়া এলাকা একান্তভাবে হলুদাভ সবুজের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় পরিলক্ষিত হয়। আক্রান্ত পাতা ক্ষুদ্রাকৃতির ও কুকড়ে যায় । পত্র বৃত্ত দৈর্ঘ্যে হ্রাস পায় এবং শীর্ষ পাতা গুলো খাড়া হয়ে যায়। ফল ক্ষুদ্রাকৃতির ও বিকৃত হয়।
কারণ: পাপাইয়া মোজাইক ভাইরাস
প্রতিরোধ ও প্রতিকার
১। ভাইরাস মুক্ত গাছের ফল থেকে সংগৃহীত বীজ লাগানো ।
২। জাবপোকা দমনের জন্য ম্যালাথিয়ন/সুমিথিয়ন বা এনথিও ০.১% হারে পেঁপে গাছের ২ মাস বয়স থেকে ১৫ দিন অন্তর ৬-৭ বার স্প্রে করলে মোজাইকের তীব্রতা কমানো যায় ।
৩। আক্রান্ত জমিতে পেঁপে ও কুমড়া জাতীয় ফসল চাষ না করাই উত্তম ।
(ii) রোগের নাম: এনথ্রাকনোজ (Anthracnose): পেঁপের এনথ্রাকনোজ রোগ আমের বা পেয়ারার এনথ্রাকনোজ রোগের মত একই বৈশিষ্ট্যের।
(iii) রোগের নামঃ কান্ড বা গোড়া পচা ও চারা চলে পড়া (Stem or foot rot and Damping off) লক্ষণ: গোঁড়া পচা রোগ সাধারণত ২-৩ মাস বয়স্ক গাছে দেখা যায়। কাণ্ডের গোড়ার মাটি সংলগ্ন স্থানের ফর পড়ে যায় এবং আক্রান্ত অংশ গাঢ় বাদামি বা কাল হয়ে যায়। এ পচন কাণ্ডে ও নিচের দিকে সম্প্রসারিত হতে পারে । বাতাসের ধাক্কার গাছ উপড়ে পড়ে গিয়ে মরে যায় ।
প্রতিরোধ ও প্রতিকার
১। অপেক্ষাকৃত উঁচু ও পানি নিষ্কাশনের সুবন্দোবস্ত যুক্ত জমিতে নার্সারি করলে চারা ঢলে পড়া রোগের সম্ভাবনা কমে যায়।
২। নার্সারির মাটি ০.৫% ফরমালিন দ্বারা শোধন করে বীজ লাগানো উচিত।
৩। আক্রান্ত গাছের গোড়ার ০.১% সেপনিল স্প্রে করলে গোড়া পচা বন্ধ হয় ।
পেয়ারার রোগ-এনথ্রাকনোজ, উইলট
(i) রোগের নাম: পেয়ারার ফোসকা রোগ (Anthracnose)
লক্ষণ: সব বয়সের পাতায় ফোসকা পড়ে । প্রথমত পেয়ারার পায়ে ছোট ছোট দাগ পড়ে যা পরবর্তীতে বড় হয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে । ফলের ত্বক ছিড়ে যায় ও কালো হয়ে যায় । আক্রমণ বেশি হলে কচি ও পরিপদ ফল ফেটে যার এবং পরবর্তীতে পচে যায়।
কারণঃ কলেকটট্রিকাম সিডি, পেস্টালোটিওপসিস সিডি ও ট্রাইগুস্পিডিয়া থিওমি নামক তিনটি ছত্রাক দ্বারা এ রোগের বিস্তার ঘটে।
প্রতিরোধ ও প্রতিকার
১। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাগান
২। পেয়ারার কুড়ি আসার পূর্বে প্রাউড/টিস্ট(০.১%) বা ডারবেন, এম ৪৫ (০.২%) ১৫ দিন অন্তর ৪/৫ বার স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায় ।
(ii) রোগের নাম: পেয়ারার উইলট (Guava Wilt)
লক্ষণ: এ রোগের প্রধান লক্ষণ হলো গাছের আগা মরে যাওয়া
কারণ: মৃত্তিকা বাহিত ফিউজেরিয়াম অক্সিসপারোম এফ এসপি সিডি নামক ছত্রাক
প্রতিরোধ ও প্রতিকার
১। আক্রান্ত গাছে জিংক সালফেট দ্রবণ স্প্রে করা
২। ১% পটাশ স্প্রে করা
৩ । আক্রান্ত গাছের গোড়ার মাটিতে ০.২% রিডোমিল দ্রবণ ঢালা ।
কাঁঠালের রোগ: কাঁঠালের ফল পচা রোগ
(i) রোগের নাম: ফল পচা (Fruit rot of jack Fruit )
লক্ষণ: কচি ফল বা মুচি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। পানি সিদ্ধ কাল দাগ হিসেবে পুষ্প মঞ্জুরীর গোড়ায় বা মুচির বৃত্তে এ রোগের আবির্ভাব ঘটে। কালক্রমে দাগ বৃদ্ধি পায় এবং সম্পূর্ণ বৃত্ত ও মুর্চি কাল হয়ে যায় । আক্রান্ত পুষ্পমঞ্জুরী বা মুচি নরম হয়ে পড়ে ঝরে পড়ে ।
কারণঃ রাইযোপাস আরটোকারপি
প্রতিরোধ ও প্রতিকার
১। মরা পাতা, ডাল-পালা ইত্যাদি সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেললে ছত্রাকের সুপ্ত শক্তি কমে যায় ।
২। কচি ফল, পুষ্প মঞ্জরী ও পুরুষ ফুলে মৌসুমের প্রারম্ভে অর্থাৎ মার্চ মাসের গোড়ার দিকে ০.২% ডায়ানে এম-৪৫ বা ০.১% লোইন কিংবা এডিস্টিন/জেনুইন (০.২%) ১০ দিন অন্তর ৩/৪ বার স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যেতে পারে ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। আগা মরা রোগের ফল বা ফল গাছের কোন অংশ আক্রান্ত হয় ?
২। পাউডারি মিলডিউ রোগে ফল ও ফল গাছের কোন অংশ আক্রান্ত হয় ?
৩। ঢলে পড়া রোগের লক্ষণ কী ?
৪ । পানামা রোগের লক্ষণ কী ?
সংক্ষিত প্রশ্ন
১। আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও কাঁঠালের পচা রোগের লক্ষণগুলো লেখ ।
২। কলা, পেঁপে ও পেয়ারার প্রত্যেকের ৩টি করে রোগের নাম লেখ ।
৩ । পেয়ার ক্যাংকার ও কুলের পাউডারী মিলডিউ রোগের দমন পদ্ধতি লেখ ।
৪ । ডাইব্যাক রোগের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর ।
৫। আমের স্যুটি মোল্ড কি বর্ণনা কর ।
৬। পেঁপে গাছের মোজাইক রোগ সম্বন্ধে লেখ ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১ । আম, কাঁঠাল কলা, পেঁপে ও পেয়ারা প্রত্যেকটির ১টি করে রোগের নাম, কারণ ও লক্ষণ বর্ণনা কর ।
২। ফল ও ফল গাছের রোগ কীভাবে নির্ণয় করা যায় । বাংলাদেশে প্রধান তিনটি ফলের ও ফল গাছের রোগের লক্ষণ ও দমন ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখ।
৩। পেঁপের কাণ্ড পচা রোগের কারন, বিস্তার ও তার প্রতিরোধ ও প্রতিকার বর্ণনা কর ।
৪ । কাঁঠালের ফল পচা রোগের লক্ষণ, রোগের কারণ ও প্রতিরোধ এবং প্রতিকার বর্ণনা কর ।
৫। কলার পানামা রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার বর্ণনা কর ।
৬ । ফলের প্রধান প্রধান ১০টি রোগের নাম, ফসলের নাম ও কারণ লেখ ।
৭ । ফল ও গাছে রোগাক্রমণের লক্ষণ দেখে আম, কাঁঠাল পেপে, কলা ও পেয়ারার প্রত্যেকর ২টি করে রোগ শনাক্ত করার পদ্ধতি লেখ ।
৮। বাংলাদেশে ব্যবহার হয় এমন ১০টি রোগনাশকের নাম ও রোগের নাম এবং প্রয়োগ মাত্ৰা লেখ ।
ফসলের লাভজনক ফলন এবং তার গুণাগুণ শুধু উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে না। সাথে সাথে সঠিক সময়ে ফসল সংগ্রহ এবং সংগ্রহ প্রনালীর ওপরও তা অনেকটা নির্ভর করে। ফসল সংগ্রহ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফলকে উৎপাদন পর্যায় হতে ব্যবহারিক পর্যায় আনা হয় । যত্নের সাথে এ কাজের তদারকি এবং সঠিক সময়ে ফসল সংগ্রহের ফলে আমরা পাই আর্থিক মূল্য সম্পন্ন গুণগতমানের ফসল এবং এর বর্ধিত খাদ্য উপাদান । ফল অক্ষত অবস্থায় দীর্ঘদিন সংরক্ষনের জন্য এবং উৎকৃষ্ট মানের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য দ্রব্য তৈরি করার জন্য ফসল যথা সময়ে সতর্কতার সাথে সংগ্রহ করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারের লক্ষ্য অনুযায়ী ফসল যখন নিজ নিজ জাতের সর্বোৎকৃষ্ণ আকার, রং, স্বাদ এবং গুণাগুণ অর্জন করে । তখনই ফসল সংগ্রহ করা উচিত। অপরিপক্ক ফল সংগ্রহ করলে যেমন গুণাগুণ বজায় থাকে না তেমনি চাষী ফলের ন্যায্য মূল্য পায়না। আবার বেশি পরিপক্ক হলেও গুনগত মান তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে ফল দ্রুত পচায় । ফলে বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। ফলের পরিপক্কতা এমন একটি অবস্থা যখন ফলের আকার ও আয়তন এবং বয়সের সর্বশেষ অবস্থা, অর্থাৎ এরপর ফলের আকার ও আয়তন আর বৃদ্ধি পায় না । ফল পাকার অর্থ হলো পরিপকৃতার পর ফলের গুণাগুণের এমন পরিবর্তন, যার মাধ্যমে ফল ভক্ষণযাগ্য বা খাবার উপযোগী হয় । ফল পাকার সাথে সাথে ফলের রং, গন্ধ ও বুনটের পরিবর্তন হয় যার দরুণ ফল ভোক্তার নিকট গ্রহণযোগ্য হয় ।
ফলের পরিপক্বতা
ফলের পরিপক্বতা এমন একটি অবস্থা যখন ফল আকার, আয়তন এবং বয়সে সর্বশেষ অবস্থায় পৌছে অর্থাৎ এর পর ফল আর আকার ও আয়তনে বৃদ্ধি পায় না। কিছু লক্ষণ দেখে ফলের পরিপক্বতা নিরূপণ করা যায় । এই লক্ষণগুলো কে ফলের পরিপকৃতার লক্ষণ বা (Maturity Index) বলা হয়। ফল ধারণ থেকে দিবস সংখ্যা, আকার, আকৃতি, রং, বুনট, আপেক্ষিক ঘনত্বের পরিমাণ, দ্রবণীয় শক্ত পদার্থ, চিনি, অম্লে হার এবং চর্বির পরিমান ইত্যাদি পরিপক্বতার লক্ষণ হিসেবে চিহ্নতি করা হয় । ফল সংগ্রহের পূর্বে ফলের পরিপক্বতা দেখে সংগ্রহ করা উচিত। ফল সংগ্রহের সময়ের ওপর নির্ভর করে ফলের বাহ্যিক সতেজতা, ফলের স্বাদ, গুণাগুণ, গন্ধ ও আকার ইত্যাদি । ফল বর্ধনের তিনটি ধাপ । বিদ্যমান । যেমন:
১। বাড়ন্ত (ফুল হতে গুটি ধারণ করে উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত)
২। পরিপক্কতা (ফল উপযুক্ত হওয়ার পর সংগ্রহ করার পর্যায়ে পৌঁছা পর্যন্ত) এবং
৩। পরিপক্কতার পর পেকে উঠা বা ফিজিওলোজিক্যাল ম্যাচুরিটি ।
ফল তালোর জন্য ফলের পরিপক্কতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা । কারন ফল পাকা অবস্থাতেই খাওয়ার উপযুক্ত হয় । উদাহরণ- কলা, জাম, আনারস, পেয়ারা, বেল, পিচ, আংগুর, লিচু ইত্যাদি, একমাত্র পরিপক্ক অবস্থাতেই খাওয়া যায় ।
ফলের মধ্যে এমন অনেক ফল আছে যে গুলোর শ্বসন, কাজ ফল ভালোর পর বন্ধ হয়ে যায় । শ্বসন কাজ বন্ধ হওয়ার ফলে তার মধ্যে সঞ্চিত শর্করা বা শ্বেতসার থেকে চিনিতে রূপান্তর ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। যেমন- আংগুর, লেবু, জাম্বুরা, লিচু, ইত্যাদি।
আবার ফলের মধ্যে এমন অনেক ফল আছে যেগুলোর শ্বসন কাজ ফল তালার পরও চলতে থাকে। এমনকি ফলের পরিপক্কতার সাথে সাথে শ্বসন কাজ বাড়তে থাকে এবং ফলের মধ্যে সঞ্চিত শর্করা বা শ্বেতসার চিনিতে রূপান্তরিত হতে থাকে । যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে বেল, কামরাঙ্গা, আমড়া, ইত্যাদি । তাই এ জাতীয় ফল পরিপক্ক অবস্থা হতে খাওয়ার উপযোগী বা উপযুক্ত হওয়ার সময়ের মধ্যে পাড়তে হবে। এরপর পরিবহন ও বাজারজাতকরণের কাজ দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতে হবে।
ফলের পরিপক্বতা এমন একটি অবস্থা যখন ফল, আকার, আয়তন, রং এবং বয়সের সর্বশেষ অবস্থায় পৌঁছে এবং তারপর আর আকার ও আয়তনে বাড়ে না । বিভিন্ন লক্ষণ দেখে ফলের পরিপক্বতা নিরূপণ করা হয় । বিশেষ অবস্থায় ফলের পরিপক্বতা নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য । যেমন -
ক) বাড়ন্তবস্থায় ফল রোগাক্রান্ত হলে অপরিপক্ক অবস্থায় পরিপক্ক ফলের মত রং ধারণ করে ।
খ) জমিতে রস ও পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি থাকলে অপরিণত বয়সের ফল পরিপক্ক দেখায় ।
গ) জমিতে রসের ও পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বেশি থাকলে এবং তাপমাত্রা কমে গেলে ফলের পরিপক্বতা বিলম্ব হয় ।
ঘ) পোকা মাকড়ের আক্রমণ হলে ফল অপরিণত বয়সে পেকে যায়
ঙ) হঠাৎ অতিরিক্ত ঠান্ডা আবহাওয়ায় পরিণত বয়সেও ফল পরিপক্ক হয় না ।
ফলের পরিপক্বতা নিরূপণ করা যায় দু'ভাবে যথা-
১। বাহ্যিক অবস্থা দেখে ও
২। অভ্যন্তররীণ পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে
১ । বাহ্যিক অবস্থা - ফল ধারণ থেকে দিনের হিসাব, ফলের আকার ও আকৃতি, ফলের রং, ফলের ওজন, ফল শক্ত বা নরম, ফলের ত্বকের গন্ধ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে ।
২। অভ্যন্তররীণ - শর্করা বা শ্বেত সারের পরিমান, মিষ্টতার পরিমাণ, ফলের কষ বা রসের ঘনত্ব, বীজের পরিপুষ্টতা, ভক্ষণযোগ্য অংশের ঘনত্ব (শক্ত বা নরম অবস্থা), আঁশের পরিমাণ, আশের দৃঢ়তা ও স্পষ্টতা ইত্যাদি পর্যবেক্ষন করে ।
ফল সংগ্রহের বিভিন্ন পদ্ধতি:
মানুষের শরীর সুস্থ, সবল ও রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে ফলের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ । ফলের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য সঠিক সময়ে গাছ থেকে ফল পাড়া অতীব জরুরি ।
ফলের ভালো ফলন এবং তার গুণাগুণ শুধু উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদের ওপর নির্ভর করে না । সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে ফল সংগ্রহ করার ওপরও ফলের গুণাগুণ এবং লাভ নির্ভর করে । অনেক সময় অনেক বেশি মূল্যে বিক্রির জন্য কাঁচা ফলই বাজারে উঠায় । এটা মোটেই উচিত নয় । মাঝে মাঝে কাঁচা ফলকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পাকা রঙ ধারন করায়ে বাজারে বিক্রয় করে । এতে অনেকে প্রতারিত হয় । লোকে জানাজানি হলে এ ধরনের ফল আর ক্রয় করতে চায় না । এতে উৎপাদক, বিক্রেতা, দেশে সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হয় । তাই ফল এমন অবস্থায় পড়তে হবে যাতে পাড়ার পর অতি অল্প সময়ে পাকে এবং কেউ প্রতারিত না হয় ।
ফল তরতাজা রাখার জন্য সংগ্রহের সময় বিশেষ যত্নবান হতে হবে । সংগ্রহের সময় ফল ক্ষতিগ্রত বা আঘাত প্রাপ্ত হলে বাজার মূল্য ও পুষ্টিমাণ কমে যায় । অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে আর্থিক ক্ষতি হবে । তবে ফলের মান বজায় রাখার জন্য পরিপুষ্ট অবস্থায় ফল সগ্রহ করা উচিত । ফল সংগ্রহের জন্য কিছু উপকরণের প্রয়োজন হয়, যেমন- কাঁচি, ছুরি, মই, রশি, ব্যাগ, ধারালো দা ইত্যাদি । ফল সংগ্রহের প্রাককালে নিম্নোক্ত বিষয়াদি বিবেচনায় রাখতে হবে যেমন-
ক) ফলের পরিপক্বতার উপযুক্ত বয়সে সগ্রহ করতে হবে ।
খ) পরিষ্কার আবহাওয়ার সময় ফল পাড়তে হবে ।
গ) ফল পাড়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে ফল আঘাত না পায় বা থেতলে না যায় ।
ঘ) সাবধানতার সাথে ফলগুলো এক জায়গায় জড়ো করতে হবে ।
ঙ) ফল জড়ো করার স্থানটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও ছায়াযুক্ত হতে হবে ।
চ) ফল পাড়ার জন্য ব্যবহৃত উপকরণ ও যন্ত্রপাতি ভালভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে ।
সাধারণত দু'ভাবে ফল সংগ্রহ করা যায় । যথা-
১ । হাত দিয়ে তোলা বা পাড়া এবং
২। মেশিনের সাহায্য পাড়া
১ । হাত দিয়ে তোলা বা পাড়া- উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই বেশির ভাগ ফল সতেজ অবস্থায় বিক্রির জন্য হাত দিয়ে পাড়া হয় । হাত দিয়ে ফল পাড়ার কতগুলো সুবিধা আছে । যেমন
হাত দিয়ে পাড়ার অসুবিধাগুলোঃ
২। মেশিনের সাহায্যে ফল পাড়া ও হাত দিয়ে ফল পাড়া বেশি পছন্দনীয় হলেও অনেক সময় মেশিনের সাহায্য ফল সংগ্রহ করতে হয় । মেশিনের সাহায্যে ফল সংগ্রহের কতগুলো সুবিধা আছে ।
যেমন সুবিধাগুলো
মেশিনে ফল পাড়ার অসুবিধাগুলো
ফল পাড়ার সময় বা ছিড়ার সময় যে সব ফল আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেগুলো কাঁচি দিয়ে কেটে পাড়া উচিত । যে সব ফল হাতের নাগালের মধ্যে থাকে না সে গুলো গাছে উঠে অথবা জালি বাঁধা বাশের লাঠির সাহায্যে পাড়া উচিত । তাতে লাঠির মাথার জালির মধ্যে করে আস্তে আস্তে ফল পাড়া যায়। আবার লাঠির মাথায় ছুরি বা কাচি বেধে বোটা কেটে ফল পাড়া যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে ফল যে পাড়তে উঠে তার কাঁধে থলে বা ঝুড়ি ঝুলায়ে রাখলে সুবিধাজনক হয় ।
ফল পাড়ার আগে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে যে ফল কি উদ্দেশ্য পাড়া হচ্ছে। কেননা আচার বা টক জাতীয় খাদ দ্রব্য হিসেবে ফল সংরক্ষণ করতে হলে অপরিপক্ক অবস্থায় অনেক সময় ফল পাড়তে হয়। অন্যদিকে জুস জাতীয় খাদ্য দ্রব্য তৈরি করতে হলে বেশি পাকানোর প্রয়োজন হয় । ফল টাটকা অবস্থায় দূরে পাঠাতে হলে সম্পূর্ণ পরিপুষ্ট অবস্থায় পড়তে হয়। অনেক সময় বেশি দুরে পাঠাতে হলে ফল পাকার ৪-৫ দিন আগেও পাড়তে হয় । ফল পরিপুষ্ট হলে বিভিন্ন ফলের জাত বিশেষে সর্বোৎকৃষ্ট আকার রং, স্বাদ গন্ধ এবং গুণাগুণ অর্জন করে । আর তা ক্রেতার নিকট সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য হয়। ফল পাড়ার পূর্বে বিবেচ্য বিষয় বা গাছ থেকে ফল পাড়ার সর্তকতা :
১। পুষ্টতা সঠিকভাবে নির্ধারণে করে ফল পাড়ার কাজ শুরু করতে হবে । কারণ অপুষ্ট ফল পাড়লে তা ঠিকমত পাকে না এবং স্বাদ, রং, সুবাস ইত্যাদির ঠিকমতো উন্নয়ন ঘটে না ।
২ । ফলের যাতে কোন ক্ষতি না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ফল সংগ্রহের কাজে শ্রমিকরা সতর্কতা ও দক্ষতার সাথে কাজ করছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। এ ছাড়া গাছে ঝাঁকি দিয়ে ফল পাড়া ঠিক নয় ।
৩। গাছ মোচড়ানো, ফল মাটিতে ফেলে দেয়া, ফলের গায়ে আঘাত দেয়া, ফলের গায়ে মাটি লাগানো, সংগৃহীত ফলে সূর্যের তাপ লাগানো পরিহার করতে হবে ।
৪ । ফল বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এতে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয় ।
৫। গাছ থেকে ফল পাড়ার পর দীর্ঘক্ষন তা গাছের নিচে জমা করে রাখা ঠিক নয়। কারণ বাতাসে ভাসমান রোগের জীবাণু এ সময় আমের বোটায় আক্রমণ করার সুযোগ পায় ও বোটা পচা রোগের সৃষ্টি করে ।
৬ । সকাল বেলা ফল পাড়া ভালো, কারণ তখন আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে বৃষ্টি বাদলার দিনে ফল পাড়া পরিহার করতে হয়।
৭। কিছু বেটাসহ ফল সংগ্রহ করা ভালো । আমের ক্ষেত্রে ৩-৪ সে:মি: বোটাসহ আম পাড়তে পারলে বোটা পচা রোগের প্রকোপ অনেক কমে যায়। অবশ্য গাছ ছোট হলে এ কাজ সহজ হয়।
৮ । ফল পাড়ার জন্য সব সময় ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে। ছোট গাছের ফল পাড়ার জন্য সিকেচার ব্যবহার করা সুবিধাজনক ।
৯ । প্রত্যেক ফলের বোটায় একটি নরম জায়গা থাকে, সেখানে চাপ দিলে বোঁটা সহজেই ভেঙে যায় ।
১০ । আম পাড়ার পর কিছুক্ষণ উপুড় করে রাখা ভালো, এতে ফলের আঠা আমের গায়ে লাগতে পারে না ।
ফল বাছাইকরণ
ফল গাছ হতে সংগ্রহ করা সব ফল একই মান ও আকার সম্পন্ন হয় না । একই জাত অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও ফল আকার আকৃতিতে বিভিন্ন ধরনের হয় । এদের মাঝে আবার কতগুলো রোগাক্রান্ত বা পোকায় খাওয়া হতে পারে । উলিখিত সব ধরনের ফল মিশ্রিত অবস্থায় বাজারজাত করার পূর্বে ফলকে বাছাই বা শ্রেণিভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন । আকার আকৃতি ও অন্যান্ন গুণাগুণ বিবেচনায় বাজারজাত করা হলে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে ফলের দাম নির্ধারন সহজতর হয় । এতে করে ক্রেতা তার পছন্দ মত ফল ক্রয় করে সন্তুষ্টি হতে পারে। ফলের উৎপাদিত অঞ্চল হতে দূরবর্তী কোন অঞ্চলে প্রেরণের উদ্দেশ্য থাকলে ফলের পরিপক্কতার মাত্রানুযায়ী বাছাই করে পৃথক পৃথক বাক্সে পাঠানো প্রয়োজন । এতে ফল নস্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে ।
ফল সংগ্রহকালীন সময় হতে শুরু করে বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কমবেশী ফল বাছাই সম্পন্ন হয় ।
পরিপক্ব হওয়ার পর একই গাছ হতে সংগ্রহ করা ফল একইরকম গুণ সম্পন্ন হয় না । কেননা একই গাছের সব ফল এক সাথে বড় হয় না এবং একই আকৃতির হয় না। একই সাথে পরিপুস্ট হয় না এবং একই সাথে পাকেও না । এমন কি পাকার সময় একই ধরনের রংও ধারণ করে না। একই গাছের বা একই জাতভুক্ত গাছের ফল কতগুলো রোগাক্রান্ত, পোকায় খাওয়া বা শারিরিকভাবে বিকৃত হতে পারে । এমন কি একই গাছে ফুল ও ফল হওয়ার সময় যে অংশ রোদ বা আলো বাতাস বেশি পায় সে অংশের ফলের মধ্যে একধরনের পরিবর্তন দেখা দেয় । আবার গাছের ভেতরের দিকের বা ডালপালার ছায়ায় যে সব ফল হয় সেগুলোর মধ্যে অন্য ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। গাছের যে অংশে রোদ ও আলাবাতাস বেশি পায় সে অংশের ফল সাধারণত রোদ পোড়া, উজ্জ্বল রং বা ফলের ত্বকে ফোটা ফোটা তিলের মত দাগ ইত্যাদি পাওয়া যায়। এ ফল গুলো আগে পাকে এবং বেশি মিস্টি হয়। গাছের ভিতরে বা ছায়ায় যে ফলগুলো হয় সেগুলো সাধারণত আকারে বড় হয়, ফল ও জাত বিশেষ রং সবুজ বা কোমল হয় এবং মিষ্টতা কম হয় ।
পাড়ার পর সমত ফল একত্রে মিশানো অবস্থায় না রেখে বড়, ছোট, রোগাক্রান্ত বা পোকায় খাওয়া, অপরিপক্ক, শারীরিক ভাবে বিকৃত, রং ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে বাছাই করে শ্রেণি বিভক্ত করা উচিত । তাছাড়া ভালো ফলের আকর্ষণীয়তা ফুটে উঠেনা। ফল দেখতে সুন্দর না হলে তা দাম দিতে আগ্রহী হয় না। তাই ফল জারে পাঠানোর আগে বাছাই করে শ্রেণি বিভক্ত করা একান্ত প্রয়োজন । খারাপ ফলগুলোকে স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করা যেতে পারে। ফল বাছাই করনের সময় উ”চমান সম্পন্ন ফলের সাথে নিম্ন ৫-১০ মিশ্রণ গ্রহণযোগ্য বলে ধরা যেতে পারে। সাধারনত আকার, আকৃতি, রং, পরিপক্কতার মাত্রা, রোগাক্রান্ত, পোকা খাওয়া ইত্যাদির উপর নির্ভর করে ফল বাছাই করা হয়ে থাকে। খারাপ ফলগুলোকে ফলজাত দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা । যেতে পারে। ফল বাছাই দু'ভাবে করা যায় । যথা-
ক) হাতের সাহায্যে এবং
খ) মেশিনের সাহায্যে
ক) হাতের সাহায্যে ফল বাছাই করতে হলে ফল হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে ফলের আকার নির্ণয় করা হয় । চোখে দেখে ফলের আকার ও রং অনুমান করে শ্রেণি বিভক্ত করা হয় । অনেক সময় হাতে নিয়ে ফলের ওজন নির্ণয় করা হয় । ফল শক্ত কেমন তা হাতে ধরে অনুমান করা হয় । তবে এ কাজটি ফল ভেদে বিভিন্ন রকম হতে পারে । গাছ হতে পাড়ার পর সব ফল একই রকম পাওয়া যায় না। কোনটি হালকা হলুদ, কোনটি গাঢ় সবুজ, কোনটি বড়, কোনটি ছোট, কোনটি খুব শক্ত এবং ওজন বেশি আবার কোনটি তেমন শক্ত নয় এবং ওজনে হালকা, কোনটি রোগ ও পোকা মাকড়ে আক্রান্ত কোনটি পাড়ার সময় আঘাত প্রাপ্ত বা থেতলানা, আবার কোনটি সুস্থ ও সতেজ, কোনটি মিষ্টি ঘ্রান যুক্ত, আবার কোনটির কোন ঘ্রান নাই ইত্যাদি । হাতের সাহায্যে ফল বাছাই করলে বাছাই কাজটি অনেকাংশেই নিখুত ও ভালো হয় ।
খ) মেশিনের সাহার্যে বাছাই করতে হলে ফল বাছাইয়ের আকৃতি নির্ধারণী রিং ব্যবহার করা হয় । ফল ভেদে বিভিন্ন মাপের নির্ধারণী রিং হতে পারে। যেমন- ৬০, ৬৪, ৭০, ৭৫, ৮০, ৮৫ সে:মি: সাইজের রিং, মেশিনে ফল বাছাই ও গ্রেডিং সহজে এবং দ্রুত করা যায়। কিন্তু কোন ফল থেতলানো বা রোগ ও পোকামাকড়ে আক্রান্ত থাকলে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে হাতে আলাদা করে নিতে হয় । এমনকি ফলের গায়ে ময়লা থাকলে তা হাত দিয়ে আলাদা করে নিতে হয় । মেশিনে বাছাই করা ফল কনভেয়ারের মাধ্যমে বিভিন্ন আকারের প্যাকিং বাক্সে স্থানান্তরিত হয়, যা আগে হতে নির্ধারণ করা থাকে ।
ফল বাছাইকরণের সুবিধা
১। বিভিন্ন আকারের ফল আলাদা আলাদা করা থাকে, তাই দাম নির্ধারণ করা সহজ হয় ।
২ । আঘাতপ্রাপ্ত, রোগ ও পোকামাকড়ে আক্রান্ত ফল আলাদা আলাদা থাকে, তাই ফল নষ্ট হয় না ।
৩ । ফল বাছাই করার জন্য শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয় ।
৪ । বিভিন্ন আকারের ফল বিভিন্ন প্যাকিং বাক্সে সর্বোচ্চ সংখ্যায় সাজানো হয় ।
৫। প্যাকিং-এর জন্য ব্যবহৃত প্যাকেজের সংখ্যা দেখে ফলের সংখ্যা নিরূপণ করা হয় ।
৬। ফল বাছাই করনের মাধ্যমে ফলের মান নির্ণয় করা সহজ হয় ।
৭ । ফলের আকার এবং পরিপকৃতার ওপর নির্ভর করে সিধান্ত গ্রহণ করা যায় যে তা দূরে পাঠানো যাবে কিনা । কেননা বড় ফলের সাথে ছোট ফল একত্রে থাকলে বড় ফলের চাপে ছোট ফল নস্ট হতে পারে ।
ফল বাছাইকরণে সতর্কতা বা ফল বাছাইয়ের পূর্বে বিবেচ্য বিষয়
১ । ফল বাছাই করনের স্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর, ঠান্ডা, ছায়াযুক্ত ও যথেষ্ট বাতাস চলাচল সম্পন্ন হতে হবে।
২। ফল বাছাইকরণের সময় ভাল ফলের সাথে আঘাত প্রাপ্ত, রোগাক্রান্ত বা পোকামাকড়ে আক্রান্ত ফল একত্রে রাখলে নষ্ট ফল দ্রুত পঁচে তা ভালো ফলকে নষ্ট করতে পারে। ভালো ফল এবং নষ্ট ফল পৃথক পৃথক রাখতে হবে ।
৩। বাছাই করার সময় ফল একজায়গা হতে অন্য জায়গায় ছুড়ে না ফেলে আস্তে আস্তে রাখতে হবে ।
৪ । বাছাই করার সময় নিচে চট বা নরম জিনিস বিছায়ে নিয়ে তার উপর ফল নাড়াচাড়া করা উচিত । তাতে ফল কম আঘাত পাবে ।
৫ । যতদূর সম্ভব কম সংখ্যক ফল একত্রে স্তূপ করা উচিত । কেননা বেশি উঁচু করে ফলের স্তূপ করা হলে চাপে নিচের ফল নষ্ট হতে পাবে ।
৬। বাছাই করার সময় উচ্চমান সম্পন্ন ফলের সাথে নিম্নমানের ফলের ৫ থেকে ১০ ভাগের বেশি যেন মিশ্রণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ফলের আকার অনুযায়ী গ্রেডিং
বাছাই এর পর ফলের আকার ও মান অনুযায়ী ফল শ্রেণিবিন্যাস করতে হবে । কারন ভালো আকার ও ভালো মানের ফল বেশি অর্থায়নে সাহায্য করে। বৃহৎ ও উৎকৃষ্টতর গুণসম্পন্ন ফল পায় সর্বদাই ক্ষুদ্র ও নিকৃষ্ট ফল অপেক্ষা অধিক অর্থ আনায়ন করে থাকে । সর্ব আকারের ও প্রকারের ফলকে একই সঙ্গে না রেখে ও গুলোকে আকার ও গুণ অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে নিলে বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ের পক্ষেই সঠিক মূল্য নির্ধারণে সুবিধা হয় এবং তাতে কারোরই ঠকবার সম্ভাবনা থাকে না । সুতরাং বিক্রয়ের জন্য ফল বাক্সবন্দী করা অথবা স্থানান্তরিত করনের পূর্বেই সেগুলোকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে নেওয়া উত্তম। একই বস্তা, ঝুড়ি বা বাক্সের নীচে ছোট এবং উপরে প্রদর্শনের জন্য বড় আকারের ফল রাখার প্রথাটি একান্তভাবে বর্জনীয় ফলকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট মানে বিভক্ত করন (Standardization) একটি উত্তম পদ্ধতি ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। একমাত্র পরিপক্ক অবস্থাতেই খাওয়া যায় এমন তিনটি ফলের নাম লেখ ।
২। অপরিণত বয়সের ফল পরিপক্ক দেখায় কি কারণে?
৩। বেল ফুল ধরা হতে পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত কত দিন লাগে ?
৪ । উচ্চমান এবং নিম্নমান সম্পন্ন ফলের মিশ্রণ কত ভাগ পর্যন্ত গ্রহণ যোগ্য ?
৫ । বাজারে সাধারনত কোন কোন মাপের ফল গ্রেডিং নির্ধারণী রিং পাওয়া যায় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ফল বাছাইকরণে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় লেখ।
২ । ফলের পরিপকৃতার লক্ষণ কাকে বলে ?
৩। ফলের পরিপক্কতার ও পাকার মধ্যে পার্থক্য কী ?
৪ । গ্রেডিং কেন করা হয় ?
৫ । ফল বাছাইকরণের সুবিধাগুলো লেখ ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ফল বর্ধনের ধাপ গুলো কি কি এবং কোন কোন অবস্থায় ফলের পরিপক্বতা নিরূপণ করা হয় লেখ ।
২ । ফল সংগ্রহ, বাছাই ও বাজারজাতকরণ সংক্ষেপে আলোচনা কর ।
৩ । ফল কিভাবে সংগ্রহ করা যায় এবং ফল সংগ্রহের বিভিন্ন পদ্ধতির সুবিধা অসুবিধা আলোচনা কর ।
৪ । ফলের পরিপক্বতা কিভাবে নিরূপণ করা যায় ? আম, কাঁঠাল ও পেয়ারার পরিপক্কতা পদ্ধতি বর্ণনা কর ।
৫। বোর্দো মিকচারের প্রস্তুত প্রনালি বর্ণনা কর ।
লিচু চাষাবাদ কৌশল লিচু মধ্যম আকৃতির দ্বিবীজ পত্রী, চিরহরিৎ ও বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ । আমাদের অনেক পরিচিত ও প্রিয় ফলের মধ্যে লিচুর এক বিশেষ স্থান রয়েছে। রূপে, গুনে ও স্বাদে লিচু একটি আকর্ষণীয় ও উপাদেয় ফল । আমাদের দেশে লিচু একটি অন্যতম জনপ্রিয় ফল। এতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ, শর্করা জাতীয় খাদ্য ও ভিটামিন সি থাকায় লিচু একটি পুষ্টিকর ফল ও ঘটে। এতে ভিটামিন এ, বি১ ও বি২ উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে বিদ্যমান। লিচু গ্রীষ্ম প্রধান ও অগ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলের ফল । বাৎসরিক বৃষ্টিপাত ১৫০ মিমি ও বাতাসের আপেক্ষিক আদ্রতা ৭০-৮০ % লিচু চাষের জন্য উপযোগী।
জাত - বাংলাদেশে চাষ কৃত লিচুর উৎকৃষ্ট জাতগুলো হলো- বোম্বাই, বেদানা, মুজাফফরপুর, এলাচিরোজ, দুধিয়া, চায়না - ৩ ইত্যাদি । বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট বারি লিচু-১, বারি লিচু-২, এবং বারি লিচু-৩ নামে ৩টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে ।
বংশবিস্তার-বীজ থেকে ও অঙ্গজ পদ্ধতিতে লিচুর চারা তৈরী করা যায় । বীজ থেকে উৎপাদিত চারার ফল পেতে ৭-১২ বছর সময় লাগে। চারা উৎপাদনের জন্য গুটি কলম সর্বাধিক উপযোগী। গুটি কলম হতে উৎপাদিত চারা হতে ৩-৪ বছরের মধ্যেই ফল ধরে।
মাটি ও জমি নির্বাচন
লিচু গাছ বিভিন্ন ধরনের মাটিতে জন্মাতে পারে যদি তা পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত থাকে । প্রচুর জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ সুনিষ্কাশিত গভীর বেলে দোঁআশ মাটি লিচু চাষের উপযুক্ত। বেলে মাটি লিচু চাষের জন্য অনুপযুক্ত । কেউ কেউ বলেন লিচু ক্ষার মাটিতে ভালো হয় । তাই অনেকে লিচুর বাগানে চুন ব্যবহার করে থাকেন। মাটি খুব বেশি অল্প বা খুব বেশি ক্ষার হলে গাছের জন্য ক্ষতিকর । ৬.৫-৬.৮ পিইচ সম্পন্ন মাটিতে লিচু ভালো হয় । সামান্য অম্লীয় মাটিতে মাইকোরাইজা উৎপন্ন হয় যা লিচু গাছের জন্য উপকারী। নতুন চারা গাছের গোড়ায় পুরাতন লিচু গাছের নিচের কিছু মাটি প্রয়োগ করলে মাইকোরাইজা সৃষ্টি হয় ।
গাছ রোপণের জন্য জমি ও গর্ত তৈরি
বাড়ীর আশেপাশে বা বসতভিটায় দু'একটি গাছ রোপণ করতে চাইলে জমি তৈরির প্রয়োজন নেই । গাছ রোপণের গর্তগুলো (Planting pit) করলেই চলবে। কিন্তু লিচুর বাগান করতে চাইলে জমিতে ঝোপ জঙ্গল ও আগাছা থাকলে তা পরিষ্কার পরিছন্ন করে জমি সমান করে নিতে হবে এবং ভালো ভাবে চাষ দিয়ে জমি তৈরী করতে হবে । লিচু গাছ ১০×১০ মিটার দূরে দূরে রোপণ করতে হয় । লিচু গাছ ষড়ভুজ প্রণালীতে রোপণ করা উত্তম । ১০ মিটার দূরে দূরে লাইন টেনে লাইনে ১০ মিটার দূরে দূরে গাছ রোপণ করতে হবে । প্রথমেই মাপ জোক করে কাঠি পুঁতে গাছ রোপণের স্থান নির্দিষ্ট করতে হবে। এরপর কাঠিটিকে কেন্দ্র করে ১ মি: ১মি:× ১মিঃ সাইজের গর্ত খুঁড়তে হবে । গর্ভের মাটিতে ভালোভাবে রোদ পাওয়ার জন্য গর্ত খুড়ে ২-৪ সপ্তাহ খোলা রাখতে হবে । গর্ত তৈরির সময় গর্তের উপরের ও নিচের মাটি আলাদা আলাদা করে রাখতে হবে। এ মাটির সাথে জৈব সার ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে । গাছ রোপণের কমপক্ষে ১০-১৫ দিন আগে এই সার মিশানো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে রাখতে হবে। গর্তের মাটি শুকানো থাকলে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে । গাছ থেকে গাছের দূরত্ব উভয় দিকে ১০ মিটার রাখতে হবে । জৈষ্ঠ (মে-জুন) মাসে লিচু চারা রোপণের উত্তম সময় । সেচ সুবিধা থাকলে বছরের অন্যান্য সময়েও (অতি খরা সময়বাদে) ছোট ছোট বাগানে চারা রোপণ করা যেতে পারে ।
সার প্রয়োগের কলা কৌশল
প্রথমে উপরের (Top soil) মাটির সাথে গর্ভ প্রতি ১০ কেজি গোবর সার মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে ফেলতে হবে। এরপর ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম টি এস পি ও ২০০ গ্রাম এমপি সার গর্ডের উপরের ২৫ সে:মি: মাটির মধ্যে হালকা কোপ দিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে। এখন রোপণের জায়গাটি কাঠি পুঁতে নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে । এর ১০-১৫ দিন পর লিচুর কলম উক্ত গর্ভে রোপণ করা যাবে। রোপণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন গাছের গোড়ার মাটির বলটি না ভেঙ্গে যায়। এরপর গাছটি মাটিতে বসিয়ে চারদিকের মাটি পা দিয়ে শক্ত করে বসিয়ে দিতে হবে এবং রোপণের পর পরই সেচ দিতে হবে।
গাছ রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা
লিচু বাগান আগাছামুক্ত রাখতে হবে। লিচুর শিকড় বেশি গভীরে যার না। তাই শুষ্ক মৌসুমে সপ্তাহে ২-৪ বার হালকা ভাবে চাষ দিয়ে মাটি আলগা করে রাখলে রস সংরক্ষণে সহায়তা হবে। গাছ ছোট অবস্থায় বাগানে সবুজ সারের চাষ করা যেতে পারে। গাছ বৃদ্ধির জন্য শুষ্ক মৌসুমে সেচ দিতে হবে । এটি ফল ঝরে পড়ে রোধে সাহায্য করে। গরমের দিনে হঠাৎ বৃষ্টিপাত হলে ফল ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে ফল ফেটে যাওয়া অনেকাংশে রোধ হয়। লিচু বাগানের মাটি চাষ করে কলাই ভাল্ব এর চাষ করা যেতে পারে । এতে বাড়তি আয় হবে এবং মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পাবে। লিচু বাগানে সবজি চাষ করা যায়। এতে বাগান পরিষ্কার থাকে।
সারে উপরি প্রয়োগ ও সেচ ব্যবস্থাপনা
লিচু পাছে বছরে দুবার সার দিতে হবে। প্রথম কিস্তিতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং দ্বিতীয় কিন্তুি ভাদ্র-আশ্বিন মাসে। গাছের সন্তোষজনক বৃদ্ধির জন্য সার দরকার। প্রথম চার বছর যে হারে সার দিতে হবে তা সারনিতে দেয়া হলো। সার দেয়ার পরপরই প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে।
সারণি – ১ প্রথম চার বছর লিচু গাছে সার প্রয়োগের পরিমাণ
গাছের বয়স | গোবর সার কেজি প্রতি গাছ প্রতি বছর | ইউরিয়া গ্রাম/প্রতি গাছ/প্রতিবছর | ইউরিয়া গ্রাম/প্রতি গাছ প্রতিবছর | এমপি গ্রাম/প্রতি গাছ প্রতি বছর |
১ | ৫ | ১৭০ | ৫০ | ১২৫ |
২ | ৫ | ২২০ | ৫০ | ১৭০ |
৩ | ৫ | ৩২০ | ১১০ | ২৫০ |
৪ | ৫ | ৫৫০ | ১৬০ | ৪২০ |
সম্পূর্ণ গোবর সার ও টি এসপি এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি প্রথম কিস্তিতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে একসাথে গাছের গোড়ার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। গাছের গোড়া হতে ৫০ সে:মি: দুরত্বে বা গাছের ডাল যতদুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে ততদূর পরিমাণ দূর দিয়ে সার ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সার দেয়ার পরপরই সেচ দিতে হবে । বাকী ইউরিয়া ও এম পি সার দ্বিতীয় কিস্তিতে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে একই ভাবে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পরপরই সেচ দিতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে ১৫-২০ দিন পরপর সেচ দেয়া ভালো! সার প্রয়োগে মাটির উর্বরতা, গাছের দূরত্ব ও বৃদ্ধি ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। তবে প্রতি বছর সারের মাত্রা বাড়িয়ে ৫ বছর বা তদুদ্ধ বয়সের গাছ প্রতি সার প্রয়োগ সারণি - ২ তে দেয়া হলো ।
সারণি-২ পাঁচ বছর বা তদুর্ধ লিচু গাছে সার প্রয়োগের পরিমাণ
প্রতি ক্ষেত্রেই সার প্রয়োগের পরপরই লিচু বাগানে সেচ দিতে হবে। ফলন্ত গাছে ফুল আসার পর থেকে শুরু করে ১৫-২০ দিন পরপর সেচ দিলে ফল বড় হয় এবং ফলন বাড়ে। পানির অভাব হলে ফল ঝরে পড়ে ।
ট্রেনিং ও প্রুনিং
ফলন্ত লিচু গাছে ট্রেনিং বা প্রবর্নিং দরকার নাই। নার্সারিতে থাকতে এবং রোপণের পর কয়েক বছর গাছের কিছু ট্রেনিং এবং প্রুনিং এর দরকার আছে । যাতে গাছের একটি মাত্র প্রধান কাণ্ড কমপক্ষে এক থেকে দু মিটার উঁচু হতে পারে । এ জন্য পাশের অন্যান্য ডালপালা ঘেঁটে দিতে হবে । প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে মরা ও রোগাক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। লিচু ফল এক বছর বয়সের প্রান্ত শাখায় হয়ে থাকে । ফল আহরণের সময় শাখার কিছু অংশ ফলসহ ভেঙে নেওয়া হয় । শাখার কিছু অংশ ভাঙার ফলে নতুন শাখা প্রশাখা বের হয় । সেগুলো পরবর্তী বছর ফল দেয়। এর বেশি ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন হয় না ।
পোকা মাকড় ও রোগ বালাই
লিচুর তেমন কোন মারাত্মক রোগ নেই। তবে Litchi Fruit লিচু গাছের অতিক্ষুদ্র মাকড়, ও Litchi Fruit Borer লিচু ফলের বীজ খেকো মাজরা পোকা লিচু ফলের মারাত্মক ক্ষতি করে ।
বাদুর পাকা লিচুর প্রধান শত্রু । এটি পাকা ফলে আক্রমণ করে । ফল পাকার সময় মাছ ধরার জাল দিয়ে গাছ ঢেকে রাখলে বাদুরের উৎপাত কমে যায় । লিচু মাইট পাতার রস চুষে পাতাকে শুকিয়ে ফেলে । এর আক্রমণে পাতার নিচের পিঠে বাদামি বর্ন ধারন করে এবং পাতা কুঁকড়িয়ে যায় । কচি শাখা প্রশাখা ফুলের কুঁড়ি ইত্যাদিও আক্রান্ত হয় । প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০-৩০ ঘন মি: লি: ক্যালথেন বা ২০ গ্রাম থায়াভিট মিশিয়ে প্রয়োগ করলে ইহা দমন হয় । পোকার শুককীট ফলের বোটার দিকে গর্ত করে ঢুকে শাঁস ও বীজ আক্রমণ করে । ফল পাকার সময় হলে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়। কচি অবস্থায় ফলের উপর জায়াজিনন ৫০ ইসি ৬ মিলি ১লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা নিয়ন্ত্রন করা যায় । লিচু উচ্চ আর্দ্র ও কুয়াশাযুক্ত আবহাওয়ায় পুষ্প মঞ্জুরী মিলডিউ ও অ্যানথ্রাকনোজ রোগে আক্রান্ত হতে পারে । অনেক সময় ফল পচতে ও শুকিয়ে যেতে দেখা যায় । এর প্রতিকারে বোর্দোমিশ্রণ ও ডাইথেন এম-৪৫ ছত্রাকনাশক ছিটানো যেতে পারে।
ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কৌশল
কলমের গাছে ৪-৫ বছরের মধ্যেই ফল ধরতে শুরু করে ও ভাল ফলন পেতে ৭-৮ বছর সময় লাগে । বীজের গাছে ফল আসতে ৮-১০ বছর সময় লাগে । একটা গাছে প্রায় ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত ভালো ফলন পাওয়া যায় । ফেব্রুয়ারি - মার্চ মাসে লিচু গাছে ফুল আসে ও মে-জুন মাসে লিচুর পাকা ফল সংগ্রহ করা যায় । ফল পুষ্ট হলে কাটা গুলো অনেকটা মোটা হবে ফলের রং উজ্জ্বল হবে এবং বোটার নিচে লালচে রং ধারণ করবে পরিপক্ক লালচে ভাবাপন্ন লিচু সগ্রহ করা হয়। এতে ফল বেশি দিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়। বৃষ্টির পর পরই কখনো ফল সংগ্রহ করা উচিত নয়। সাধারণত প্রতিটি গাছ থেকে ৩০০০ হতে ৫০০০ লিচু পাওয়া যায়। গাছ প্রতি ফলন ৮০-১৫০ কেজি।
সংরক্ষণ
সাধারণত লিচু সংগ্রহের পর ২-৩ দিনের বেশি ঘরে রাখা যায় না। লিচুর উপর লবণের পানি ছিটিয়ে বাঁশের ঝুড়িতে করে দূরবর্তী স্থানে লিচু প্রেরণ করলে সহজে নষ্ট হয় না। ২.২° -৩.৩° সে: তাপমাত্রায় ৮০ ৮৪% আর্দ্রতায় লিচুকে একমাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল নারিকেল। নারিকেল এমন এক ধরনের গাছ যার ফল, ছোবড়া, খোল, পাতা, কাণ্ড, মূল প্রভৃতি সমস্ত কিছুই মানুষের কাজে লাগে। বাংলাদেশের সব জেলাতেই নারিকেল জন্মায়। তবে উপকূলীয় জেলাসমূহে এর উৎপাদন বেশি। নারিকেলের জন্য উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ুর প্রয়োজন । যে সব স্থানের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২৭° সে. এবং তাপমাত্রা দৈনিক উঠানামা ৬-৭° সেঃ বেশি নয় এবং বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১২৫ সে:মি: এর বেশি সেখানে এটি সবচেয়ে ভালো জন্মে । নারিকেলের জাত প্রধানত তিনটি (১) টিপিকা জাত যা লম্বা শ্রেণিভুক্ত (২) জাভাটিকা জাত মাঝারি লম্বা শ্রেণি এবং (৩) নানা জাত যা বামন শ্রেণির
মাটি ও জমি নির্বাচন
নারিকেল গাছ প্রায় সব রকম মাটিতেই জন্মে। তবে সুনিষ্কাশিত অগভীর পানিতল বিশিষ্ট দোআশ বা বেলে দোঁআশ হতে এঁটেল মাটিতে খুব ভালো জন্মে । স্বাভাবিক জোয়ার ভাটার প্রভাবাধীন স্থান সমূহ নারিকেল চাষের জন্য উপযোগী । ৫.০ - ৮.০ অম্লক্ষারত্বে নারিকেল জন্মানো যায়। অত্যাধিক অম্ল বা অত্যধিক ক্ষার মাটি নারিকেল চাষের জন্য ভালো নয়। মাটির পটাসিয়াম ও সোডিয়াম লবন নারিকেলের জন্য ভালো। যে স্থানে মাটি সব সময় স্যাঁতসেঁতে থাকে অথচ শিকড় এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় না। তথায় নারিকেল সবচেয়ে ভালো জন্মে। নারিকেল জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। অথচ পর্যাপ্ত রসের প্রয়োজন, তাই সমুদ্রের কাছাকাছি পরিবেশে নারিকেল ভালো ভাবে জন্মে।
জমি তৈরি ও গর্ত তৈরি
জমি বেশ কয়েকবার চাষ দিতে হয় । তারপর মাটি ঝুর ঝুরে করে তৈরি করে আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হয় । নারিকেল গাছ লাগানোর জন্য উঁচু জমি প্রয়োজন । জমিতে ১.৫ থেকে ২মি: উঁচু চওড়া বাধ তৈরি করে সেখানে নারিকেল গাছ লাগানো যায় । চারায় ছায়া প্রদানের সুবিধার্থে আগে হতে গর্তের স্থানের চারদিকে ৫০ সে.মি. দূর দিয়ে ধইঞ্চা বা শন পাটের বীজ বপন করা যেতে পারে । সারি থেকে সারির দুরত্ব এবং সারি থেকে গাছের দুরত্ব মাপজোক করে রোপণের স্থানে কাঠি পুঁতে নির্দিষ্ট করতে হবে । চারা রোপণের ২-৩ সপ্তাহ পূর্বে ৯০ সে.মি. প্রস্থ ও ৯০ সে.মি. গভীর করে গর্ত খুঁড়তে হবে। কোন কোন সময় চারা লাগানোর স্থানে ১০×১০×1.0 মিটার আকারের গর্ত করে ১৫ দিন থেকে ১ মাস রোদ খোলা রাখা হয়। গর্তের আকার বড় হলে বেশি উপকার পাওয়া যায়। এ গর্ত খোড়ার সময় উপর স্তরের মাটি আলাদা রাখতে হবে। এই উপরের মাটির সাথে ভালো ভাবে সার মিশিয়ে গাছ রোপণের ১০-১৫ দিন আগেই গর্তগুলো ভরাট করে দিতে হবে।
সার প্রয়োগের কলা কৌশল
গর্তের উপরের মাটির সাথে পর্বপ্রতি ২০ কেজি গোবর মিশিয়ে গর্তগুলো ৩০ সেঃমিঃ ফাঁকা রেখে ভরটি করতে হবে । তারপর প্রতি গর্তের উপরে ২৫ সেঃমিঃ মাটির সাথে নিম্নের সারনিতে উলেখিত সারগুলোর অর্ধেক মিশাতে হবে ।
সারণি ও প্রতি গর্তে গাছে সারের পরিমাণ
গোবর | ২০ কেজি |
ইউরিয়া | ১৩২৫ গ্রাম |
টিএসপি | ১০৪০ গ্রাম |
এমপি | ১৬৬০ গ্রাম |
জিপসাম | ২৭৭৫ গ্রাম |
জিংক সালফেট | ২৭৫ গ্রাম |
বাকি সার ভাদ্র আশ্বিন মাসে গাছের চারদিকে ৩-৫ মিটার পর্যন্ত ছিটিয়ে টিলার বা লাঙ্গল দিয়ে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশে দিতে হবে ।
চারা রোপণের দূরত্ব
বাগান করলে গাছ থেকে গাছ ও সারি থেকে সারি ৬.৫-৮.৫ মিটার দূরে চারা লাগানো যায়। তবে গাছ থেকে গাছ । এবং সারি থেকে সারি ৫-৬ মিটার দুরত্বেও লাগানো যেতে পারে । বর্গাকার, ষড়ভূজী বা ত্রিকোনাকার পদ্ধতিতে নারিকেল চারা রোপণ করা যার। বড়ভূজ পদ্ধতিতে বর্গাকার বা ত্রিকোনাকার পদ্ধতি অপেক্ষা বেশি গাছ লাগানো যায় ।
চারা নির্বাচন: যে সব চারা দ্রুততর গলায় এবং ঘন ঘন পাতা উৎপাদন করে সেগুলো উৎকৃষ্ট । ঐগুলোর পাতা চওড়া, গাঢ় সবুজ। পাতার বোটা খাটো, চারার গোড়া পুরু, শিকড়ের সংখ্যা অধিক। তেজী চারা লাগালে দ্রুত ফল পাওয়া যায় এবং ফলনও বেশি হয়।
চারা রোপণের সময় মে হতে জুলাই বা আগষ্ট মাস পর্যন্ত চারা রোপণ করা যেতে পারে। বীজ তলা হতে চারা ভালোর দিনই মূল বাগানের জমিতে চারা লাগানো উচিত। তাতে চারা খুব তাড়াতাড়ি লেগে যেতে পারে।
চারা রোপণ পদ্ধতি: সার মিশানো মাটি দিয়ে গর্ত গুলো ভরাট করার ১০-১৫ দিন পর নারিকেলের সুস্থ ও সবল চারা জমির সমতল হতে ৩০ সে:মি: গভীরে গর্তের মাঝখানে বসাতে হবে। চারা গর্তের মাটিতে রোপণের সময় চারা নারিকেলটি শুধু মাটি চাপা দিতে হবে এবং চারদিকের মাটি শক্ত করে বসিয়ে দিতে হবে। অতিরিক্ত বৃষ্টির সময় যখন মাটি কর্দমাক্ত থাকে তখন সার মিশানো বা চারা রোপণ না করে যখন জমিতে “জো” আসে তখন করা সবচেয়ে ভালো। রোপণের পরপরই চারার দু পাশে দুটি কাঠি পুঁতে বাংলা চারটি এর মত করে চারটি মাঝখানে রেখে দুটি কাঠি বেঁধে দিতে হবে ।
রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা
রোপণের পর ৪-৫ বছর পর্যন্ত নারিকেল গাছের প্রয়োজনীয় পরিচর্যা যথা সময়ে করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এতে গাছ দ্রুত ফলবান হবে এবং পরবর্তী সময়ও গাছের উপর এর শুভ প্রতিক্রিয়া থাকবে ।
সেচ ও পানি নিকাশ এবং অন্যান্য পরিচর্যা: প্রথম অবস্থায় গর্তের চারাটি মাটি এসে চারার গোড়া যেন ঢেকে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এরূপ হলে অতিরিক্ত মাটি চারার গোড়া হতে সরিয়ে ফেলতে হবে । চারা যতই বড় হতে থাকবে গর্তের মাটিও আস্তে আস্তে ভরাট হতে থাকবে । শুকনো মৌসুমে নিয়মিত সেচ দিতে হবে এবং বর্ষা মৌসুমে নারিকেল বাগানে যেন জলাবদ্ধতা না হয় এ জন্য পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে । কোন গাছের ছায়া যাতে ক্ষতি না করে সেদিকে খেয়াল করতে হবে। নারিকেল গাছ উন্মুক্ত আলো বাতাস চায় ।
সারের উপরি প্রয়োগ: গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও ফল উৎপাদনের জন্য সব খাদ্যোপাদানই আবশ্যক । চারা রোপণের পর গাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য জৈব সার প্রয়োগ করা যেতে পারে । প্রাথমিক অবস্থায় চারার বৃদ্ধি কম হলে ফল ধরতে দেরী হয় । সাধারণত ৪ থেকে ৭ বছরের মধ্যে নারিকেল গাছে ফল ধরতে শুরু করে। তবে ১২ বছর বয়স হতে ভালভারে ফল ধরা শুরু করে। এক পরীক্ষায় প্রমান পাওয়া গেছে যে নারিকেল গাছে ফসফরোগর চাহিদা কম, পটাসিয়ামের চাহিদা বেশি এবং নাইট্রোজেনের চাহিদা মোটামুটি মাঝারি ধরনের । গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে গাছ প্রতি সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে।১ বছর
চারার বয়স | সারের পরিমাণ | সারের নাম ও আনুপাতিক হার |
১ বছর | ৭৫০ গ্রাম | ইউরিয়া: টিএসপি এমপি (২:১:৩) |
২ বছর | ১০০০ গ্রাম | |
৩ বছর | ১২৫০ গ্রাম | |
৪ বছর | ১৫০০ গ্রাম |
সাথে প্রতি বছর ১০ কেজি গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে ।
সূত্র: বিএআরসি/ডিএই ছক-২
ফলন্ত নারিকেল গাছে সার প্রয়োগের পরিমাণ
সারের নাম | গাছ প্রতি সারের পরিমাণ |
ইউরিয়া | ১.৫০ |
টিএসপি | ১.০০ কেজি |
এমপি | ১.৭০ কেজি |
জিপসাম | ৫০০ গ্রাম |
জিংক সালফেট | ২০০ গ্রাম |
সারের অধিক মে-জুন মাসে এবং বাকি অর্ধেক সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে গাছের গোড়ার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে । পাছের গোড়ার চারদিকে ৪০-৬০ সে.মি. দূর দিয়ে ৫০ সে:মি: চওড়া ও ১২-১৫ সে:মি: গভীর করে গর্ত করতে হবে। গাছ বাড়ার সাথে সাথে এই দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে হবে। মে-জুন মাসে যে অর্ধেক সার দেওয়া হবে তা গর্ভে ছড়িয়ে দিয়ে মাটি চাপা দিতে হবে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বাকি অর্ধেক সার গাছের চারদিকে ৩-৫ মিটার দুর দিয়ে ছিটিয়ে চাষ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। মাটিতে রস কম থাকলে সার প্রয়োগের পর পরই সেচ দিতে হবে। গাছ বাড়ার সাথে সাথে সার প্রয়োগ করা না হলে ফলন কমে যায়। নিয়মিত সার ও সেচ দিলে ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। নারিকেল গাছে সার প্রয়োগের ১৫-২০ মাস পর ফলনের ওপর সারের প্রভাব পাওয়া যায়।
পোকা মাকড় ও রোগ বালাই দমন কৌশলঃ
পোকা দমন ও দুটি পোকা নারিকেল গাছের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এদের একটি Rhinoceros beetle বা গোবরে পোকা এবং অপরটি রেড পাম উইভিল। গোবরে পোকা কচি অর্থভাগ ছিদ্র করে ঢুকে পড়ে এবং গাছের কচি অংশের রস চুষে খায়। ফলে সেখানে পচন ধরে এবং বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। পচা অংশের আকর্ষণে রেড পাম উইভিল এর আগমন হয়। এর শুককীট পাছের অগ্রভাগ কেটে ফেলে এবং গাছের মৃত্যু ঘটায়। এ দুটি পাকার আক্রমণ থেকে গাছকে রক্ষার জন্য নিম্নে বর্ণিত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে ।
১। নারিকেল গাছ মারা গেছে বা মরার উপক্রম হয়েছে সেগুলো কেটে সরিয়ে ফেলতে হবে এবং আক্রান্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে ।
২। নারিকেল বাগানের মধ্যে বা আশে পাশে গোবর ও আবর্জনা রাখা যাবে না।
৩। বছরে অন্তত দু'বার বর্ষা শুরুর আগে এবং শেষে গাছের অগ্রভাগের আবর্জনা, শুষ্ক পাতা ও ছড়ার অংশ পরিষ্কার করে দিতে হবে । ছিদ্র দেখলে লাহোর শিক ঢুকিয়ে পোকা পেঁথে মেরে ফেলতে হবে। তাছাড়া ছিদ্র পথে যত টুকু সম্ভব প্লাষ্টিকের সিরিঞ্জের সাহায্যে “নগস" বা ডেনকাভ্যাপন ১০০ ইসি ঢুকিয়ে ছিদ্র কাদা দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। কীটনাশক হতে উৎপন্ন বিষ বাস্প নারিকেল গাছের অভ্যন্তরে উইভিলের কীড়া ধ্বংস করবে।
রোগ দমন: নারিকেল গাছের শীর্ষ পচা (Bud rot) রোগ খুবই মারাত্মক। এ রোগে আক্রান্ত গাছের শীর্ষদেশের কোমল অংশ পচে বিকট গন্ধ ছড়ায়। আক্রমণের প্রথম অবস্থায় বোর্দো মিকচার ছিটিয়ে এ রোগ দমন করা যায় । অথবা আক্রান্ত গাছের মাথা কেটে পুড়ে ফেলা উচিত এবং নিকটবর্তী গাছগুলোতে বোর্দো মিকচার ছিটানো উচিত ।
ফল আহরণ ও সংরক্ষণ কৌশল
ফুল আসা থেকে শুরু করে ঝুনা হতে প্রায় ১ বছর সময় লাগে। অনুকূল অবস্থায় চারা লাগানোর ৫-৬ বছরের মধ্যে নারিকেল গাছে ফুল ধরতে শুরু করে। বছরের বিভিন্ন সময়ে নারিকেল পাড়া যায় । কতবার নারিকেল পাড়া যাবে তা সংখ্যা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন হয়ে থাকে । পরিপক্ক নারিকেল গাছে উঠে কঁধি কেটে রশিতে বেঁধে নিচে ফেলে সংগ্রহ করা হয় । দূরে পাঠাতে হলে বা বাজারজাত করতে হলে খোসাসহ খাঁচায় বা গাড়িতে করে পরিবহন করা যেতে পারে। ডাব হিসেবে ব্যবহার করতে হলে ৬-৭ মাস বয়সের ফল পাড়া ভালো । ঝুনা নারিকেল ঘরের শুকনো মেঝেতে ৩-৪ মাস রাখা যায়। বছরে গাছ প্রতি ১০০-১৫০ টি নারিকেল পাওয়া যায়।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। লিচু বাগানের জন্য মাটির উপযুক্ত পিএইচ মান কত ?
২। লিচুর মাইট পাকা দমনে কি কীটনাশক ব্যবহার করা হয় ?
৩। লিচু সংরক্ষণের জন্য তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা কত হওয়া উচিত ?
৪। নারিকেল গাছের জন্য গর্তে গোবর এবং জিপসাম সার কত গ্রাম দিতে হয় ?
৫। নারিকেলের শীর্ষ পচা রোগ দমনে কি ছত্রাকনাশক ব্যবহার করবেন ?
৬। বাগানে লিচু গাছ কত দুরে দুরে লাগাতে হয় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। নারিকেল চারা রোপণ পদ্ধতি ও দূরত্ব সম্পর্কে লেখ।
২। লিচু গাছ রোপণের সময় ও দূরত্ব লেখ ।
৩। চিত্রসহ নারিকেলের চারা রোপণ পদ্ধতি লেখ ।
৪। লিচু সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কৌশল লেখ।
৫। নারিকেল সংগ্রহ কৌশল লেখ ।
৬। নারিকেল চাষের জন্য জমি নির্ধারন ও জমি তৈরি সম্পর্কে লেখ ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। নারিকেলের চারা রোপণের জন্য গর্ত তৈরি, সার প্রয়োগ ও অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ ।
২। লিচুর চাষাবাদ কৌশল বর্ণনা কর ।
৩। নারিকেল ও লিচুর প্রধান প্রধান পোকাও রোগবালাই দমন কৌশল বর্ণনা কর ।
৪। নারিকেল ও লিচুর রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা বর্ণনা কর ।
৫। বয়স্ক লিচু গাছে নারিকেল গাছে প্রয়োগের জন্য সারের নাম ও পরিমাণ ছক আকারে লেখ।
আমড়া চাষাবাদ (Hog plurn )
বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত টক ফল আমড়া। আমড়া অত্যন্ত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ফল। এতে প্রচুর ভিটামিন এ, বি, লৌহ, ক্যালসিয়াম ও খনিজ লবণ আছে। বাংলাদেশে বরিশালের আমড়া প্রসিদ্ধ । এটা আমের স্বগোত্রীয় ফল দেখতে অনেকটা ছোট আকারের আমের মত । এটা বাংলাদেশ- ভারত অঞ্চলের ফল, পত্র পতনশীল গাছ এবং এর চাষাবাদও খুব কঠিন নয় । সহজেই বীজ থেকে চারা উৎপাদান ও চাষ করা যায় ।
আমড়া চাষের জন্য মাটি ও জমি নির্বাচন
প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং পানি নিকাশের ব্যবস্থা ভাল থাকলে যে কোন ধরনের মাটিতেই আমড়া চাষ করা যায় । তবে আর্দ্রতাপূর্ণ পেঁয়াশ মাটি আমড়া চাষের জন্য উত্তম । মাটিতে পানি দাঁড়ানো অবস্থা সহ্য করতে পারে না । পানি জমলে জমি উঁচু বা নিচু যে ধরনেরই হোক তাতে কোন অসুবিধা হয় না । খোলামেলা বা আংশিক ছায়াযুক্ত জমিতে আমড়া চাষ করা যায় ।
গাছ রোপণের জন্য জমি ও গর্ত তৈরি পদ্ধতি
বর্ষার পূর্বে অথাৎ মার্চ-এপ্রিল মাসে ৭৫ সে:মি:×৭৫ সে.মি, ৭৫ সে.মি. আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে । দুই সারির মাঝখান দিয়ে নালা তৈরি করে নালার মাটি গাছের সারিতে উঠিয়ে দিলে উঁচু বেডের মত হবে। এতে গাছের গোড়ায় পানি দাঁড়াতে পারবে না। চারা রোপণের ২ থেকে ৩ সপ্তাহ আগে নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্ত করতে হবে । প্রতি গর্তে উপরের মাটির সাথে ১৫-২০ কেজি গোবর সার ও ১ কেজি কাঠের ছাই মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে ।
চারা রোপণের দূরত্ব (Spacing of Planting)
পরস্পর দুটি চারার ও সারির মধ্যে দূরত্ব থাকবে ৮ থেকে ১০ মিটার
চারা রোপণের সময় (Time of planting)
জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় । বৃষ্টিপাত বেশি হলে ও পানি নিকাশের ভালো ব্যবস্থা থাকলে চারা লাগানো যায় ।
চারা রোপণ পদ্ধতি (Method of planting )
চারার বৃদ্ধি ও ভালো ফলনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার মিশিয়ে গর্ত ভরাট করার ২-৩ সপ্তাহ পরে নির্দিষ্ট গর্তের মাঝখানে চারা লাগাতে হবে । চারা লাগানোর পর চারার সারি উঁচু বেড আকারে না থাকলে গোড়ার মাটি উঁচু করে দিতে হবে। তবে জমির সমতল হতে চারা লাগানোর স্থান ৩০-৪০ সে:মি: উঁচু হলে ভালো হয় ।
সার প্রয়োগের কলা কৌশল
দেশি আমড়া গাছে সার দেওয়ার প্রচলন নাই, তবে বিলাতি আমড়ায় কিছু সারের চাহিদা আছে । চারার বৃদ্ধি ও ভাল ফলনের জন্য বর্ষার আগে গাছ প্রতি ১৫-২০ কেজি গোবর ব্যবহারে সুফল পাওয়া যায়। নিচে উল্লেখিত পরিমাণ সার সমান দু'ভাগে ভাগ করে দুবারে প্রয়োগ করতে হবে।
ছক: আমড়া গাছে সার প্রয়োগের পরিমাণ (কেজি/গ্রামএমপি
সারের নাম | প্রতি বছর গাছ প্রতি সারের পরিমাণ | পূৰ্ণ বয়ক ফলত গাছ প্রতি সারের পরিমাণ |
গোবর সার | ১৫-২০ কেজি | ৩০-৪০ কেজি |
ইউরিয়া | ১০০ গ্রাম | ১০০০ গ্রাম |
টিএসপি | ১০০ গ্রাম | ৮০০ গ্রাম |
এমপি | ১০০ গ্রাম | ৬০০ গ্রাম |
রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা
আমড়ার চারা অত্যন্ত নরম। তাই ঝড়ে যাতে ভেঙে যেতে না পারে সেজন্য চারা রোপণের পর বাঁশের খুটি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে। আম গাছের মত আমড়া গাছে অসম বা একান্তর ভাবে ফলন দেখা যায়। অর্থাৎ এক বছর ফলন বেশি হলে পরের বছর ফলন কম দেয় । যে বছর ফলন বেশি হয় সে সময় ছোট অবস্থায় কিছু ফল পেড়ে ফল পাতলা করে দিতে হয়। এতে অবশিষ্ট ফল বড় হয় এবং একান্তর ফলন কিছুটা রোধ হয়। এছাড়া ফল শেষ হয়ে গেলে শুকনো ও রোগাক্রান্ত ডাল ছেটে দিতে হয়। গাছের নিচের জমি আগাছামুক্ত ও মাটি নরম রাখার জন্য বাগানের ফাকা জায়গায় আদা, হলুদ, চাষ করা যায় । বড় গাছে তেমন সেচের প্রয়োজন হয় না । চারা ছোট অবস্থায় এবং সার প্রয়োগের পর বৃষ্টি না হলে সেচ দেওয়া প্রয়োজন ।
পোকা মাকড় ও রোগ বালাই দমন কৌশল
আমড়া গাছের শত্রু কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা। এই পাকা গাছের কাঠ সমেত নরম অংশ খেয়ে ফেলে এবং গর্ত করে দেয় । এই গর্তে বর্ষার জল ঢুকে পচন শুরু হয় এবং নরম ডালপালা সহজেই ভেঙে যায়। এই পোকার মল দেখে সহজেই চেনা যায়। প্রতিকার হিসাবে লোহার শলাকা দিয়ে পোকা বের করে মারা হয় । এছাড়া ৫০% বি.এইচ সি গুলে গর্তে ঢেলে দিয়ে গর্তের মুখ সিমেন্ট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাঝে মাঝে ডাল শুকা রোগ (Die back) আক্রান্ত হয় । এছাড়া তেমন রোগ চোখে পড়ে না ।
ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষন কৌশল
দেশি আমড়া গাছে ৫-৭ বছরে এবং বিলাতি আমড়া গাছে আরো আগে ফল ধরা শুরু করে। ফেব্রুয়ারি - মার্চ মাসে মুকুল আসে এবং জুলাই-আগষ্ট মাসে ফল পাকে। দেশি আমড়া ছোট অবস্থায় তোলা যায় এবং চাটনি খাওয়া যায় । ফল পুষ্ট হলে গায়ের চামড়া টান টান হয় এবং বোটার দিকে হালকা সবুজ বা হালকা হলদে ভাব হয় । ডাসা অবস্থায় ফল পাড়া হয়। পরিপুষ্ট ফল পেড়ে বড় ছোট গ্রেডিং করে বাজারজাত করা হয় । ঠান্ডা পরিবেশে এবং আলো বাতাস চলাচলের সুবিধাজনক স্থানে এক সপ্তাহের বেশি সময় রাখা যায়। গরম বা বন্ধ স্থানে রাখলে তাড়াতাড়ি পেকে যায়। স্বাভাবিক ঠান্ডা ঘরে সংরক্ষণ করলে মাঝে মাঝে হালকা পানির ছিটা দিলে ফল সতেজ থাকে ।
ফল সংরক্ষণ (Fruit preservation): ভঁসা ফল পেড়ে মিষ্টি আচার তৈরি করে অনেক দিন রাখা যায় । কবিরাজেরা আমের মত আমড়া সত্ত্ব করে রাখেন বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য । একটি আমড়া গাছ ২৫-৩০ বছর পর্যন্ত বছরে ২০০-৩০০ কেজি ফল দেয় ।
কামরাঙ্গা (Carambola) চাষাবাদ কৌশল
অম্লমধুর স্বাদযুক্ত কামরাঙ্গা ফল আমাদের কাছে খুবই পরিচিত । কাচা ফল টক পাকলে কিছুটা মিষ্টি। সারা বাংলাদেশে এই ফল গাছে দেখতে পাওয়া যায়। ব্যবসায়িক ভাবে কামরাঙ্গা চাষ তেমন লাভজনক নয় তবে অনেকে বাগানে বা বাড়ির আশে পাশে গাছ লাগিয়ে থাকেন। এই ফলে প্রচুর ভিটামিন এ ও সি এবং বি, বি২, ক্যালসিয়াম, লৌহ ও খনিজ লবণ আছে। কবিরাজী মতে পাকা ফল শীতল, বাতনাশক, অর্শরোগে উপকারী রুচিকর ও পুষ্টিকর । এই ফল খাওয়া উপকারী । বর্তমানে হাইব্রিড মিষ্টি জাতের কামরাঙ্গা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
মাটি ও জমি নির্বাচন
হালকা দোঁআশ মাটি কামরাঙ্গা চাষের জন্য উত্তম হলেও পানি নিষ্কাশন ও সেচের সুবিধাযুক্ত প্রায় সব ধরনের মাটিতেই এর চাষ করা যায় । বালি মাটিতে এই ফলের চাষ করা অসুবিধাজনক পানি না জমলে জমি উঁচু বা নিচু যে ধরনে হাকে তাতে কোন অসুবিধা হয় না । খোলামেলা বা আংশিক ছায়াযুক্ত জমিতে কামরাঙ্গা চাষ করা যায়।
চারা রোপণের জন্য জমি ও গর্ত তৈরি এবং সার প্রয়োগ পদ্ধতি
বর্ষার পূর্বে অথাৎ মার্চ-এপ্রিল মাসে জমিতে কয়েক বার চাষ দিয়ে জমির আগাছা পরিস্কার করে চারা রোপণের জন্য গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের মাপ হবে ৭৫ সে: মি: × ৭৫ সে:মি:×৭৫ সে:মি:। প্রতি গর্তে ১৫-২০ কেজি গাবর সার ১ কেজি কাঠের ছাই, ৫০০ গ্রাম হাড়ের গুড়া, ঝুরা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে রাখতে হবে । গর্ত গাছের রোপণের ২০-২৫ দিনে পূর্বে করতে হবে ।
চারা রোপণ পদ্ধতি (Method of Planting)
গর্তের মাঝখানে চারা বসিয়ে গোড়ার মাটি একটু উঁচু করে দিতে হবে । একটা শক্ত কাঠির সঙ্গে বেঁধে দিয়ে নরম চারাকে দাঁড়াতে সাহায্য করতে হবে । তারপর পানি সেচ দিতে হবে ।
চারা রোপণের সময় (Tine of planting): বর্ষা কালে অর্থাৎ মার্চ - এপ্রিল মাসে চারা রোপণ করা হয়।
চারা রোপণের দূরত্ব (Spacing of Planting): পরস্পর গাছ ও সারির দূরত্ব থাকবে ৪-৫ মিটার।
রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা
সার প্রয়োগ (গবহরহম) ও সার প্রয়োগে ফলন ভালো ও ফলের মান উন্নত হয়। এ জন্য বর্ষার আগে প্রতি বছর গাছ প্রতি ১৫-২০ কেজি গোবর সার বা খামার সার, ১ কেজি কাঠের ছাই, ১ কেজি সরিষার খৈল গোড়ার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে সেচ দিতে হবে। চারা ছোট অবস্থায় সার কিছুটা কম দিয়ে গাছকে সবল করে তুলতে হবে । বড় গাছে বর্ষার শুরুতে ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি এনপিকে বা সুফলা ( ১৫:১৫:১৫ ) প্রয়োগে বেশি ফলন পাওয়া যাবে । ভাল ফলনের জন্য বয়ক গাছে বর্ষার আগেও পরে দুই দফায় সার দেওয়া দরকার। প্রথমে বর্ষার আগে ছকে দেখানো সারের অর্ধেক ও বর্ষার পরে বাকি অর্ধেক সার ছিটিয়ে গাছের গোড়ার মাটি কুপিয়ে প্রয়োগ করতে হবে ।
ছক- বয়ক (ফলন্ত) কামরাঙ্গা গাছে সার প্রয়োগের পরিমাণ
সারের নাম | প্রতি বছর গাছ প্রতি সারের পরিমাণ |
গোবর সার | ৪০ কেজি |
ইউরিয়া | ১ কেজি |
টিএসপি | ১.৫ কেজি |
এমপি | ১.০ কেজি |
সেচ (Irrigation): বড় গাছের সেচের বিশেষ প্রয়োজন হয় না । চারা অবস্থায় গরমকালে ও সার প্রয়োগের পর সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। চারার প্রথম অবস্থায় প্রতি মাসে নিয়মিত একবার সেচ দিতে হবে।
ছাঁটাই: ভালো ফলন পেতে যত্ন ও পরিচর্যা প্রয়োজন । ফল শেষ হয়ে গেলে হালকা ভাবে ডাল ছাঁটাই করে গাছের আকৃতি সুন্দর করতে হয় । গাছ বড় হয়ে গেলে গাছের নিচে ঘন ছায়া হওয়ার জন্য সাথী ফসলের চাষে অসুবিধা সৃষ্টি করে ।
পোকা মাকড় ও রোগ বালাই দমন কৌশল
এই গাছে তেমন রোগ ও পোকা নেই বললেই চলে । ফল পাকলে বা পাকতে শুরু করলে বাদুর, কাঠবিড়ালির অত্যাচার শুরু হয় । কাঁচা অবস্থায় টিয়াপাখি কঁচা ফল কেটে নিচে ফেলে বিনষ্ট করে ।
ফল সংগ্রহ ও সরক্ষণ পদ্ধতি
বীজের গাছে ৩-৪ বছরের মধ্যে ফুল আসলেও ভালো ফলন ৫-৬ বছরের আগে হয় না। কলমের গাছে ১ বছরের মধ্যে ফুল ধরে । সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং জানুয়ারি - ফেব্রুয়ারি মাসে ফল পাকে । ফল পুষ্ট হলেই পাড়া হয় । পুষ্ট ফলের রং ইষৎ হলদে হয় এবং শিরাগুলির গভীরতা কমে পরিপূর্ণ হয়ে যায় । পাড়া ফল রেখে দিলে কয়েকদিনের মধ্যেই পেকে যায় । প্রতিটি পুর্ন বয়স্ক গাছ হতে বছরে ৬০০-৮০০ টি ফল পাওয়া যায় ।
ফল সংরক্ষণ: পাকা ফলের রস থেকে জেলি তৈরি করা যায় এবং এই জেলি বেশ সুস্বাদু হয় । এছাড়া মুখরোচক আচার তৈরি হয় ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। আমড়া ফলে বিদ্যমান ভিটামিন ও খনিজ পদার্থগুলো কি কি ?
২। আমড়া গাছ রোপণের উপযুক্ত সময় কখন ?
৩ । আমড়া গাছের কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা দমনে কি ঔষধ ব্যবহার করা হয় ?
৪ । কামরাঙ্গা গাছ রোপণের জন্য গর্তের মাপ কত হবে ?
৫ । ফলন্ত কামরাঙ্গা গাছ প্রতি গোবর, টিএসপি এবং এমপি সারের প্রয়োগ মান কত ?
৬। কামরাঙ্গা কি কি রোগ উপশমে ব্যবহার করা হয় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। কামরাঙ্গা চাষে জমি ও মাটির চাহিদা লেখ ।
২। কামরাঙ্গা গাছে সার প্রয়োগে কৌশল বর্ণনা করা ।
৩ । আমড়ার রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ।
৪ । কামরাঙ্গার ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ সম্পর্কে লেখ ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১ । আমড়ার চাষাবাদ কৌশল বর্ণনা কর ।
২। কামরাঙ্গার চাষে জমি নির্বাচন, জমি তৈরি, গর্ত খনন, সার প্রয়োগ ও অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ ।
আঙ্গুর চাষাবাদ ফলের মধ্যে আঙ্গুর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। আঙ্গুর সুপাচ্য, পুষ্টিকর ও তৃপ্তিদায়ক। এর উৎপাদন বিশ্ব ফল উৎপাদনের অর্ধেক। আর পৃথিবীর প্রচীনতম ফলসমূহের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের মানুষের নিকট আঙ্গুর কোন নতুন ফল নয় । বরং এদেশের সবার কাছে সুপরিচিত ও সমাদৃত । বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সীমিত আকারে আঙ্গুর চাষ হচ্ছে। কিন্তু এগুলো গুনে ও মানে উন্নত মানের নয়। বর্তমানে পৃথিবীর অনেক উষ্ণ মন্ডলে উৎকৃষ্ট মানের আঙ্গুর চাষ হচ্ছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশেও উৎকৃষ্ট মানের আঙ্গুর চাষের সম্ভবনা আছে। তথ্য মতে বর্তমানে বাংলাদেশে দুটি জাতের আঙ্গুর চাষ শুরু হয়েছে। একটি জাককাট জাতের অন্যটি হলো বাকরুবী বা কালো আঙ্গুর। এ দুটি জাতের আঙ্গুরেই বীজ থাকে। জ্যাককাউ জাতের আঙ্গুর সম্পূর্ণ না পাকলে টক মিষ্টি স্বাদের । কিন্তু কালো আঙ্গুর খেতে বেশ ভালো । বাক রুবী জাতের আঙ্গুর বাংলাদেশে বছরে দু'বার ফল দেয়। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বাড়িতে যেখানে বৃষ্টির পানি দাড়ানো এমন জায়গায় খুব অল্প পরিশ্রমে ও কম খরচে কালো আঙ্গুর গাছ লাগিয়ে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে আর্থিক দিক দিয়ে প্রচুর লাভবান হতে পারেন ।
মাটি ও জমি নির্বাচন
উর্বর দো আশ ও বেলে দোঁআশ মাটি ও রৌদ্রযুক্ত খোলা মেলা জায়গা আঙ্গর চাষের জন্য উপযুক্ত । আড্ডর গাছ যে কোন মাটিতে হতে পারে, তবে উঁচু পানি সুনিষ্কাশিত ব্যবস্থাযুক্ত উর্বর বেলে দোঁআশ মাটি সবচেয়ে উত্তম । আঙ্গুর কিছুটা লবণাক্ততা ও ক্ষারত্ব সহ্য করতে পারে কিন্তু অতিরিক্ত চুন ক্ষতিকর । বেলে কাকুরে মাটিতেও আচ্ছর ফল ভালো হয় ।
চারা রোপণের জন্য জমি ও গর্ত তৈরি পদ্ধতি এবং সার প্রয়োগ কৌশল
রৌদ্র উজ্জল খোলামেলা আলো বাতাস যুক্ত জায়গা আঙ্গর চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে । চারা রোপণের আগে জমি ভালোভাবে চাষ দিয়ে অসমতল জমি সমতল করতে হবে । জমির ক্ষয়রোধের জন্য উপযুক্ত বাঁধের ব্যবস্থা করতে হবে । জমি প্রস্তুত হলে চারা লাগানোর জায়গা গুলো ৭৫ সে:মি: × ৭৫ সে:মি: × ৭৫ সে:মি: মাপের গর্ত খুড়ে প্রতি গর্তে ৫০ কেজি খামার জাত সার মাটির সাথে মিশিয়ে গর্তগুলো ভরাট করতে হবে । চারা রোপণের কমপক্ষে তিন সপ্তাহ পূর্বে গর্ত খনন করা উচিত। চারা রোপণের সময় গর্তের মাটির সাথে ১২৫ গ্রাম করে টি এসপি ও এমপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। বর্গাকার পদ্ধতিতে ৪×৪ মি: দূরত্বে গর্ত খনন করতে হবে।
চারা রোপন (Method of Planting )
সমতল জমিতে বর্গাকার বা আয়তকার পদ্ধতিতে এবং পাহাড়ি এলকার জমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে কলমের চারা রোপণ করা হয় । গর্ত তৈরির ২০-২৫ দিন পর চারা রোপণ করতে হয় । প্রতি গর্তে ২-৩ টি করে আঙ্গুরের কাটিং বসানো হয় । পরে তেজী চারটি রেখে বাকি চারাগুলো তুলে ফেলতে হয়। এক বছর বয়স্ক চারার ৪টি মুকুল রেখে বাকি অংশ ঘেঁটে দেওয়া হয় এবং এই রকম চারাগুলোকে গোড়ার মূলসহ তুলে নিয়ে প্রতি গর্তের ঠিক মাঝখানে সামান্য মাটি সরিয়ে একটি চারা সোজাভাবে বসানো হয় । চারাগুলো বসানোর পর গাছের পাড়ায় মাটি ধরিয়ে সামান্য চাপ দিতে হবে । এবং প্রত্যেক গাছে হালকা ভাবে সেচ দিতে হবে । প্রতি (চারা কাঠি দিয়ে বেঁধে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন ।
চারা রোপণের সময় (Time of planting )
সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সরাসরি জমিতে আর গাছের কাটিং বসানো হয়। জুন মাসে রোপণ ভালো, তবে ঠিকমত যত্ন করলে সারা বছর আঙ্গর চারা লাগানো যায় ।
চারা রোপণ দূরত্ব (Spacing) সারি থেকে সারি এবং গাছ থেকে গাছ পরস্পর ৪ মিটার দূরত্বে চারা রাপেণে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয় ।
আঙ্গুর গাছ রোপণের পরবর্তী পরিচর্যা
আগাছা দমন: আড্ডর বাগানে আগাছা দমন একান্ত প্রয়াজন । গাছের গোড়ায় আগাছা জন্মালে তা তুলে ফেলতে হবে । কারণ আগাছা মুল গাছের ক্ষতি করে থাকে এবং খাদ্য গ্রহনে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে ।
বাউনি দেওয়া: আঙ্গুর গাছ যেহেতু একটি লতানো উদ্ভিদ; তাই গাছে বাউনি দেওয়া আবশ্যক । বাউনি (মাচান স্থায়ী হওয়ার প্রয়োজন । টাই- এর পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাউনি দেওয়ার নিম্নোক্ত পদ্ধতিসমূহ বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে ।
ক) হেড পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে গাছের ডালপালা এমন ভাবে ছাঁটাই করা হয় যাতে গাছ একটি গুল্মের আকৃতি ধারন করে । যে সব জাত প্রশাখার গোড়ার দিকে ফল উৎপন্ন করে এ পদ্ধতি সেগুলোর জন্য উত্তম । বাউনি না দিলে উৎপাদন খরচ কম হয় কিনতু ফলনও সেই সাথে কমে যায় ।
(খ) একটি খুঁটি (Single Stake): বাওয়ার জন্য প্রতি গাছে একটি করে খুটি দেওয়া হয় । লতা বাওয়ার জন্য খুঁটির সাথে সমান্তরালে বাঁশ বা কাঠের লাঠি দেওয়া হয় ।
(গ) কউন পদ্ধতি: এতে গাছের সারি বরাবর কিছু দূরে দূরে শক্ত খুঁটি পুতে তার দিয়ে খুঁটিগুলি সংযুক্ত করে বেড়ার মত কাঠামো তৈরি করা হয়। তার নির্দিষ্ট সংখ্যক শাখা তারের সাথে সমান্তরাল করে বেঁধে দেওয়া হয় ।
(ঘ) বাওয়ার পদ্ধতি: টেকসই বস্তু দিয়ে বিভিন্ন আকারের মাচান বা খিলান (Pergola) তৈরি করে দুই পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে গাছ লাগানো হয় এবং মাচানের উপর ডালপালা দিয়ে লাউ কুমড়া গাছের মত বাইয়ে বাওয়ার সুবিধে করে দেওয়া হয় ।
ছাঁটাই (Pruning)
আঙ্গুর গাছে টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । কারন ছাঁটাই দ্বারা গাছ ফল ধারনে প্রভাবিত হয়। ছাটাই এর পদ্ধতি নির্ভর করে গাছের দৈহিক বৃদ্ধির উপর । যে সব এলাকায় সুস্পষ্ট শীতকাল আছে সেখানে শীতকালে পাতা ঝরে যায় । তখনই ঘটাই করতে হয়। শীতের শেষে নতুন গজানো ডালপালায় ফুল উৎপন্ন হয় । সারা বছর উষ্ণ থাকে এমন স্থানে আঙ্গুরের গাছ পত্র মাচেন করে না । সেই ক্ষেত্রে ফল ধরাতে হলে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে গাছে সুস্তি অবস্থা আনতে হবে। তখন ডালপালা ছাটাই করতে হবে । আঙ্গুরের শাখার প্রতিটি পাতার কক্ষে দুটি করে সুপ্ত কুড়ি থাকে। এর মধ্যে বড়টি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে পাতা ও ফুল উৎপন্ন করে। ছোটটি কেবল পাতা উৎপন্ন করে ।
যদি সুপ্তিকালে শাখার আগা কেটে ফেলা হয় তাহলে কক্ষের ছোট কুড়িটি বাড়তে শুরু করে এবং এর প্রভাবে বড়টির সুতি ভেঙে যায় এবং তা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে ফুল উৎপন্ন করে। এ ভাবে শীতের প্রভাব ছাড়াও ফল উৎপাদিত হয় । আঙ্গুর গাছ হেঁটে (Pruning) ও সঠিক ভাবে লতিয়ে (Trailing) ফলন বাড়ানো যাবে, গাছ ছাঁটাই করা ছাড়াও সরু ডাল পাতলা করা ও ফল পাতলা করা প্রয়োজন। এতে ফলের আকারও পরিমান বৃদ্ধি পাবে এবং গুণগত মান বাড়বে। গাছে সঠিক পরিমাণ ও নিয়মিত ফলন পেতে মোটা ডালের কিছুটা ছাল তুলে (girdling) দেওয়া হয় ।
সারের উপরি প্রয়োগ ও সেচ ব্যবস্থাপনা
আঙ্গুর গাছে নিয়মিত সার প্রয়োগ আবশ্যক। আঙ্গুর গাছে পটাশ সারের প্রয়োজন খুব বেশি। প্রথম বছর প্রতি গাছে ১০ কেজি জৈব সার, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম সুপার ফসফেট এবং ২৫০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করতে হয় । তারপর প্রতি বছর প্রতি গাছে ৫কেজি জৈব সার, ১০ গ্রাম ইউরিয়া ও সুপার ফসফেট এবং ৩২০ গ্রাম এমপি সার দিতে হয় । ৫ বছরের বেশি বয়সের গাছে ২০ কেজি গোবর সার, ১.৫ কেজি নাইট্রোজেন সার, ৩ কেজি সুপার ফসফেট ও ৪.৫ কেজি এমপি সার প্রয়োজন । গাছ ফল ধরা শুরু করলে সার দেওয়ার সময় পরিবর্তন করতে হবে । শীতকালে ঘটাই করার পর জৈব সার, ফসফেট এবং অর্ধেক নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করতে হবে । বাকি সার গ্রীষ্মকালে ছাটাই এর পর প্রয়োগ করতে হবে ।
সেচ (Irrigation): গাছের বৃদ্ধি ও কাঙিক্ষত ফল ধরার জন্য গাছের গোড়ায় রস থাকা দরকার। গাছের গোড়ায় ৮ সে:মি: গভীর সেচের পানি অবশ্যই প্রয়োজন। গাছ ছাটাইয়ের পর গ্রীষ্মকালে সেচ দরকার। সার প্রয়োগের পর কিংবা ফল বৃদ্ধির সময় সেচ দিতে হয়। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে মাটি ও আবহাওয়া অনুযায়ী ১৫-২০ দিন অন্তর সেচের প্রয়োজন ।
পোকামাকড় ও রোগ বালাই দমন কৌশল
বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও রোগ দ্বারা আঙ্গুর গাছ আক্রান্ত হয়ে থাক । রোগ ও পোকা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে । মাজরা পাকা গাছের প্রধান শাখার ত্বকভেদ করে কাণ্ডের মধ্যে প্রবেশ করে এবং কাণ্ডের মধ্যে বসবাস করে ক্রমাগত গাছের ছাল খেয়ে ফেলে। অধিক আক্রমণে আক্রান্ত শাখাগুলো শুকিয়ে যায়। আলকাতরার সাহায্যে গর্তের ফুটগুলো বন্ধ করে এই পোকা দমন করা যায় ।
ক্লী বিটল: শুককীট ও পূর্ণাঙ্গ পোকাগুলো আঙ্গুর গাছের নরম পাতা এবং শাখাসহ মুকুল গুলো খেয়ে ফেলে ও গাছের বৃদ্ধি রহিত করে। প্রতিকারের জন্য আক্রমণের শুরুতে ৫০% মিথাইল প্যারালিয়ন স্প্রে করে এদের সহজে দমন করা যায় ।
মাকড়, আঁশ পোকা, জেসিড, থ্রিপস: রস শোষক পোকাগুলো দলবদ্ধ ভাবে আঙ্গুর গাছের পাতা, শাখা, মুকুল ইত্যাদির রস শাষেন করে । এর ফলে গাছ বিবর্ন হয়ে বৃদ্ধি রহিত হয় । প্রতিকারের জন্য রগর ৩০ ইসি আক্রান্ত গাছে রোদর দিনে স্প্রে করতে হবে ।
অ্যানথ্রাকনোজ: এ রোগের আক্রমণে গাছের শাখার ডগায়, ফুলেও ফলে বাদামি রঙের গালে ছাপ পড়ে । সেগুলোর কিনারা কালচে দেখায় । এই অংশগুলো শুকিয়ে যায় এবং পাতা ঝরে পড়ে। ফুল আক্রান্ত হলে ফল ধরে না । আবার ফল আক্রান্ত হলে ফেটে যায় । ডাল ছাঁটাই এর পর বার্দোমিশ্রন ছিটালে উপকার পাওয়া যায়।
ডাউনি মিলডিউ: এ রোগের আক্রমণে আঙ্গরের ভীষণ ক্ষতি হয়। আক্রান্ত হওয়ার পরেই রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে । আক্রান্ত পাতায় রোগ বেশি দেখা যায়। আক্রান্ত পাতার উপরে সবুজ ছাপে এবং নিচে সাদা সাদা গুড়ো দেখা যায় । এগুলো ঘষলে উঠে যায় । আর্দ্রতা বেশি হলে রোগটি বেড়ে যায় । কচি পাতায় আক্রমণ বেশি হয় । বোর্দো মিশ্রন স্প্রে করে এদের দমন করা যায় ।
ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কৌশল
বাংলাদেশে শীতের শেষে ফুল আসে এবং জুন-আগস্ট মাসে ফল পাকে। এই সময় বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় ফল মিষ্টি হয় না। রোগ ও পোকার আক্রমনে ফল নষ্ট হয়। ফলে তালোর নিয়ম হলো গাছের ফল নাড়া দিলে ২/১ টা ফল পড়ে যায় । সেই সময় গুচ্ছটি কাচির সাহায্যে কেটে নিতে হবে । গুচ্ছ গুলো একই সঙ্গে না পাকায় ফল সংগ্রহ কয়েক দিন ধরে চলে। জাত ও স্থানের উপর ফলন নির্ভর করে। হেক্টর প্রতি ফলন ২০-২৫ টন পর্যন্ত ফলন হয়ে থাকে । ফল পাকার সহজ লক্ষণ হলো । ফলের গায়ের সাদা আবরণ ধীরে ধীরে মিশে যায় এবং চকচকে দেখা যায় ।
ফল সংরক্ষণ (Fruit preservation): জাত অনুসারে হিমাগারে ০° সে থেকে ২০ সে: তাপমাত্রায় ৮৫-৯০% আর্দ্রতায় ৪-৬ সপ্তাহ রাখা যায়। গাছ হতে ফল সংগ্রহের পর ঠিকমত গুদামজাত করলে ১৫-৪০ ভাগ ফল নষ্ট হয় । এই অপচয় বন্ধ করতে গাছ থেকে ফল পাড়ার ৪ দিন পূর্বে ফলের গায়ে ০.২ শতাংশ ক্যাপটেন প্রে করতে হবে।
লটকন (Latkan) চাষাবাদ কৌশল
এটা বাংলাদেশের একটি বুনো ফল। এদেশে লটকা বা লটকন নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে এটি লটকা বা নটকা ফল নামে পরিচিত। তবে জানা গেছে যে চীন দেশেও এ ফলটির চাষাবাদ রয়েছে এবং সেখানেও এ ফলটি লটকা নামেই পরিচিত। ছোট গালাকার ফলের ভিতরে থাকে অম্ল মধুর শাস । শাসের মধ্যভাগে তিন চারটি মাংসাল বড় বীজ থাকে এবং খেতে খুবই সুস্বাদু। লটকন খুব কম গুরুত্বপূর্ণ ফল হওয়ায় এই ফলের চাষের বিকাশে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষনা করা হয় নাই। ঢাকার আশেপাশে গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, কিশারেগঞ্জ, টাঙ্গাইল এলাকায় এর চাষ বেশি হয় । বাংলাদেশের আর্দ্র আবহাওয়ায় দেশের সর্বত্রই এই ফল চাষের সুযোগ রয়েছে । ফলটির নতুন জাত উদ্ভাবন এবং উন্নতির দিকে লক্ষ্য দিলে ভবিষ্যতে জনপ্রিয় ফল হিসাবে বিস্তার লাভ করার সুযোগ রয়েছে।
মাটি ও জমি নির্বাচন
লটকন গাছ যে কোন মাটিতে হতে পারে । তবে উঁচু বা মাঝারি উঁচু সুনিষ্কাশন ব্যবস্থাযুক্ত উর্বর বেলে দোআশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী । এই গাছের অম্লমাটি সহনশীল ক্ষমতা রয়েছে । গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না । রৌদ্রো উজ্জল উন্মুক্ত জায়গায় বা আংশিক ছায়াযুক্ত জায়গায়ও লটকনের চাষ করা যায় ।
গাছ রোপণের জন্য জমি তৈরি, গর্ত তৈরি ও সার প্রয়োগ
চারা রোপণের আগে জমি ভালো ভাবে চাষ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার ও অসমতল জমি সমতল করে নিতে হবে । জমি প্রস্তুত হলে চারা লাগানোর স্থানগুলো কাঠি পুতে চিহ্নিত করতে হবে । গাছ বসানোর একমাস আগে থেকে নির্দিষ্ট আকারের গর্ত তৈরি করে নিতে হবে। প্রতি গর্তের মাপ হবে ৬০ সে:মি: ৬০ সে:মি:×৬০ সে:মি: । প্রতি গর্তে ঝুরঝুরে মাটির সঙ্গে ১৫-২০ কেজি গোবর সার, ২কেজি কাঠের ছাই, ৫০০ গ্রাম হাঁড়ের গুড়া মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে ফেলে রাখতে হবে
চারা রোপণ পদ্ধতি (Method of planting )
গর্তের মাঝখানে চারা বসিয়ে সেচ দিতে হবে। গোড়ার মাটি একটু উঁচু করে দিতে হবে। চারা রোপণের পর বাঁশের ঠেকনা দেওয়া দরকার হয়। ৩০ সে:মি: লম্বা চারা রোপণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।
চারা রোপণের সময় (Time of planting)
বর্ষাকাল জুলাই-আগষ্ট মাসে চারা রোপণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় । এর আগে বা পরে চারা রোপণ করা যায় । তবে সে জন্য সেচের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অর্থাৎ সেচের ব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই চারা রোপণ করা যায়।
রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা
উপরি সার প্রয়োগ: এই ফলের গাছের সারের বিশেষ চাহিদা নেই । ভালো ফলনের জন্য এবং চারা সতেজ করার জন্য সার প্রয়োগ প্রয়োজন । বর্ষার আগে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিয়ে গাছ প্রতি ১৫ কেজি গোবর সার, ২ কেজি কাঠের ছাই, ২০০ গ্রাম হাড় গুড়া, তার সঙ্গে ১০০ গ্রাম এনপিকে (১০:২৬:২৬) মিশিয়ে দিতে হবে । এর পর পর সেচ দিতে হবে। ফলন্ত বড় গাছের জন্য প্রতি বছর ফুল আসার আগে ২০ কেজি গোবর সার ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম ফসফরাস ও ১০০ গ্রাম পটাশ গোড়ার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
সেচ: গোড়ার মাটিতে সব সময় উপযুক্ত রস থাকা প্রয়োজন। চারা ছোট অবস্থায়, গরমের সময়ে ও সার প্রয়োগের পর সেচ দেওয়া প্রয়োজন ।
ডাল পালা ও ফল ছাঁটাই: শুকনা রোগাক্রান্ত ও দুর্বল ডালপালা কেটে দেওয়া ছাড়া তেমন যত্নের প্রয়োজন হয় না । বেশি ফল ধরলে ফলের থাকো থেকে কিছু ফল ছিড়ে হালকা করে দিলে অবশিষ্ট ফলের আকৃতি বড় হবে । গাছের নিচে সাথি ফসল চাষে অসুবিধা আছে কারণ লটকন গাছ বেশ ঝাপালো ধরনের হয়ে থাকে ।
পোকা মাকড় ও রোগ বালাই দমন
লটকন শক্ত ধরনের গাছ। এ গাছে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয় । মাঝে মাঝে পাতা খাওয়া পোকার আক্রমণ হয় । এ পোকা দমনে বি এইচ সি ৫০% গুড়ো, পানিতে গুলে ছিটালো উপকার পাওয়া যায় ।
ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
আগস্ট মাসে ফল পাকে। ফলের থোকায় রং ধরা শুরু করলে থাকো সমেত ফল পেড়ে ঝুড়িতে রাখা হয় । ঘরের গরম জায়গায় ফল রাখলে পেকে যায়। ফলের গায়ে আঘাত বা ঘষা লাগলে খোসার গায়ে কালচে দাগ পড়ে । ফলের মান কমে যায়। বীজের গাছ ৬-৭ বছর থেকে ও কলমের গাছ ৩-৪ বছর থেকে ফল দেয়া শুরু করে । ৮-১০ বছরের ভালো গাছ থেকে ২০০-২৫০ কেজি ফল পাওয়া যায় ।
ফল সংরক্ষণ ও আলো বাতাস চলাচল করে এমন শুকনো স্থানে মাচানের উপর রাখলে অল্প সময়ের মধ্যে সংরক্ষণ করা যায় ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। আঙ্গুরের কয়েকটি জাতের নাম লেখ ?
২। এক বছর বয়স্ক আঙ্গুর গাছে কয়টি মুকুল রেখে বাকিগুলো হেঁটে দিতে হয় ?
৩। আঙ্গুর গাছে অ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমনে কি ব্যবস্থা নেয়া হয় ?
৪। আঙ্গুরের রস শোষক পোকা দমনে ব্যবহার যোগ্য কীটনাশকের নাম লেখ ।
৫ । লটকন গাছ রোপণের উপযুক্ত সময় কখন (মাসের নাম) ?
৬। ফলন্ত লটকন গাছে প্রতিবছর কী পরিমাণ গোবর, টিএপি এবং এমওপি সার প্রয়োগ করা দরকার ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। লটকনের জমি ও মাটি নির্বাচন এবং গর্ত তৈরি সম্পর্কে লেখ ।
২। লটকনের অন্তর্বর্তী পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ ।
৩। আঙ্গুর সংগ্রহ ফল সম্পর্কে লেখ ।
৪ । আঙ্গুরের জাতসমূহ লিপিবদ্ধ কর ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। আঙ্গুরের জমি ও মাটি নির্বাচন জমি তৈরি এবং চারা রোপণ কৌশল বর্ণনা করা
২। আঙ্গুর চাষে বাউনি দেওয়া ও ঘটাই সম্পর্কে বর্ণনা কর ।
৩। আঙ্গুর গাছে সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ ।
৪ । লটকনের চাষাবাদ কৌশল বর্ণনা কর ।
৫। আঙ্গুরের পোকা মাকড় ও রোগ বালাই দমন কৌশল সম্পর্কে লেখ ।
কোন জমিতে প্রধান ফসলের সাথে অন্য কোন ফসল চাষ করার প্রক্রিয়াকে আন্তঃফসল চাষ আর অতিরিক্ত যে ফসল চাষ করা হয় তাকে সাথী ফসল বলে । মাথাপিছু আবাদি জমির স্বল্পতা, মাটির উর্বরতা, কৃষকের আর্থিক অস্বচ্ছলতা, জনসংখ্যাধিক্য, সহজলভ্যতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ফলের বাগানে সাথী ফসল চাষের জন্য খুবই উপযোগী । আমাদের দেশে ফল বাগান করলে প্রাথমিক ভাবে বেশ কয়েক বছর লেগে যায় ফল পেতে এবং সম্পূর্ণ জায়গা পূরণ করতে । এই সময় যদি বাগানে আতফসলের চাষাবাদ করা যায় তবে বেশ কিছু টাকা আয় করা যায় । তাছাড়া বাগানে আগাছা জন্মে না । লিগুম জাতীয় আনতফসল চাষ করলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় । ভুমি ক্ষয়রোধ হয়। আচ্ছাদন জাতীয় সাথী আন্তঃফসল চাষ করলে বাগানের আর্দ্রতা সংরক্ষিত হয়। ফল বাগানে আফসল চাষ করতে গেলে ফসল নির্বাচনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সাথী ফসল যেন বাগানের মাটিকে অনুর্বর ও অনুৎপাদনশীল করে না তুলে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে ।
সাথী ফসল নির্বাচনের জন্য বিবেচ্য বিষয়াবলি
সাথী ফসল নির্বাচন ও চাষ করার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়াবলি বিবেচনা করা একান্ত প্রয়োজন ।
১। সাথী ফসল কোন সময়ই মূল বা প্রধান ফসলের সাথে পানি ও খাদ্য উপাদানের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে না ।
২। সাথী ফসল বাগানে পোকা মাকড় ও রোগ বালাইয়ের উৎস হিসেবে কাজ করবে না ।
৩। সাথী ফসল মূল ফসলের জন্য আন্তঃপরিচর্যা, প্রনিং, সেচ, ঔষধ ছিটানো, সার প্রয়োগ ইত্যাদি কাজে কোন বাধা সৃষ্টি করবে না ।
৪ । মূল ফসলের ফুল ফল ধারণে সাথী ফসল কোন ক্ষতি করবে না ।
৫। সাধারণভাবে সাথী ফসল হিসেবে বহুবর্ষজীবী ফসল অপেক্ষা একবর্ষজীবী বা কম সময়ের ফসলকে প্রধান্য দেওয়া উচিত ।
৬। সাথী ফসল কোন সময় প্রধান ফসলের ফুল, ফল ধারণ, বৃদ্ধি ও পরিপক্বতা এবং গুণগত মানের ক্ষতি করবে না ।
৭ । ফল বাগান থেকে আগাম অর্থিক সুবিধা পাওয়ার উদ্দেশ্যে সাথী ফসল চাষ করা হয় সেহেতু সাথী ফসল হিসেবে তুলনামূলকভাবে দামি ফসলকে নির্বাচন করতে হবে। এ জন্য স্থানীয় বাজারের চাহিদা ও দামের ওপর নির্ভর করে সাথী ফসল নির্বাচন করা উচিত ।
৮। সাধারণভাবে লিগিউম বা সীম জাতীয় ফসলসহ যাদের ভালো বাজার মূল্য আছে সেগুলোর চাষ করা উচিত । কারন সীম জাতীয় ফসল আর্থিক সহায়তার সাথে সাথে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমান বাড়ায় ।
৯। সাথী ফসল মূল ফসলের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার সাথে সাথে কেটে ফেলতে হবে । আমাদের দেশে স্বল্পমেয়াদি ফল বাগানে বিভিন্ন ধরনের শাক সবজী, তেল ও ডালজাতীয় ফসলের চাষ করা হয় । অন্য দীর্ঘ মেয়াদী ফল বাগানে স্বল্পমেয়াদি ফল গাছ যেমন- পেঁপে, কলা, আনারস, লেবু, আতা, শরীফা ইত্যাদি ফলের চাষ করা হয় ।
সাথী ফসল আবাদের পদ্ধতি
বাগানে সাথী ফসল বা আন্তঃফসল চাষ করতে হলে সাথী ফসলের বৈশিষ্ট্য ও ফল বাগানে গাছের বৃদ্ধি বা বাড়ন্ত অবস্থা লক্ষ্য করে সাথী ফসল আবাদের জন্য নির্বাচন করতে হয় । সাথী ফসল যাতে বাগানের মাটিকে অনুৎপাদক বা অনুর্বর না করে সেদিকে লক্ষ্য রেখে আবাদ করতে হয়। দীর্ঘমেয়াদি ফল বাগানে কী ধরনের সাথী ফসল করা যাবে সেগুলোর সম্পর্কে উল্লেখ করা হলো:
আবাদের জন্য সাথী ফসলের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে ফসলগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে যেমন
ক) অধিক সূর্যালোক পছন্দকারী- কলা, পেঁপে, পেয়ারা, টমেটো, মরিচ, বেগুন, বীট, গোল আলু, গাজর, লেটুস, পালংশাক, মুলা, পেয়াজ ইত্যাদি
খ) মাঝারী সূর্যালোক পছন্দকারী - লেবু, আনারস, ডালিম, পেয়ারা, জামরুল, জাম্বুরা, করমচা, স্ট্রবেরী, মিষ্টি আলুশাক, কলমিশাক ইত্যাদি ।
গ) কর্ম সূর্যালোক পছন্দকারী -- আদা, হলুদ, মানকচু, ওলকচু, মেটে আলু ইত্যাদি ।
বাগানে নতুন অবস্থায় উপরোক্ত বিষয় বিবেচনা করে কয়েক বছর সূর্যালোক ও মাঝারি সূর্যালোক পছন্দকারী ফসল সাথী ফসল হিসেবে সফলভাবে জন্মানো যায়। পরবর্তীতে ফল গাছ লাগানোর জমিতে ছায়া পড়ে গেলে কম সুর্যালােেক জন্মিতে পারে এমন ফসল গুলো চাষ করা উচিত। স্বল্পমেয়াদি কলা, পেঁপে, ডালিম, জামরুল ইত্যাদির সাথে ডালজাতীয়, সরিষা, মুলাশাক, লালশাক, ডাটাশাক, কলমীশাক, ধনেপাতা, ইত্যাদি স্বল্পমেয়াদি ফল বাগানে সাথী ফসল হিসাবে চাষ করা যায়। স্বল্পমেয়াদি ফলও বাগানে চাষ করা যাবে। এমনকি স্বল্প মেয়াদী ফল গাছ গুলোকে দীর্ঘমেয়াদি ফল বাগানে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করা যাবে ।
প্রধান মূল জাতীয় প্রধান ফসলের সাথে সাথী ফসল হিসেবে গুচ্ছ মূল জাতীয় ফসল নির্বাচন করতে হবে। যেমন পেয়ারা, ডালিম, কমলা, নাশপাতি ইত্যাদির সাথে পিয়াজ, লেটুস, গিমাকলমী, ইত্যাদি। তবে দীর্ঘমেয়াদী প্রধান মূলজাতীয় প্রধান ফসলের সাথে স্বল্পমেয়াদি প্রধান মূল জাতীয় ফসল কোন কোন ক্ষেত্রে জন্মানো যায় । যেমন আম, কাঁঠাল, লিচু, জামের সাথে ডালিম জামরুল পেঁপে ইত্যাদি। গভীর মূলজাতীয় ফসলের সাথে অগভীর মূলজাতীয় ফসল নির্বাচন করতে হবে। যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, ইত্যাদির সাথে কলা, আনারস পেঁপে ইত্যাদি। সাথী ফসল হিসাবে চাষ করা যেতে পারে।
কলা, পেঁপে, ডালিম, পেয়ারা, শরিফা, আতা, জামরুল, লেবু, ইত্যাদির সাথে লালশাক, গালে আলু, মুলা, পটল, মিষ্টি আলু, তরমুজ, ফুটি ইত্যাদি সাথী ফসল হিসাবে চাষ করা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী বা বহুবর্ষজীবী ফসলের সাথে স্বল্পমেয়াদি বা এক বর্ষজীবী ফসল নির্বাচন করতে হবে। যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল লিচু ইত্যাদির সাথে কলা, পেঁপে, আনারস, স্ট্রবেরি, বেগুন ইত্যাদি ।
উপরোক্ত পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করে ফলবাগানে সাথী ফসল চাষ করা হলে দেশের ফলের ঘাটতি পূরণ করে কৃষকের আর্থিক অস্বচ্ছলতা দূর করা যায়। মাটির উর্বরতা রক্ষার লক্ষ্যে ফলের বাগানের খালি জমিতে আগাম ফসল করে বেশি লাভ করা যায় এবং লোকের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় ।
সাথী ফসল চাষে জমির সদ্ব্যবহার ও আর্থিক সুবিধা
ফল বাগানে গাছ লাগানোর পর এর পরিপূর্ণ বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য বেশ কিছু সময়ের দরকার হয় । এই অন্তর্বর্তী সময়ে দু গাছের মাঝখানের জমি খালি থাকে । এ খালি জমিতে অস্থায়ী ফসল লাগিয়ে বাগান থেকে বেশ কিছু আগাম অর্থ উপার্জন করা যায় । এই অস্থায়ী ফসলটি হলো সাথী ফসঙ্গ । বাংলাদেশে মাথা পিছু জমির স্বল্পতা, মাটির উর্বরতা, কৃষকের আর্থিক অচ্ছলতা, জনসংখ্যাধিক্য, সহজলভ্যতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ফলের বাগানে সাথী ফসল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আমাদের দেশে ফল বাগানের সাথী ফসল চাষের বিশেষ সুযাগ ও সম্ভাবনা রয়েছে । কারন যে কোন দীর্ঘমেয়াদি ফলের বাগান করলে প্রাথমিক ভাবে বেশ কয়েক বছর লেগে যায় ফল পেতে এবং সম্পূর্ণ জায়গা পূরণ করতে । এই সময় যদি বাগানে আন্তঃফসলের চাষ করা যায় তবে কিছু টাকা আয় করা যায় । যার দ্বারা কৃষক বা সুবিধাভাগেী অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে আর্থিক ভাবে লাভবান হতে পারে। যেমন- কলা ও পেঁপে বাগানে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি সরিষা ও ডাল জাতীয় সাথী ফসলের চাষ করা হয় । অপর দিকে দীর্ঘমেয়াদি ফল গাছের..সাথী ফসল চাষের ফলে বাগানে আগাছা জন্মাতে পারে না । লিম জাতীয় আতঃ উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। ভূমি ক্ষয় রোধ হয়। আচ্ছাদন জাতীয় সাথী আন্তঃফসল চাষ করতে গেলে ফসল নির্বাচনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সাথী ফসল যেন বাগানের মাটিকে অনুর্বর ও অনুৎপাদক করে না তুলে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে ।
ছকে জমির সদ্ব্যবহার ও আর্থিক সুবিধার জন্য ফল বাগানে চাষযোগ্য সাথী ফসলের বর্ণনা দেওয়া হলো ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১ । লিগুম জাতীয় আন্ত ফসল চাষ করলে জমির কিকি উপকার হয় ?
২। দীর্ঘমেয়াদি ফল বাগানে রোপণযোগ্য স্বল্পমেয়াদি ফল গাছের নাম লেখ ।
৩ । কম সূর্যালোক পছন্দকারী কয়েকটি সাথী ফসলের নাম লেখ ।
৪ । এক বর্ষজীবী কয়েকটি ফসলের নাম লেখ ?
৫ । ফল বাগানে কি কি সাথী ফসল আবাদ করা যাবে ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১ । সাথি ফলের চাষ বলতে কী বোঝায় ?
২। সাথী ফসল ও ফসল পর্যায়ের মধ্যে পার্থক্য কী?
৩ । সাথী ফসল চাষের সুবিধা ও অসুবিধা লেখ ।
রচনামূলক প্রশ্ন।
১। সাথী ফসল নির্বাচনের নিয়মাবলি লেখ ।
২ । সাথী ফসল আবাদের পদ্ধতি ব্যাখ্যা কর ।
৩ । সাথী ফসল চাষে জমির সদ্ব্যবহার ও আর্থিক সুবিধা সম্পর্কে লেখ ।
৪ । ছকের মাধ্যমে ফল বাগানে চাষকৃত সাথী ফসলের বর্ণনা কর ।
গাছ ফল দেয়ার বয়সে উপনীত হওয়ার পরও যদি একেবারে অথবা কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ফল না দেয় তাহলে সেই গাছকে অফলন্ত গাছ বলা হয় । অফলন্ত গাছকে ফলবর্তীকরণের প্রক্রিয়াসমূহ আলোচনা করার আগে ফলন্ত ও অফলন্ত গাছ কী এবং ফল না ধরার কারণ কী তা আমাদের জানা উচিত ।
ফলন্ত গাছ কোন গাছ নিদৃষ্ট বয়সে উপনীত হওয়ার পর যদি পরিমিত ফুল ও ফল ধারণ করে এবং ফুল সংগ্রহ পর্যন্ত ফল বহন করে তখন তাকে আমরা ফলন্ত গাছ বলি । গাছে ফুলের মুকুল বিকশিত হওয়ার পর তা প্রস্ফুটিত হয় এবং পরাগায়ণ ও নিষিক্তকরণের পর ফুলের গর্ভাশয় স্ফীত হয়ে ফলে পরিণত হয়। ফলন্ত গাছে শুধু পরিমাণ । মত ফুল ফলই ধরে না, ফল পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত তা বহন করে। এটি ফলন্ত গাছের প্রধান বৈশিষ্ট্য । আমরা দেখি অনেক গাছে প্রচুর পরিমাণ ফুল ও ফল ধরে। কিন্তু সেই ফল পরিপক্ক হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে । এ ক্ষেত্রে গাছটিকে ফলন্ত বলা যাবে না । কারণ গাছটি যে ফল বহন করেছিল তা পরিপকৃতার আগেই ঝরে পড়েছে এবং তা চাষীর কোন কাজেই লাগেনি ।
অফলন্ত গাছ - কোন গাছ ফল দেয়ার বয়সে উপনীত হওয়ার পর যদি ফল না দেয়, ফুল, ফল ঝরে পড়ে, কম পরিমাণ ফল ধারণ করে অথবা অনিয়মিত ও ত্রুটিযুক্ত ফল দেয় তখন সেই ফল গাছকে আমরা অফলন্ত গাছ বলি ।
ফল না ধরার কারণ
গাছে ফলোৎপাদন ঠিকমত হয় না বা ফল ধরে না- এরুপ সমস্যা প্রায়ই দেখা যায়। এ অবস্থার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে । বিভিন্ন কারণগুলোকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে । যথা-
ক) অভ্যন্তররীণ কারণ ও
খ) বাহ্যিক কারণ
ক) অভ্যন্তররীণ কারণ (Internal factors)
বিভিন্ন গাছে যে অভ্যন্তররীণ সমস্যার কারনে ফল ধারণে বিলম্ব হয় বা আদৌ ফুল ও ফল হয় না বলে ধারণা করা হয় সে সমস্যা গুলো হলো
১। ফুলের অসম্পূর্ণতা (Imperfect flower)
২। অসম স্ত্রী কেশর
৩। ফুলের পুং ও স্ত্রী কেশরের পূর্ণতার সময়ের অমিল
৪ । পুষ্প কুঁড়ির পতন
৫ । পরাগ রেণুর হীন বলতা
৬। শংকরায়নজনিত বন্ধ্যাত
৭ । বংশগতিজনিত অসংগতি
৮ । রেণু নলের ধীরে বৃদ্ধি প্রাপ্তি
৯ । গাছের অভ্যন্তরস্থ খাদ্যোপাদানের জটিলতা
১০। কার্বোহাইড্রেট ও নাইট্রোজেনের অনুপাতে অসামঞ্জস্য
১। ফুলের অসম্পূর্ণতা: অধিকাংশ ফলের গাছে ফুল সম্পূর্ণ থাকলেও কতগুলি গাছ একাবাস পুল্লী (Monocecious) এবং কতগুলি গাছ ভিন্নবাস পুল্লী (Diocious) হয়ে থাকে । একলিঙ্গ ফুলের বেলায় একটি ফুলে অপর ফুলের পরাগ রেণুর সাহায্যে পরাগায়ন হয়ে থাকে । খেজুর, তাল, পেঁপে, ডুমুর, জাপানি পার্সিস, মাস্কাডিন আড্ডর এবং স্ট্রেবেরী এর উদাহরণ । কোন কোন কারনে স্ত্রী পুষ্পের কাছাকাছি পরস্পর অবস্থান না থাকলে পরাগায়ণ ও গর্ভধারণ সম্ভব হয় না ।
২। অসম স্ত্রী কেশর (Heterostyle): অনেক সময় উভয়লিঙ্গ ফুল হওয়া সত্ত্বেও গভদও ছোট এবং পুংকেশর বড় হয় অথবা বিপরীত ধরনের হতে পারে। এরূপ অবস্থায় স্বপরাগায়নে ব্যাঘাত ঘটে এবং ফল ধারণে সমস্যা দেখা দেয় । উদাহরণ- কাঁঠাল।
৩। ফুলের পুং ও মন্ত্রী কেশরের পুর্নতার সময়ে অমিল: কোন কোন পুংকেশর ত্রীকেশর অপেক্ষা আগে পূর্ণতা লাভ করে অথবা বিপরীত ঘটনাও ঘটে। এক্ষেত্রে স্বপরাগায়নের ব্যাঘাত ঘটে। উদাহরণ- নারিকেল, এ্যাভাকোডো, শরীফা ইত্যাদি ।
৪। পুষ্প কুঁড়ির পতন: অনেক গাছে অনেক সময় পুষ্পকুঁড়ি ফোটার আগে ফুল ঝরে যায় । উদাহারণ-টমোটো, আড্ডর, বিলাতী বেগুন ও স্টবেরি ইত্যাদি ।
৫। পরাগরেণুর হীন বঙ্গতা: কোন কোন গাছের ফুলে পরাগরেণুর উৎপাদন হয় অতি সামান্য এবং অধিকাংশ রেণু অকেজো হয় । এক্ষেত্রে কিছু কিছু ফল ধরেও তা বীজশূন্য হয় । উদাহারণ- মাস্কাতে জাতের আঙ্গর ।
৬। শংকরায়নজনিত বন্ধ্যত্ব: দুটি অতি দূরবর্তী জাতের মধ্যে শংকরায়ন ঘটলে এটি স্বপরাগায়নে অসমতা ঘটাতে পারে। কখনও কখনও সংকর শ্রেণির গাছে ধনিষেকী অপেক্সো অধিক পরনিকেষী ধরনের হতে পারে ।
৭। বংশগতজনিত অসংগতি: এমন কিছু ফল গাছ আছে যার ফুল নিজের রেণু বা একই জাতের অন্য গাছের রেনু দ্বারা পরাগয়িত হয় না উদাহরণ- বাদাম, আপেল, নাশপাতি ইত্যাদি ।
৮। রেণুনলের ধীর বৃদ্ধিঃ ফুলের গর্ভমুণ্ডে রেনু পতিত হওয়ার পর গর্ভদণ্ডের ধীর বৃদ্ধি ও ডিম্বকের মাথেমিলিনে বিলম্ব হলে ফল ধারণ বিঘ্নিত হতে পারে। উদাহারণ- নাশপাতি পীচ, পাম ইত্যাদি ।
৯। গাছের অভ্যরন্থ খাদ্যোপাদানের জটিলতা: আভ্যন্তরীণ খাদ্যাবস্থা বহু ক্ষেত্রেই গাছের ফলোৎপাদনের দুর্বলতা কিংবা অসমর্থতার জন্য দায়ী। ফল গাছে পুষ্পবস্থায় সময়ের আগে বা পরে অভ্যন্তরস্থ খাদ্যোপাদান স্বাভাবিক না থাকলে বহু ফুল ঠিকমত পরাগায়ণে ব্যর্থ হয় ।
১০। কার্বোহাইড্রেট ও নাইট্রোজেনের অনুপাত: গাছের কায়িক বৃদ্ধি ও ফলাৎপাদন ক্ষমতোক প্রভাবান্বিত করে । শুধু পরিমাণই নহে, বরং এদের পরিমাণের অনুপাত যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। খুব ভাল ফলন পেতে হলে কার্বোহাইড্রেট অধিক পরিমাণে এবং নাইট্রোজেন কিছু কম পরিমাণে এরূপ অনুপাতে থাকা দরকার ।
(খ) বাহ্যিক কারণ (External Factors)
অনেক সময় ফলের গাছ বড় হওয়ার পরও ফুল ধারণ করে না। আবার বয়ক গাছও নিয়মিত এবং আশানুরুপ পরিমান ফুল উৎপাদন করেন। এ সকল ক্ষেত্রে গাছের অভ্যন্তররীণ কারণের পাশাপাশি কিছু বাহ্যিক কারণ দায়ী ।
বাহ্যিক কারণগুলো যথা-
১। উত্তাপ ২ । আলো ৩ । আর্দ্রতা ৪। কুয়াশা ৫। বৃষ্টিপাত ৬। বায়ুবেগ ৭ । গাছ বা জমির অবস্থান ৮। ঋতু ৯। গাছের খাদ্য সরবরাহ ১০। গাছের বয়স ও প্রান শক্তি ১১। অঙ্গহটাই ১২। কলম করা ১৩। রোগ ও পোকা মাকড়ের আক্রমণ ১৪। জন্ম ত্রুটি ইত্যাদি ।
১। উত্তাপ (Temperature): অতিরিক্ত উত্তাপে ফুল ঝরে যেতে পারে, ফুলের গর্ভমুণ্ড শুকায়ে যেতে পারে, গর্ভমুণ্ডের আঁঠালো ভাব নষ্ট হতে পারে ইত্যাদি । বেশি ঠান্ডায় মৌমাছি মৌচাক ছেড়ে কোথাও যেতে চায়না, ফলে পরাগায়ণ ঠিকমত হয় না । অধিক ঠান্ডায় কলা, পেঁপে, ইত্যাদি গাছে ফল ধরা ব্যাহত হয় ।
২। আলো (Light): ছায়াময় স্থানে প্রায় সকল গাছের ফলন কম হয়। দিনের দৈর্ঘ্য কম বেশি হলে আলোর তারতম্য ঘটে । ফলে টমেটো, স্ট্রোবেরী ইত্যাদির ফল ধরা বিঘ্নিত হয় ।
৩। আর্দ্রতা (Humidity): মাটিতে রসের আধিক্য এবং বাতাসে কম আর্দ্রতায় ফল ঝরে যেতে পারে । বাতাসে বেশি আর্দ্রতায় আপেল ঝরে যায় । মাটিতে রসের অভাব হলে আম, লিচু, ইত্যাদি ঝরে যায় ।
৪। কুয়াশা: আম ও লিচুর ফুল আসার সময় বেশি কুয়াশা পড়লে ফুল ঝরে যায়। অনেক যফলের ক্ষেত্রেই অধিক কুয়াশায় ফল ঝরে যায় ।
৫। বৃষ্টিপাত (Rainfall): অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাতে ফুলের প্রাগরেণু ও গর্ভমুন্ডের আঁঠা ধুয়ে যায় । রেণু ফুলে ফেঁপে মোটা হয়ে বৃষ্টির সময় ফেটে যায় পরাগায়নে সাহায্যকারী পোকামাকড়ের ক্রিয়া লাপ কমে যায় ।
৬। বায়ুবেগ (Wind Velocity): বায়ু জোরে প্রবাহিত হলে ফুলের ক্ষতি হয় । কেননা পরাগরেণু বেশি দূরে ছড়ায়ে যায়, উপকারী পাকামাকড় চলাচল ব্যাহত হয় ।
৭। গাছ ও জমির অবস্থান: হয়তো স্থানীয় উত্তাপ, আর্দ্রতা, আলো এবং মাটির খাদ্যোপাদনের কারণে বরিশাল এলাকায় আমড়া, পেয়ারা, নারিকেল ভালো হয় অথচ অন্যস্থানে সুবিধাজনক হয় না। অনুরূপ রাজশাহী ও দিনাজপুরে আম ও লিচু ভালো হয় । অন্যত্র ভালো হয় না ।
৮। ঋতুঃ শীতকালে পেঁপে, কলা ইত্যাদি কম টিকে এবং ফল ছোট হয় । আবার আম লিচুর প্রথমভারের অপেক্ষা শেষের দিকের ফুলে বেশি স্বপরাগায়ন হয় ।
৯। গাছে খাদ্য সরবরাহ (Nutrient Supply): মাটিতে সঠিক পরিমাণের বেশি গাছের খাদ্যোপাদান থাকলে ফল উৎপাদন ব্যাহত হয়। আবার মাটিতে গাছের খাদ্যোপাদানের অভাবে গাছ দুর্বল হয়ে ফুল ও ফল ধারণে অসুবিধা হয় । অক্টোবর - নভেম্বর মাসে আমগাছে বেশি পরিমাণ ইউরিয়া সার দিলে ফল ধারণে সমস্যা হয় । অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করা হলে ফুল দেরিতে হয় এবং গাছে পোকা মাকড়ের আক্রমণ বেশি হয় । গাছে ফুল হওয়ার সময় বা ৭-১০ দিন আগে নাইট্রোজেন জাতীয় সার ব্যবহার করা হলে ফল টিকে থাকা অনেক গুণে বেড়ে যায় ।
১০। গাছের বয়স ও প্রাণশক্তি (Age and vigour of plant): কম থাকলে বয়সী নারিকেল, পেঁপে, সুপারি, আঙ্গুর ইত্যাদি গাছে প্রচুর ফুল ধরে ঝরে যায় । গাছে আবার অতিরিক্ত প্রাণশক্তি থাকলে দেরিতে ফুল আসতে পারে ।
১১। অঙ্গ ছাঁটাই (Pruning): লিচু, জাম, আঙ্গুর, কুল ইত্যাদি গাছের অজ্ঞা ছাটাই করা না হলে ফল ধারণ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আবার গাছ ভেদে অতিরিক্ত অঙ্গ ছাটাই ফল ধারন ক্ষমতা কমিয়ে দেয় ।
১২। কলম করা (Grafting): কলম করার সময় আদি চারা (স্টক) সঠিকভাবে নির্বাচন করা না হলে পরবর্তীতে কলমের গাছে ফলন কম হতে পারে। কাজেই সঠিক ষ্টক আগেই নির্বাচন করতে হবে।
১৩। রোগ ও পোকা মাকড়ের আক্রমণ (nsects and Diseases): সাধারণত কীট ও রোগের আক্রমণে ফলন কমে যেতে পারে । আমের হপার পোকা আম গাছের সম্পূর্ণ ফুল ঝরায়ে দিতে পারে। থ্রিপসপোকা নাশপাতি, আপেল ইত্যাদির ফুল বিনষ্ট করে দেয়। লাল পিপড়া, ইদূর নারিকেল ফল নষ্ট করে দেয় ।
১৪। ঔষধ ছিটানো (Spraying): গাছ পুষ্পিত হওয়ার কালে গাছে ঔষধ ছিটালে ফলনের বিশেষ ক্ষতি সাধিত হতে পারে। ঔষধ সরাসরি রেণু কিংবা গর্ভমুণ্ডের অনিষ্ট করে, অথবা পরাক্ষেভাবে মৌমাছি কিংবা অন্যান্য রেনু বাহক কীটের কাজে ব্যাঘাত ঘটায় । আপেলে ক্রমাগত লাইম সালফার ছিটানোর ফলে ফলন প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ কমে যায়। সঠিক সময়ে সঠিক ঔষধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে ।
অফলত গাছকে ফলবতী করার কৌশল
উদ্ভিদের ফল ধারণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং বিভিন্ন অভ্যন্তররীণ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে । কোন কোন ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রটির কারণে নিখুঁত ফল পাওয়া যায় না। ফল গাছের অকলাৎেপাদন সমস্যাকে তিনটি তরে ভাগ করা যায়। যথা-ক) ফল গাছে নিয়মিত ও যথাসময়ে ফুল না আসা খ) ফুলের পরাগায়ন ও নিষেকের প্রক্রিয়ায় ব্যর্থতা এবং গ) ফুল ঝরে পড়া। গাছে ফুল না হওয়ার সমগত সমস্যাকে সহজে বা স সমাধান করা সম্ভব নয় । তবে আগে থেকে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে কিছু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এগুলো এড়ানো যেতে পারে এবং গাছকে ফবর্তী করা যেতে পারে। অফলন্ত গাছকে ফলবর্তীকরণের কয়েকটি পদক্ষেপ নিচে আলোচনা করা হলো :
১। বিপরীত লিঙ্গের গাছ জন্মানো এবং কৃত্রিম পরাগায়ন (Growing plants of opposite sex and artificial pollination): যে সব গাছে স্ত্রী ও পুরুষ ফুল ভিন্ন ভিন্ন গাছে হয় যেমন তাল, খেজুর, পেষ্টে ক্ষেত্রে বাগানে একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে স্ত্রী ও পুরুষ গাছ লাগিয়ে ফল না অসা ও সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে । অনেক সময় কৃত্রিম উপায়ে পরাগায়ণ ঘটিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যায় । যেমন- পেঁপে গাছে কৃত্রিম উপায়ে পরাগায়ন ঘটিয়ে ফল ধারণ করানো যায় ।
২। অনেকগুলো গাছ একসাথে জনাননা (Growing mummerous plants): ফুলের মধ্যে অসমতা থাকলে বিভিন্ন ধরনের ফুলসমৃদ্ধ গাছ বাগানে জন্মাতে হয় ।
৩। পরাগরেণু সরবরাহকারী গাছ লাগানো (Use of polinizer plants): একই জাতীয় গাছের মধ্যে স্বপরাগায়নে অসুবিধা হলে সেখানে ভিন্ন ভিন্ন জাতের গাছ লাগানো উচিত। স্বপরাগায়নে সুবিধার জন্য রেণু সরবরাহ করতে পারে এমন গাছের কলম করে দেয়া যেতে পারে।
৪। সুষম সার (Use of balance fertilizer): গাছের খাদ্য ও পুষ্টি যাগোন স্বাভাবিক রাখার জন্য নাইট্রোজেন, ফসরাস, পটাশ, ক্যালসিয়াম, জিংক, বারেন ইত্যাদি সার সুষম মাত্রায় ব্যবহার করা উচিত।
৫। কার্বোহাইড্রেট ও নাইট্রোজেন উপযুক্ত অনুপাতে থাকা (Preserving correct CN Ratio): গাছে কার্বোহাইড্রেট গুনাইট্রোজেন সঠিক অনুপাতে থাকলে ফল বেশি ধরে । শিকড় হেঁটে বাকলা কেটে, ফল পাতলা করে, ধুয়া প্রয়োগে সার ও সেচ দিয়ে এবং পরিচর্যার মাধ্যমে এই অনুপাত সঠিক মাত্রায় আনা যায় ।
৬। শিকড় ঘেঁটে দেয়া (Root pruning): বাগানে মাটি চাষ করে, গাছের গোড়া হতে কিছুদূর দিয়ে নালা কেটে বা চারদিকে ভাবে নালা কেটে শিকড় কমানো যায় । গাছে ফুল হওয়ার এক থেকে দুই মাস আগে মাটি শুকনা থাকা অবস্থায় বিভিন্নভাবে শিকড় ছোট দেয়া হয় । তবে এক থেকে দুই সপ্তাহ মাটি আলগা রেখে তারপর প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার মিশিয়ে শিকড় ঢেকে দিতে হয়। এর ফলে গাছে অতিরিক্ত নাইট্রোজেনের পরিমাণ কমে যায় এবং পাতায় খাবার তৈরি হয়ে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেড়ে যায় । পরবর্তী ফল ধরার জন্য যা সহায়ক হয় ।
৭। চক্রাকার বাকল কেটে দেয়া (Ringing): গাছের প্রধান শাখাসমূহে বা কাণ্ডের গোড়ায় চক্রাকারে বাকল কেটে তুলে দেয়া হয় । এতে নাইট্রোজেন গ্রহণ ও বিভিন্ন অংশে কার্বোহাইড্রেট প্রেরণ ব্যাহত হয় । সাধারণত ৬ থেকে ১০ মাস বয়সের ডালে চক্রাকারে ২.৫ সে:মি: চওড়া করে বাকল তুলে ফেলে দেওয়া হয় । তবে বাকল চক্রাকারে কাটার সময় ১.২৫ সে:মি: এর বেশি চওড়া না হওয়াই উচিত । আর যে কাণ্ডে করা হবে তা গাছ বিশিষে ১০ সে:মি: এর কম ২৩ সে:মি: বেশি ব্যাস বিশিষ্ট না হওয়াই উচিত । এতে নাইট্রোজেন গ্রহণ ও তৈরি কার্বোহাইড্রেট গাছের বিভিন্ন অংশে প্রেরণ বাধাগ্রস্ত হয় ।
৮। ফল পাতলাকরণ (Fruit thining): কিছু কিছু ফল ছিড়ে পাতলা করে দিলে গাছে কার্বোহাইড্ৰেট জমা হতে থাকে । তাতে পরবর্তী বছর ফল ধারণে সহায়ক হতে পারে । এছাড়া ফল ছিড়ে পাতলা করার পরে গাছের অবশিষ্ট ফল বড় হতে পারে এবং ফলের গুণাগুণ বৃদ্ধি হতে পারে ।
৯। ধুয়া প্রয়োগ করা: গাছের নিচে খড়কুটা পুড়িয়ে চুঙ্গির সাহায্যে গাছের কেন্দ্রীয় এলাকার ভেতর দিয়ে ধুয়ার প্রবাহ যেতে দিতে হয় । এর ফলে কার্বোহাইড্রেট ও নাইট্রোজেনের অনুপাত তাড়াতাড়ি সঠিক মাত্রায় আসে, যা ফল ধারণের কাজ ত্বরান্বিত করে ।
১০। ডালপালা ও পাতাছাটাই করা: কোন কোন সময় গাছের খুব বেশি বাড়তি হলে শাখা প্রশাখা হেঁটে দিতে হয় । এতে গাছে ফুল ও ফল ধারণে সহায়ক হয় ।
ছক- কয়েকটি ফলের ছাঁটাই সময় ও ছাঁটাইয়ের বৈশিষ্ট্য
১১। হরমোন প্রয়োগ (Hormone application): গাছে হরমােেনর অসাম্যতার জন্য ফুল - ফল ঝরে পড়ে । বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের হরমোন অত্যন্ত কম মাত্রায় গাছে প্রয়োগে ফুল ধারণ ত্বরান্বিত করে, ফল ঝরা রোধ করে এবং অনেক ক্ষেত্রে ফলের আকৃতি বৃদ্ধি করে । নিচে কয়েকটি হরমোনের উদাহরণ দেওয়া হলো :
(i) NAA এর হালকা দ্রবণ ছিটিয়ে আনারসের ফলন বাড়ানো যায় ।
(ii) এলাচী ও কাগজীলেবুতে ১০-১৫ পিপিএম প্রয়োগ করে ফল ঝরা কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানো যায় ।
(iii) Planofox দ্বারা সিঞ্চন করে বিভিন্ন ফল ঝরা রোধ করে ফলের আকার বৃদ্ধি করে ফলন বাড়ানো যায় ।
১২। শাখা নোয়ানো (Bending of branches): গাছের ডাল টেনে নোয়ায়ে রাখলে নোয়ানো শাখায় বহুপ্রশাখা জন্মায় । লেবু গাছের ডাল টেনে মাটিতে শোয়ায়ে মাটি চাপ দিলেও বহুশাখা প্রশাখা জন্মে । এই শাখা প্রশাখা বাড়ার ফলে বেশি করে ফল ধরে ।
১৩। ভাল জাত ও ফলধারী গাছ রোপণ: যে সব জাতের গাছে বেশি করে ফল ধরে এবং ফলের গুণাগুণ ভাল সে সব জাতের গাছ রোপণ করা উচিত ।
১৪। রোগ ও পোকামাকড় দমন: রোগও পোকার আক্রমণ হলে তাড়াতাড়ি দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে । আম গাছের হপার, লিচুর মাইট ও নারিকেলের লাল পিপড়ার আক্রমণ ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস দ্বারা গাছ আক্রান্ত হলে বিশেষভাবে ফলন কমায় । এমনকি এগুলোর আক্রমণে গাছের সম্পূর্ণ ফুল ও ফল নষ্ট হতে পারে ।
বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক অনুরূপভাবে ফুল ও ফলের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে ।
অতি সংক্ষিত প্রশ্ন
১ । ফল গাছে ফল না ধরার কারণের ২টি শ্রেণি কী কী ?
২। কার্বোহাইড্রেট এবং নাইট্রোজেনের অনুপাতে অসামঞ্জস্য থাকলে তাকে কি ধরনের কারণ বলে?
৩ । ফল না ধরার বাহ্যিক কারণগুলোর তিনটি উদাহরণ দাও ।
৪ । কোন কোন ফল গাছে ভারী ছাটাই দিতে হয় ?
৫ । আনারস এবং লেবু গাছে ফলন বাড়ানোর জন্য কি হরমোন ব্যবহার করা হয় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১ । অফলন্ত বা অফলাৎেপাদক গাছ বলতে কী বোঝায় ?
২। গাছে উপযুক্ত বয়সে ফল ধরার পরও কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে ?
৩ । সময়মত গাছ ফলবতী না হওয়া বা ফল না ধরার কারণগুলো কী কী ?
৪ । অফলন্ত ও ফলন্ত গাছ কাকে বলে ?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। অফলন্ত গাছকে ফলবতী করার পদ্ধতিসমূহ আলোচনা কর ।
২ । সময়মত গাছে ফল না আসার বা ফল না ধরার কারণগুলো ব্যাখ্যা কর ।
৩ । অফলন্ত ও ফলন্ত গাছ কাজে বলে? গাছ অফলন্ত হওয়ার কারণসমূহ তালিকা বধকর এবং অফলন্ত হওয়ার প্রধান প্রধান কারণ বর্ণনা কর ।
প্রাসঙ্গিক তথ্য
বাংলাদেশে উৎপাদিত ফলের তালিকা তৈরি করতে হবে। ফলের সহজলভ্যতা এবং ব্যবহারের ভিত্তিতে ফলকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যাবে। পুষ্টি উপাদানের তালিকা মোতাবেক কোন ফলে কি পরিমাণ উপাদান পাওয়া যাবে তা নিরূপণ করা যাবে।
উপকরণ
১) বিভিন্ন প্রকার ফল
২) বিভিন্ন প্রকার ফলের পুষ্টি উপাদানের তালিকা
৩) ফল রাখার পাত্র এবং টেবিল
৪) ফল কাটার জন্য আরোলা চাকু, কাটা চামচ, চিনামাটি বা কাচের পাত্র
৫) কাগজ, কলম, স্কেল বা স্লাইড ক্যালিপার, নিক্তি, হ্যান্ড গাভস (হাত মোজা)
৬) পানি
কাজের ধাপ
১) সংগ্রহকৃত ফলগুলোর তালিকা তৈরি করতে হবে ।
২) ফলের ওজন, আকার, আকৃতি ও রং ভালোভাবে দেখে পৃথক পৃথক ভাবে
৩) ফলের ত্বকের মসৃণতা, পাকা বা কাঁচা লক্ষ করে তা লিখতে হবে ।
৪) ফল একটা একটা করে কাটতে হবে ।
৫) ফলের ভিতরে আহার উপযোগী অংশের ওজন নিতে হবে ।
৬) ফলের কাটা অংশ চামচ দ্বারা নিয়ে টক বা মিষ্টতা পরীক্ষা করতে হবে ।
৭) একটি একটি করে ফল কেটে ৫ নং ক্রমিকে বর্ণিত বিষয়গুলো খাতায় চার্ট আকারে লিখতে হবে।
৮) আহার উপযোগী অংশের পরিমাণ দেখে একটি ফলে কি পরিমাণ উপাদান থাকতে পারে তা নির্ণয় করতে হবে ।
ফল | ফলের স্বাদ | ফলের রং | ফলের ওজন (গ্রাম) | ওজন (গ্রাম) | শতকরা হার |
বিভিন্ন ফলের পুষ্টি মানের চার্ট তৈরিকরণ ও বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের পরিমানের চার্ট তৈরী ।
ফল চাষের সমস্যাবলি ও সমাধানের তালিকা প্রস্তুতকরণ
প্রাসঙ্গিক তথ্য
অঞ্চল বিশেষে কী কী ফল উৎপন্ন হয় তা জানতে হবে । ফলের উৎপাদন ও ফলনের তথ্য সংগ্রহ করতে হবে । কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থা, ফলের চাহিদা ও বাজার ব্যবস্থা, নার্সারী, ফল সংরক্ষণের সুবিধা ইত্যাদি বিষয়ে জরীপ করতে হবে । কৃষকদের আগ্রহ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, খাদ্যাভ্যাস, পরিবহন ব্যবস্থা ইত্যাদি মৌলিক বিষয়সমূহ জানতে হবে ।
উপকরণ
(১) ফল চাষের জন্য তথ্যাভিত্তিক চার্ট (চাষকৃত জমির পরিমাণ, ফলন, জমির প্রাপ্যতা ইত্যাদি)
(২) অঞ্চল ভিত্তিক বৃষ্টিপাত, মাটির কধুরতা ও মৃত্তিকা জরিপ ম্যাপ
(৩) কাগজ, কলম, বার্ডে, চক, ডাষ্টার
(৪) মাটি পরীক্ষার যন্ত্র, ঔষধ প্রয়োগ যন্ত্র, প্যাকিং সামগ্রী
(৫) উন্নত জাতের চারা, বাগান পরিচর্যার যন্ত্রপাতি, বই ইত্যাদি ।
কাজের ধাপ
(১) ফল চাষের সমস্যাগুলোর সার্বিক তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। এ জন্য ছক তৈরি করে জরীপ করতে হবে।
(২) ফল চাষে আর্থসামাজিক সমস্যার তালিকাগুলো পৃথকভাবে প্রণয়ন করতে হবে ।
(৩) ফল চাষে কারিগরি সমস্যাগুলো পৃথকভাবে প্রণয়ন করতে হবে ।
(৪) সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য সুপারিশ করা যেতে পারে ।
ক) আর্থসামাজিক সমস্যাগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১) জমির স্বল্পতা
২) উন্নত বীজ বা চারা কলমের অভাব ।
৩) সার, সেচযন্ত্রপাতির মূল্য বেশি ও দুষপ্রাপ্যতা
৪) কীটনাশক ঔষধ ও প্রয়োগ যন্ত্রপাতির দুষ্প্রাপ্যতা
৫) কৃষকের দারিদ্রতা ও ঋণগ্রস্থতা,
৬) আর্থিক ঝুঁকির আশঙ্কা
৭) গতানুগতিক প্রথায় চাষাবাদ করা
৮) বাজারজাতকরণ সুযোগের অভাব
৯) ফসল বীমার প্রচলন না থাকা
১০) ফলের বাজার মূল্যের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ।
(খ) কারিগরি সমস্যাগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো ।
১) কৃষকের ফল চাষের বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাব
২) মাটি ও আবহাওয়ার প্রকৃত তথ্য স্বল্পতা এবং
৩) প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কিত পূর্বাভাস সময়মত প্রচারের ব্যবস্থা না থাকা
৪) ফল সংরক্ষণের জন্য হিমাগার ও পরিবহনে হিমায়িত গাড়ীর অভাব,
৫) ফল সংগ্রহ কৌশল, গ্রেডিং ও প্যাকিং পদ্ধতি সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব ।
ফল চাষের সমস্যাগুলোর সম্ভাব্য সমাধান নিম্নোক্ত ভাবে করা যায়:
(১) সমবায় ব্যবস্থা চালু করা
(২) নতুন কৌশল উদ্ভাবন ও দেশ বিদেশ হতে উন্নত প্রযুক্তি সংগ্রহ
(৩) সকলের জন্য কৃষি শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা করণ
(৪) ঋণ সহজীকরণ ও বীমার ব্যবস্থা চালু করা ।
(৫) সার, বীজ, ঔষধ ও সেচ যন্ত্র সরবরাহ সহজ লভ্য ও নিশ্চিত করা
(৬) হিমাগার ও শিল্পকারখানা স্থাপন করা
(৭) প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস প্রদান ও আবহাওয়া পঞ্জিকা প্রণয়ন
(৮) বাজার ব্যবস্থা ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন
৯) ভাল কৃষকদেরকে উৎসাহ প্রদানের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করা
(১০) শিক্ষিত যুবকদের বিভিন্নভাবে সুবিধা প্রদান
(১১) বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক পদার্থের (সার, হরমোন) মূল্য কম করা ।
বিজ্ঞানসম্মত ফল বাগান স্থাপন করতে হলে বাগানে গাছ লাগানোর জন্য নকশা তৈরি করা অবশ্যই প্রয়োজন । বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফল বাগানের নকশা বা পরিকল্পনা করা হয়। এ পদ্ধতিগুলো হলো:- ১। আয়তকার পদ্ধতি ২ । বর্গাকার পদ্ধতি ৩ । ত্রিভুজাকার পদতি ৪ । ষড়ভুজী পদ্ধতি ৫। কুইনকাংশ পদ্ধতি ৬ । সমচাল পদ্ধতি এবং সিড়ি পদ্ধতি ।
ফল গাছ চাষের জন্য নকসা তৈরি ও গাছের সংখ্যা নির্ণয় ।
বর্গাকার পদ্ধতিতে গাছ লাগানোর নকশা ও গাছের সংখ্যা নির্ণয় ।
প্রাসঙ্গিক তথ্য
জমি সমতল কিনা তা প্রথমে জানতে হবে । কেননা পাহাড়ী জমিতে বর্গাকার, আয়তকার, ত্রিভুজাকৃতি বা ষড়ভুজী পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় । এছাড়া জমি সমতল অথচ জমির আইল আঁকাবাকা বা অসমান, সেক্ষেত্রে জমির ম্যাপ দেখে কাগজে প্রথমে নকশা করে নিতে হবে। জমির আইল আঁকাবাকা বা জমি অনিয়মিত আকারের হলে সে ক্ষেত্রে অনেক সময় গাছ হতে গাছের দূরত্ব পরিবর্তন করা প্রয়োজন হতে পারে ।
উপকরণ
(১) সাদা কাগজ
(২) পেনসিল, রাবার
(৩) ত্রিকোণী (সেট ও মিটার স্কেল)
(৪) শক্ত খুঁটি বা কাঠি
(৫) মাপার ফিতা, রশি বা সূতলী
(৬) ফল গাছ রোপনের জন্য চিহ্নিত স্থানে স্থাপনের জন্য চিকন কাঠি ।
কাজের ধাপ
(১) জমির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের মাপ নিতে হবে ।
(২) এরপর কাগজে জমির নকশা মোতাবেক মাপ লিপিবদ্ধ করতে হবে ।
(৩) কাগজে জমির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ মোতাবেক লাইন টানতে হবে। এভাবে দুই দিকে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ লাইন টানলে একটি আরেকটির উপর লম্ব তৈরি হবে। এভাবে জমির নকশা অনুযায়ী কাগজে জমির চারদিকের বাউন্ডারী বা সীমানা লাইন টানতে হবে।
(৪) এরপর বাউন্ডারী রেখা জমির ভিতর দিকে সারি হতে সারির দূরত্বের অর্ধেক দূরত্ব বাদ দিয়ে গাছ লাগানোর রেখা (মূল রেখা ও মুক্ত রেখা টানতে হবে ।
(৫) এভাবে মুলরেখা টানার পর ঐ রেখার একপ্রান্ত হতে গাছ হতে গাছের যে দূরত্ব হবে তার দূরত্বের অর্ধেক দূরত্ব বাদ দিয়ে প্রথম গাছ লাগানোর চিহ্ন দিতে হবে। এরপর গাছ হতে গাছের যে দূরত্ব হবে তা পর পর চিহ্নিত করতে হবে
(৬) মূল রেখা টানার পর এর সমান্তরাল করে সারি হতে সারির দূরত্ব চিহ্নিত করে লাইন টানতে হবে ।
(৭) জমির কিনারা হতে মূলরেখা (সারি হতে সারির দূরত্বের অর্ধেক দূরত্ব বাদ দিয়ে) টানার পর ঐ সারিতে গাছ হতে গাছের দূরত্ব নিয়ম মোতাবেক চিহ্নিত করতে হবে । এ সকল চিহ্ন হতে লম্ব টানা হলে (মুক্ত রেখার অন্যান্য সমান্তরাল রেখার ওপর যেখানে অতিক্রম করবে সেখানে চিহ্ন দিতে হবে ।
(৮) মূল রেখার সমান্তরাল রেখার ওপর লম্বাভাবে অতিক্রম করা স্থানগুলো চিহ্নিত করে যাগে করলে এক একটি বর্গক্ষেত্র তৈরি হবে ।
(৯) এভাবে কাগজের নকশা অনুযায়ী জমির সীমনা হতে একদিকে গাছ লাগানোর জন্য সরল লাইন তৈরি করতে হবে । এই লাইনের সাথে অন্য লাইনের লম্ব তৈরির জন্য রশি নিয়ে ৩:৪:৫ অনুপাতে চিহ্নিত করতে হবে । এরপর দুইদিকে রশির লাইন প্রসারিতি করলে একটি ৯০° কোণ তৈরি হবে । এই প্রসারিত লাইন জমির শেষ পর্যন্ত নিতে হবে । এখন দুইদিকের প্রসারিত লাইনে (গাছ হতে গাছ এবং সারি হতে সারি) গাছ লাগানোর দূরত্বে প্যানটিং বোর্ড বা খুঁটি পুতে চারা রোপনের স্থানগুলো চিহ্নিত করা যাবে ।
(১০) রশির দুইদিকের লাইনের প্রতিটি চিহ্ন হতে পরস্পর লম্ব রেখা বরাবর রশি নিয়ে জমির অপর প্রান্ত পর্যন্ত যেতে হবে ।
(১১) এভাবে উভয়দিকের পরস্পর লাইনের উপর হতে নেয়া রশির সংযুক্তি স্থানগুলোতে কাঠি পুতে চিহ্নিত করতে হবে । এই চিহ্নিত স্থানগুলো গ্রাফ পেপারে অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের মত দেখাবে ।
(১২) এভাবে সারা জমিতে বর্গাকার পদ্ধতিতে মাঠে গাছ লাগানোরে স্থান চিহ্নিত করা যাবে ।
ক) বর্গাকার পদ্ধতিতে জমিতে গাছের সংখ্যা নির্ণয়
এ পদ্ধতিতে গাছ হতে গাছ এবং সারি হতে সারির দূরত্ব সমান থাকবে । কোন নির্দিষ্ট জমিতে গাছের সংখ্যা নির্ণয় পদ্ধতি (বর্গাকার বা আয়তকার পদ্ধতিতে গাছ লাগানোর জন্য কেবল প্রযোজ্য): -
প্রতি হেক্টরে গাছের সংখ্যা = এক হেক্টর জমি (১০,০০০ বর্গ মিটার) । লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ।
উদাহরণ: আম গাছ রোপণের দূরত্ব ও সারি থেকে সারি ১০ মিটার এবং গাছ থেকে গাছ ১০ মিটার । তাহলে এক হেক্টরে কয়টি চারা লাগানো যাবে তা নির্ণয় কর।
আম গাছের সংখ্যা = ১০,০০০ বর্গ মিটার । ১০ মিটার ×১০ মিটার = ১০০ টি
অর্থাৎ বর্গাকার পদ্ধতিতে এ হেক্টর জমিতে প্রতি হেক্টর ১০০ টি আমের চারা লাগানো যাবে।
উদাহরণ: কাঁঠাল গাছ রোপনের দূরত্ব ও সারি হতে সারি ১৫ মি. এবং গাছ হতে গাছ ১৫ মিটার তাহলে এক হেক্টর জমিতে কয়টি কাঁঠাল গাছ লাগানোর যাবে নির্ণয় কর।
হেক্টর প্রতি গাছের সংখ্যা = ১০,০০০ বর্গ মিটার বা ১৫ মিটার×১৫ মিটার =88
অর্থাৎ বর্গাকার পদ্ধতিতে এক হেক্টর জমিতে ৪৪ টি (প্রায়) কাঁঠাল গাছ লাগানো যাবে ।
খ) আয়তক্ষেত্রে পদ্ধতিতে গাছ লাগানোর নকসা ও গাছের সংখ্যা নির্ণয়:
এ পদ্ধতি বর্গাকার পদ্ধতির মতই। কেবল পাশাপাশি গাছ হতে গাছের দূরত্বের সাথে সারি বা সারির গাছের দূরত্বের প্রভেদ থাকবে । আয়তকার পদ্ধতিতেও একদিকের লাইনে গাছের দূরত্বের চিহ্ন এবং অপরদিকে সারির দূরত্বের চিহ্ন দিতে হয়। উভয় দিকের প্রসারিত লাইনের সংযুক্তি স্থানে কাঠি পুঁতে গাছ লাগানোর স্থান চিহ্নিত করা হয় ।
উদাহরণ: কাঁঠাল বাগানে গাছ রোপনের দূরত্ব সারি থেকে সারি ১০ মিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৮ মিটার । তাহান্সে এক হেক্টর জমিতে কয়টি চারা লাগানো যাবে তা নির্ণয় কর ।
প্রতি হেক্টর জমিতে গাছের সংখ্যা = এক হেক্টর (১০,০০০ বর্গ মিটার) । সারি থেকে সারির দূরত্ব গাছ থেকে । গাছের দূরত্ব = ১০,০০০ মিটার । ১০ মিটার ×৮ মিটার = ১২৫
অর্থাৎ প্রতি হেক্টরে ১২৫ টি কাঁঠাল চারা লাগানো যাবে ।
গ) ত্রিভুজ পদ্ধতিতে গাছ লাগানোর নকশা তৈরি ও গাছের সংখ্যা নির্ণয়
প্রাসঙ্গিক তথ্য: এ পদ্ধতিতেও মুক্ত রেখা ও মুক্ত রেখার সমান্তরাল রেখা এবং মুক্ত রেখার উপর লম্ব রেখা টানতে হবে । (বর্গাকার পদ্ধতির অনুরূপ)
উপকরণ
কাজের ধাপ
(১) প্রথমে বর্গাকার পদ্ধতির ন্যায় ১ থেকে ৫নং পর্যন্ত একই কাজ করতে হবে।
(২) উভয় দিকের লাইন টেনে মুক্ত রেখায় গাছ হতে গাছের নির্ধারিত দূরত্বে (মাপ মোতাবেক) চিহ্ন দিতে হবে (প্রথম সারিতে বর্গাকার পদ্ধতির ন্যায় গাছ লাগানোর স্থানে চিহ্ন দিতে হবে)।
(৩) সারি সংখ্যা বেজোড় হলে প্রতিটি বেজোড় সারিতে অর্থাৎ মুক্ত রেখা বা প্রথম সারির ন্যায় বেজোড় সারিগুলোতে চিহ্ন দিতে হবে।
(৪) সারি সংখ্যা জোড় হলে প্রথম সারির দুই গাছের জন্য চিহ্নিত স্থানের মাঝ বরাবর প্রতিটি জোড় সারিতে মূল গাছের জন্য স্থান চিহ্নিত করতে হবে ।
(৫) প্রথম সারিতে দুটি চিহ্নিত স্থানের সাথে পরবর্তীতে জোড় সারিতে মাঝ বরাবর বা বর্গকার পদ্ধতির ন্যায় চিহ্নিত স্থান ধরে মাঝখানে যাগে হবে। এতে ৩টি গাছ মিলে একটি ত্রিভুজ সৃষ্টি করবে। তবে জোড় সারির এক প্রান্ত হতে গাছের জন্য প্রথম চিহ্নিত স্থানটি গাছ হতে গাছের দূরত্বের পূর্ণ দূরত্বে চিহ্ন হবে ।
(৬) নকশা অনুযায়ী বর্গাকার পদ্ধতির ন্যায় জমিতে সীমানা ও গাছ লাগানোর লাইন তৈরি করতে হবে। প্রথম সারির এক প্রাতে গাছ হতে গাছের রোপিত দূরত্বের অর্ধেক বাদ দিয়ে প্রথম চিহ্ন দিতে হবে। একই নিয়মে বেজোড় সারিতে চিহ্নিত করতে হবে। এতে সমস্ত বেজোড় সারিগুলোতে প্রথম সারির সাথে সমান্তরাল (লম্বভাবে টানা রেখার) সারিতে একই লাইন চিহ্নিত হবে । আর জোড় সারিগুলোতে প্রথম সারির দুগাছের মাঝ বরাবর চিহ্নিত হবে। জোড় সারিগুলো একাত্তর সারি হিসেবে গণ্য হবে এবং এতে একটি করে গাছ কম হবে।
গাছের সংখ্যা নির্ণয়
ত্রিভুজ পদ্ধতিতে জমিতে গাছের সংখ্যা নির্ণয় = (প্রথম সারিতে গাছের সংখ্যা মোট সারির সংখ্যা)- একান্তর ক্রমিক সারির সংখ্যা ।
উদাহরণ: কোন জমির দৈর্ঘ্য ২০ মিটার এবং প্রস্থ ১৫মিটার। যদি ঐ জমিতে ৪ মিটার দূরে দূরে লাইন এবং ৩ মিটার দূরে দূরে গাছ লাগানো হয় তবে ঐ জমিতে মোট কতটি গাছ লাগানো যাবে ।
মোট লাইন সংখ্যা = জমির দৈর্ঘ্য: লাইনের দূরত্ব = ২০ মিটার ৪ মিটার = ৫টি। প্রথম লাইনে গাছের সংখ্যা = জমির প্রস্থ : গাছের দূরত্ব = ১৫ মি: ৩ মিঃ = ৫টি সুতরাং গাছের সংখ্যা = (৫×৫) - ( ৫-১-২) = ২৫-২ = ২৩টি অর্থাৎ মোট ২৩টি গাছ লাগানো যাবে ।
উদাহরণ: কোন নির্দিষ্ট জমিতে ১২মিটার দৈর্ঘ্যের ৭টি লাইন করা গেলে এবং প্রতিটি লাইনে ৪ মিটার দূরত্বে গাছ । লাগানো হলে ঐ জমিতে মোট কতটি গাছ লাগানো যাবে ।
গাছের সংখ্যা = (১২৪×৭) - (৭-১২) একান্তর ক্রমিক সারির সংখ্যা
= মোট সারির সংখ্যা-১:২
= (৩×৭)-৩=২১-৩= ১৮টি
অর্থাৎ মোট ১৮টি গাছ লাগানো যাবে ।
প্রাসঙ্গিক তথ্য
গাছের ফল ধারণের উপযুক্ত বয়স হয়েছে কিনা এবং গাছের পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি আছে কি না তা জানতে হবে। এমনকি গাছে পাকামাকড়ের আক্রমণ আছে কি না তাও জানতে হবে। এমনিভাবে মাটিতে রসের ঘাটতি, পরাগায়নের সমস্যা, তাপমাত্রা ইত্যাদি বিষয়ের তথ্য সগ্রহ করতে হবে ।
উপকরণ
(১) বিভিন্ন প্রজাতির ফলের গাছ ।
(২) বিভিন্ন ধরনের তথ্য (গাছের বয়স, মাটিতে রসের অবস্থা, পরাগায়ণের সুযোগ, তাপমাত্রা, মাটিতে পুষ্টি উপাদান ইত্যাদি)
(৩) প্রুনিং করাত, দা, প্রুনিং কঁচি বা সিকেচার
(৪) কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক
(৫) হরমোন
(৬) ঔষধ প্রয়োগের জন্য সিঞ্চনযত্র ইত্যাদি ।
কাজের ধাপ
(১) অফলবতী হওয়ার অভ্যন্তররীণ ও বাহ্যিক কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে ।
(২) ফুলের মধ্যে অসংগতি আছে কিনা তা দেখতে হবে। যেমন পুংকেশর বড়, গর্ভদন্ড খুব ছোট, আবার গর্ভদন্ড বড়, পুংকেশর ছোট, ফুল একলিঙ্গ, পুংকেশর আগেই বের হয়ে পূর্ণতা লাভ করে, পুংকেশরে পরাগরেণু খুব কম ইত্যাদি ।
(৩) ফুল ও ফল হওয়ার সময় বাধা সৃষ্টি করে এমন বাহ্যিক কারণগুলো দেখতে হবে । যেমন-শুষ্ক আবহাওয়া, প্রচন্ড তাপ, বাতাসের ঝড়ো গতি, গাছের অবস্থান খুব উঁচুতে বা নিচুতে, গাছের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, গাছে অতিরিক্ত ডালপালা গজানো, কীট ও রোগের আক্রমণ, অসময়ে এবং মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রে করা, ফুল হওয়ার পর বৃষ্টিপাত হওয়া ইত্যাদি ।
(৪) ফুল আসার আগে গাছের স্বাভাবিক বৃদি বজায় রাখার জন্য উপযুক্ত মাত্রায় সারের উপরি প্রয়োগ করতে হবে । সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হবে।
(৫) বংশগত কারণে অফলবতী হলে সে গাছ বাদ দিয়ে স্থায়ীভাবে অধিক ফলনশীল ভালজাতের গাছ লাগাতে হবে।
(৬) পরাগায়ণের সুবিধার জন্য মৌমাছি পালন ও হাতের সাহায্য পরাগায়ণ করতে হবে ।
(৭) উপরে ২নং ক্রমিকের বর্ণিত সমস্যা সমাধানের জন্য বিপরীত লিঙ্গের ও অনেকগুলো গাছ একত্রে লাগানো যেতে পারে।
(৮) গাছের দৈহিক বৃদ্ধি বেশি হলে জমি চাষ করে যা অন্য উপায়ে মূল ছাটাই করতে হবে। গাছের প্রধান শাখা বা কাণ্ডের গোড়ায় রিং আকারে বাকল কাটতে হবে। এই বাকল গাছ বিশেষে ১০ সে: মি: থেকে ১২ সেঃ মিঃ এর বেশি ব্যাসবিশিষ্ট কাটা যাবে না ।
(৯) গাছে ফলের সংখ্যা খুব বেশি হলে ফল পাতলা করে দিতে হবে ।
(১০) চিরসবুজ গাছের বেলায় ফল পাড়ার পর ছোট ছোট ও রোগাক্রান্ত শাখা প্রশাখা ছাটাই করে দিতে হবে । এছাড়াও কোন কোন বিশেষ শাখা বৃদ্ধির জন্য অন্য শাখা প্রশাখা কেটে দিতে হবে। লিচু, পেয়ারা, কুল, জাম, জামরুল, কাঁঠাল ইত্যাদি ফল গাছে প্রজাতি ভেদে ভাল ফলনের জন্য কম বা বেশি অঙ্গ ছাঁটাই করতে হবে।
(১১) পানো ফিকস প্যাটেন্ট হরমোন, ২-৪ ডি হরমোন সাধারণত প্রতি দশলক্ষ ভাগ পানিতে ১ থেকে ২০০ ভাগ হরমোন মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
প্রাসঙ্গিক তথ্য
ফল বাগানের যথোপযুক্ত যত্নের উপর গাছের ফল ধরা, ফলের আকার বড় হওয়া ইত্যাদি বিষয় অনেকাংশে নির্ভর করে। আবার ফলের সংগ্রহ পদ্ধতির ওপর ফলের গুণাগুণ ও ফল সংরক্ষণ সময়কাল নির্ভর করে। সঠিক সময়ে ও সঠিক পদ্ধতিতে ফল সংগ্রহ করা না হলে ফলের বিক্রয়মূল্য কমে যায় এবং ফল বেশি সময় ধরে সংরক্ষণ করা যায় না ।
ফল সংগ্রহ:
ফল পাকা অবস্থা পর্যন্ত গাছে রেখে সংগ্রহ করলে ফল সর্বোৎকৃষ্ট অবস্থায় পৌঁছে। এতে রং ও আকৃতি ভাল হয় এবং স্বাদ পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায়। তবে ফল কীভাবে ব্যবহার করা হবে, কতদূরে পাঠানো হবে, কতদিন রাখা হবে, রোগ, পোকামাকড়ের আক্রমণ, নিরাপত্তা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ফল সংগ্রহের সময় নির্ধারণ করতে হয় । গাছের আকার, ফলের বোটা শক্ত বা নরম, বাজারের চাহিদা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ফল সংগ্রহের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় ।
ফল সংগ্রহ পদ্ধতি: সতেজ ফল সাধারণত দু'ভাবে ভালো হয় । তবে অনেক সময় সাধারণ পদ্ধতি (নিচের ক ও খ) অপেক্ষা অন্য পদ্ধতিতেও ফল সংগ্রহ করা যায় । যথা
(ক) হাত দিয়ে তোলা/পাড়া
(খ) মেশিনের সাহায্যে তোলা / পাড়া
(গ) পশুর সাহায্যে তোলা / পাড়া
ফল সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ
১. ঝুড়ি (বাঁশের বা কাঠের)
২. চাকু, কাঁচি,
৩. সাকশন ক্যাপ
৪. লম্বা বা ছোট হাতাওয়ালা লাঠির মাথায় বাঁধা থলে,
৫. মই (সাধারণ বা ফোল্ডার)
৬. চটের বা রশির জালির দোলনা,
৭. পলিথিন, ক্যানভাস বা চটের ব্যাগ
৮. রশি বা দড়ি
ফল ব্যবহারের উদ্দেশের ওপর নির্ভর করে ফল সংগ্রহ পদ্ধতি অনুশীলন করা হয় । যেমন-পাকা খাওয়া, জুস তৈরি, আচার বা চাটনি তৈরি, তরকারি খাওয়া বিদেশে রপ্তানি ইত্যাদি ।
ফল সংগ্রহের জন্য ফলের বাগানে বা গাছের নিকট যেতে হবে । তারপর গাছের ফল পাড়ার উপযুক্ত হয়েছে কি না তা দেখতে হবে । ফল পরিপুষ্ট হলে ফল গাছের উচ্চতা বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কিভাবে ফল সংগ্রহ করা যাবে ।
আম সংগ্রহঃ
(১) আম হাত দিয়ে বা লম্বা লাঠির মাথায় জালি/এলে বেঁধে পাড়তে হবে ।
(২) একজনে গাছ হতে আমের বোঁটা ছিড়ে দেবে। আর একজন নিচে বস্তা/খলে ধরে আমটিকে সরাসরি । মাটিতে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে মাটিতে গড়ায়ে দিবে।
(৩) গাছে উঠে চটের থলেতে আম ছিড়ে ভর্তি করে রশির সাহায্যে খলে ঝুলিয়ে নিচে নামিয়ে দিতে হবে।
(৪) গাছের পাশে মই দিয়ে দাঁড়ায়ে বা গাছে উঠে লম্বা লাঠির মাধার ছুরি বা কঁচি বাঁধা লাঠি দিয়ে বোটা কেটে দিতে হবে । আর ঠিক তার নিচে মশারি টানানারে মত রশির আলি রাখলে তাতে আম পড়বে এবং আঘাত কম পাবে।
পেঁপে সংগ্রহঃ
(১) গাছ ছোট হলে হাতের নাগালের মধ্যে থাকা অবস্থায় হাতে হ্যান্ড গোব পরে ফল পাড়তে হবে ।
(২) পাছ লম্বা হলে মই দিয়ে উপরে উঠে বা লম্বা হাতাওয়ালা সাকসান কাপ-এর সাহায্যে পাড়তে হবে ।
(৩) পেঁপে পাড়ার সময় যাতে ঘষা না লাগে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে ।
কলা সংগ্ৰহঃ
(১) কলা পরিপুষ্ট হলে কলার কাঁদি একমুখ খোলা পলিথিন ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে ।
(২) কলার কাদির মাথার দিক হতে পলিব্যাগ পরায়ে দিয়ে খোলামুখ কাদির গোড়ার দিকে বেঁধে দিতে হবে ।
(৩) এর পর কলার কাঁদি কাটার সময় গাছের নিকট দুজন যেতে হবে। একজন কঁদি কেটে দিবে এবং আর একজন নিচে দাঁড়ায়ে কাঁদি ধরবে ।
(৪) গাছ বড় হলে কলার কাদির নিচে হুক আকারে বাধা বাঁশ দিয়ে ঠেকা দিতে হবে। তারপর কঁদি যে দিক ঝুলে আছে তার বিপরীত দিকে গাছের কাণ্ডে মাটি হতে ১০০ থেকে ১৫০ সে.মি. উপরে গাছের ব্যাসের ৩ ভাগের ২ ভাগ পরিমাণ স্থান অর্ধবৃত্তাকারে কেটে দিতে হবে । এখন ঠেকা দেয়া বাঁশের গোড়া আস্তে আস্তে দূরে সরানো হলে কাদি নিচে নেমে আসবে । এভাবে কঁদি নাগালের মধ্যে এলে তা ধরে নামানো যাবে ।
কাঁঠাল সংগ্ৰহ
(১) গাছে উঠে বা নিচে থেকে ফলের বোটা গাছের কাণ্ড থেকে সামান্য রেখে কেটে নিতে হবে। ফল ছোট হলে এক হাতে বোঁটা ধরে অন্য হাতে চাকু বা কঁচি দিয়ে বোটা কাটা যাবে ।
(২) কাঁঠাল বড় হলে এবং উঁচুতে হলে বোটার সাথে রশি বেঁধে গাছের কাণ্ডে রশি পেঁচ দিয়ে ফলের ঝুলন্ত ভারের সমতা আনতে হবে । তারপর রশির একমাথা ধরে ফলের বোটা কেটে দিতে হবে। এরপর রশি আস্তে আস্তে ঢিলা দিলে কাঁঠাল নিচে নেমে যাবে।
(৩) ফল পাকা অবস্থা হলে থলের মধ্যে কাঁঠাল ভর্তি করে থলের মুখে রশি বেঁধে ২নং ক্রমিকে বর্ণিত নিয়মে ফল পাড়তে হবে ।
আনারস সংগ্রহ
(১) ছোট বাগান হলে ফলের বোটার নিচে কাণ্ড কেটে ঝুড়িতে সাজিয়ে আনা হয় ।
(২) বড় বাগান বা পাহাড়ি এলাকার বাগান হলে ফল তুলে বেল্টের ঝুড়িতে সাজানো হয় । যান্ত্রিক উপায়ে বা হাতের সাহায্যে বেল্ট ঘুরায়ে দূরে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠানো হয়
লিচু সংগ্ৰহ
(১) লাঠির মাথায় তুকসহ বাঁধা থলিতে লিচুর গাছো ঢুকায়ে টান দিলে কিছুটা কাণ্ডসহ ভেঙ্গে আসবে ।
(২) হাতের নাগালের মধ্যে হলে লিচুর গাছোসহ ধরে মাচেড় দিলে কিছুটা কাণ্ড সহ ভেঙ্গে আসবে ।
(৩) লম্বা লাঠির মাথায় আংটার মত করে লাহোর বা কাঠের টুকরা বেঁধে লিচুর গাছোসহ ডালে বাধায়ে টান দিলে ডালসহ ভেঙে আসবে । এ সময় আংটায় বাধানো ভাঙা ডালসহ লিচুর গাছো কাছাকাছি এনে ঝুড়িতে রাখতে হবে ।
নারিকেল সংগ্রহ
(১) নারিকেল ঝুনা হলে গাছে উঠে ছড়ার সাথে রশির একমাথা শক্ত করে বঁধতে হবে। রশির অপর মাথা গাছের মাথার সাথে পেঁচ দিয়ে ধরতে হবে। তারপর কাদি কেটে দিয়ে আস্তে আস্তে রশি ঢিলা করা হলে নিচে নেমে আসবে।
(২) নারিকেলের ছড়ার ভেতর দিয়ে প্যাঁচ দিয়ে রশির একমাথা গাছের মাথায় অর্থাৎ নারিকেলের ছড়ার উঁচুতে বঁধতে হবে । এরপর রশির অপর মাথা কমপক্ষে ৪৫ ডিগ্রী কোণ করে নিচে দূরে কোন খুঁটির সাথে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে । এরপর ছড়ার গোড়া কেটে দিলে রশি বরাবর ছড়া পড়ায়ে নিচে চলে আসবে।
প্রাসঙ্গিক তথ্য
ফল কি উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা হবে তার ওপর নির্ভর করে ফল বাছাই করা হয়। আবার, চাটনি, জ্যাম, জেলি তৈরি করা হলে ফল ছোট বড় বাছাই করার প্রয়োজন হয় না। প্যাকিং করে দূরে পাঠানোর জন্য বড় এবং ছোট ফল একসাথে প্যাকিং করা হলে বড় ফলের চাপে ছোট ফল নষ্ট হতে পারে। তাই বড় এবং ছোট ফল বাছাই করে আলাদা আলাদা করতে হয়।
উপকরণ
(১) ফল বাছাই টেবিল
(২) ফল গ্রেডিং করার জন্য প্রেডিং বিন
(৩) ফল রাখার ঝুড়ি বা বাক্স বা ট্রে
(৪) প্যাকিং কাগজ, হ্যাভগোব, পরিষ্কার ভাজা পাতা, খড় ইত্যাদি
(৫) ফ্যান, ঠান্ডা ঘর বা খোলামেলা ছায়াযুক্ত স্থান
কাজের ধাপ
(১) ফল সংগ্রহ করার পর কাটা, ফাটা বা থেতলানোগুলো আলাদা করতে হবে।
(২) রোগ ও পোকামাকড়ে আক্রান্ত ফলগুলো আলাদা করতে হবে ।
(৩) ছোট, মাঝারি ও বড় ফলগুলো আলাদা আলাদা করতে হবে। (এ কাজ হাতের সাহায্যে বা থ্রেডিং বিনের সাহায্যে করা যায়)।
(৪) কাঁচা ও পরিপক্ব ফল আলাদা করতে হবে।
দ্রুত পচনরোধে ব্যবহার্য প্রযুক্তি
(১) গ্রীষ্ণমন্ডলীয় ফুল প্রায় ১০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গুদামে কিছুদিন রাখা
(২) হিমায়িত গাড়িতে পরিবহন করা
(৩) নিয়ন্ত্রিত গুদামে বাইরের বাতাস ঢুকানো
(৪) গুদাম ঘরে কার্বনডাই অক্সাইডের মাত্রা বেশি হলে প্রতিটন ফলের জন্য ১৪ থেকে ১৫ কেজি চুন (লাইম) গুদামে রাখতে হবে ।
(৫) কলার মত ফল পলিথিন ব্যাগে ভর্তি করে বাইরে পাঠানো যায়।
(৬) গুদামে বা প্যাকিং বাক্সে ১ থেকে ৫% অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইড ব্যবহার করা হলে ফল পচনকারী জীবাণুর বংশ বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ।
(৭) ফলের পঁচন রোধের জন্য ফলের গায়ে মোমের আবরণ দেয়া হয় ।
(৮) ফলের পঁচন রোধে ফলের গায়ে সরিষার তেল দ্বারা প্রলেপ দেয়া হয় ।
প্রাসঙ্গিক তথ্য
দেশের ভেতরে বা বাইরে তাজা অবস্থায় ফল প্রেরণ করার মৌলিক কাজগুলো একই ধরনের। যেমন
(ক) স্থানীয় বা আঞ্চলিক বাজারের বা দেশের বাইরের চাহিদা মোতাবেক গাছ থেকে ফল তালোর বয়স নির্ধারণ
(খ) গাছ থেকে ফল তালোর পর মাঠে ছায়াযুক্ত ঠান্ডা স্থানে ফল জড়ো করা
(গ) বৃষ্টি বা খারাপ আবহাওয়ার সময় ফল না পাড়া
(ঘ) ফল সংগ্রহ করে রোদ ছড়ায়ে না রাখা
(ঙ) সমতল স্থানে মাদুর বা তাজা পাতা বিছায়ে গদির মত করে তার উপর ফল রাখা
(চ) ফল পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা ।
(ছ) কাটা, ফাটা, রোগ ও পোকামাকড়ে আক্রান্ত ফল আলাদা করা
(জ) ছোট, মাঝারী ও বড় ফল আলাদা করে পৃথক পৃথক ঝুড়িতে বা প্যাকেটে প্যাকিং করা
(ঝ) মাঠ হতে নির্দিষ্ট স্থানে (বাজার, আড়ৎ, স্টেশন, ট্রাক স্ট্যান্ড, ঘাট, বিমান বন্দর) পরিবহন করা ।
কাজের ধাপ
বাজারজাতকরণের পূর্বে স্থানের দূরত্ব, বাজারে ক্রেতার ধরন ও চাহিদার উপর নির্ভর করে ফলের গ্রেডিং ও প্যাকিং করতে হয় । গ্রেডিং ও প্যাকিং-এর উপর ফলের গুণগত মান অনেকাংশে নির্ভরশীল ।
বাজারজাতকরণের জন্য প্যাকিং
(১) নিরাপদ প্যাকিং করার জন্য ফল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে ।
(২) ফলের গ্রেড অনুসারে পৃথক পৃথক প্যাকেটে ফল সাজাতে হবে,
(৩) ফল একের অধিক স্তরে সাজাতে হলে উভয় স্তরের মাঝে নরম গদির মত করে পাতা, কাগজ বা খড় কুটা দিতে হবে ।
(৪) পরিবহন প্যাকেট বায়ুরোধী না হলে আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে ।
(৫) দ্রুত পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে ।
(৬) হিমায়িত গাড়িতে পরিবহন করা হলে ফল অনেকটা নিরাপদ থাকবে ।
বাজার তথ্য সংগ্রহ
১) বেশি করে ফল উৎপাদন পরিকল্পনা থাকলে বাজারের পণ্য সরবরাহ ও চাহিদার তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এ ব্যাপারে বাজার কমিটির সাথে যোগাযোগ করতে হবে ।
(২) কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা পরিসংখ্যান বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে অঞ্চল বিশেষে ফল উৎপাদনের তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
(৩) স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক প্রণয়নকৃত হাটবাজারের ট্যারিফ সার্ভে তথ্য নেয়া যেতে পারে,
(৪) স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের জন্য আড়ৎ বা গুদামসমূহের হিসেব বিপণন বিভাগের নিকট হতে নিতে হবে।
(৫) ফড়িয়া বা দালালদের নিকট হতে ফল উৎপাদন ও বিক্রয় বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে । কেননা তারা স্থানীয়ভাবে ঘুরে ঘুরে পণ্য ক্রয় করে ও আড়তে পাঠায়। তারা যদি ব্যাংক হতে বা ধনী ব্যবসায়িদের নিকট হতে অগ্রীম টাকা পায় তাহলে ক্রয়ের ও বিক্রয়ের আগ্রহ এক ধরনের হবে। আবার নিজ পুঁজিতে ক্রয় ও বিক্রয় করে থাকলে আগ্রহ অন্য ধরনের হবে । যা বাজার দরের ওপর প্রভাব ফেলে ।
বাজার তথ্য বিশ্লেষণ
(১) ফল উৎপাদান ও চাহিদার পরিমাণ এবং বিক্রয় স্থানগুলোর অবস্থান এবং সুবিধা-অসুবিধা
(২) ফল পরিবহণ সুবিধা এবং প্রেরণকৃত স্থানসমূহের চাহিদা জানতে হবে, জানতে হবে ।
(৩) বিভিন্ন ফল একইসাথে একই বাজারে বাজারজাতকরণ না করে বিভিন্নমুখী পরিকল্পনা করতে হবে
(৪) উৎপাদান বেশি হলে বা বাজারে সরবরাহ বেশি হলে অতিরিক্ত ফল সংরক্ষণ করার সুবিধা আছে কিনা তা জানতে হবে,
(৫) ফল উৎপাদন অঞ্চলে উৎপাদিত ফলের জাতগুলোর তথ্য জানতে হবে। কেননা একই জাতের ফল বেশি লাগানো হলে সেগুলো একই সাথে উৎপাদিত হবে এবং একই সাথে বাজারে আসবে। যা বাজারমূল্যের ওপর প্রভাব ফেলবে।
ন্যায্য মূল্য বা উচ্চ মূল্য নিশ্চিতকরণ
(১) বাজারের চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ।
(২) বিভিন্ন ধরনের ফলের উৎপাদন এলাকা চিহ্নিত করতে হবে। তারপর এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন সময়ে উৎপন্ন হয় এমন ধরনের ফলের জাত নির্বাচন করতে হবে। উৎপাদন কারিদের নিয়ন্ত্রিতভাবে (সময় ও পরিমাণ উৎপাদন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে ।
(৩) উৎপাদকগণ এক সাথে যাতে বাজারে ফল না আনে সেজন্য প্রচার ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে
(৪) স্থানীয়ভাবে বা কেন্দ্রিয়ভাবে এলাকা ভিত্তিক ফল উৎপাদনের সঠিক তথ্য থাকতে হবে । যাতে বাজারে পণ্য সরবরাহের কর্মসূচি প্রণয়ন করা সম্ভব হয় । সব এলাকায় যেহেতু সব ধরনের ফল উৎপন্ন একই সময়ে হয় না । সেহেতু উৎপাদন এলাকা হতে যেখানে চাহিদা আছে সেখানে সরবরাহের পরিমাণ নিরূপণ করে দেয়া যায় । এছাড়া পণ্য চলাচলের কর্মসূচি তৈরি করা যায় ।
(৫) অতিরিক্ত পণ্য উৎপন্ন হলে বা বাজারে সরবরাহ বেশি হলে হিমায়িত গুদামে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে । বাজারে সরবরাহ কমে গেলে তখন হিমাগার হতে সরবরাহ করতে হবে ।
(৬) প্রতি এলাকার জন্য সমবায় বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
(৭) প্রতিটি পণ্যের স্বীকৃত উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ করে ন্যূনতম বিক্রয় মূল্য ধার্য করতে হবে । যাতে বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেলেও উৎপাদনকারী সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় ।
(৮) উৎপাদনকারীগণ পণ্য বিক্রয় না করে সমবায় বাজারে সরবরাহ দিয়ে গেলে সমবায় বাজার সে পণ্য বিক্রয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। তাতে কৃষকদের হয়রানি বন্ধ হতে পারে ।
(৯) সমবায় বাজার উৎপাদক কর্তৃক সরবরাহকৃত ফল পরিষ্কার, গ্রেডিং ও প্যাকিং করে বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে ।
(১০) কৃষকদের ফল উৎপাদনে আগ্রহ বজায় রাখার জন্য উৎপাদন ও সরবরাহ বেশি হলে সে সময়ে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যেতে পারে ।
একটি গাছ থেকে অনুরূপ গাছের জন্ম লাভই গাছের বংশ বিস্তার অর্থাৎ যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাছ যৌন কোষের সাহায্য নিয়ে বা সাহায্য ব্যতিরেকে স্বতন্ত্র গাছ উৎপন্ন করে তাকে বংশ বিস্তার বলে । ফলে বংশ বিস্তার দু'ভাবে হয়ে থাকে--যৌন পদ্ধতিতে ও অযৌন বা অঙ্গজ পদ্ধতিতে। যৌন বংশ বিস্তার হলো ফুলের পুংকেশরের পরাগরেণুর সাথে ডিম্বাশয়ের ডিম্বানুর যৌন উপায়ে মিলনের ফলে উৎপাদিত বীজ থেকে চারা উৎপাদন পদ্ধতি । যৌন পদ্ধতিতে বংশবিস্তারের সাধারণ কারণগুলো হচ্ছে (ক) বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চারা উৎপাদন (খ) নতুন জাত উদ্ভাবন (গ) কলম করার জন্য স্টক গাছ তৈরি । কিছু কিছু গাছপালা আছে যেগুলো বীজ ছাড়া অন্য পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করা যায় না, যেমন-তাল, নারিকেল, সুপারি। যৌন পদ্ধতিতে উৎপন্ন গাছ কষ্ট সহিষ্ণু হয় ও অনেক দিন বেঁচে থাকে কিন্তু এ পদ্ধতি থেকে উৎপাদিত গাছের ফলে মাতৃগুণ বজায় থাকেনা দেরিতে ফুল ও ফল ধরে । যৌন কোষ ছাড়া মাতৃগাছের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নতুন গাছের জন্ম হয় তাকে অযৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার বলে। অযৌন বংশ বিস্তার বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে, কর্তন বা ছেদ কলমের মাধ্যমে দাবা, জোড় ও চোখ কলমের মাধ্যমে করা যায়। অযৌন বংশ বিস্তারের সুবিধা হচ্ছে মাতৃ গাছের অনুরূপ গুণাগুণ সম্পন্ন গাছ উৎপাদন করা যায় ও খুব তাড়াতড়ি ফল পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে নতুন কোন জাত উদ্ভাবন করা যায় না।
যৌন বংশ বিস্তার পদ্ধতি অনুশীলন
প্রাসঙ্গিক তথ্য
বীজের সাহায্যে যে বংশ বিস্তার সাধিত হয় তাকে যৌন বংশ বিস্তার বলা হয়। যেমন নারিকেল, সুপারি, পেঁপে, আমড়া, তরমুজ, ফুটি, আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদি ফলের বীজ থেকে বংশ বিস্তার করা হয়ে থাকে ।
যৌন পদ্ধতিতে ফলের বংশ বিস্তারে দুটি ধারায় বা ব্যবস্থায় চারা উৎপাদন করা হয়ে থাকে- ক) বীজতলা তৈরি করে বীজ সরাসরি বপনের মাধ্যমে চারা উৎপাদন খ) পলি ব্যাগে চারা উৎপাদন ।
ক) বীজ তলায় চারা উৎপাদন পদ্ধতি অনুশীলন প্রয়োগ
জনীয় উপকরণ
১। বীজ (বিভিন্ন ফলের) ২। বীজ পাত্র ৩। খড়কুটা ৪। খুঁটি ৫। রশি ৬। চাটাই ৭ । ঝাঝরি ৮ । খুরপি ৯। বাঁশের কাঠি ১০। পানি ১১। সার (জৈব রাসায়নিক) ১২। মাপার টেপ ১৩। কোদাল
কাজের ধাপ
সতর্কতা
খ) পলিব্যাগে ফলের চারা উৎপাদন পদ্ধতি অনুশীলন
প্রাসঙ্গিক তথ্য
পলিব্যাগে চারা উৎপাদন একটি আধুনিক প্রযুক্তি বা তুলনামূলকভাবে সহজ ও সুবিধাজনক এতে চারার যত্ন ভালোভাবে নেয়া যায় । তাছাড়া চারা সহজে মরে না, চারা পরিবহণ এবং রোপণ করাও বেশ সহজ।
১। প্রয়োজনীয় উপকরণ
২। কাজের ধাপ
সতর্কতা
অযৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার অনুশীলন
প্রাসঙ্গিক তথ্য
গাছের প্রতিটি কোষই নতুন গাছ সৃষ্টির কৌলতাত্ত্বিক উপাদান সমূহ ধারন করে । এজন্য একটি একক কোষ থেকেই নতুন একটি গাছের জন্ম হতে পারে । যৌন কোষ ছাড়া মাতৃগাছের অন্যান্য কোষ যেমন-কুঁড়ি, পাতা, ডাল, শিকড়, বাকল ইত্যাদি থেকে যে প্রক্রিয়ায় মাতৃগাছের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নতুন গাছের জন্ম হয় তাকে অযৌন পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার বলে। অযৌন বংশ বিস্তার বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে, কর্তন বা ছেদ কলমের মাধ্যমে, দাবা, জোড় ও চোখ কলমের মাধ্যমে করা যায় ।
শাখা কলাম ও গুটি কলম পদ্ধতি অনুশীলন
শাখা কলম পদ্ধতি অনুশীলন
১। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
২। কাজের ধাপ
সতর্কতা
গুটি কলম পদ্ধতি অনুশীলন
১। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
২। কাজের ধাপ
৩। সতর্কতা
শাখা কলম পদ্ধতি অনুশীলন
প্রাসঙ্গিক তথ্য
শাখা প্রশাখার উপযুক্ত অংশ সমূহ মাতৃগাছ থেকে কেটে আলাদা করে অনুকূল পরিবেশে রেখে ও উপযুক্ত যত্ন নিয়ে তা থেকে মূল পলব গজিয়ে নতুন চারা গাছ তৈরি করাই হলো শাখা কলম । শাখা কলাম চার প্রকার যথা-শক্ত কাঠ শাখা কলম, আধাশক্ত কাঠ কলম, কচি /কোমল শাখা কলম/ও বীরৎ শাখা কলম ।
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
ক) উন্নত জাতের মাতৃগাছ
খ) সিকেচার
গ) আরোলা চাকু
ঘ) নার্সারি বেড
ঙ) খুরপী
চ) কোদাল
ছ) ছায়াযুক্ত স্থান
কাজের ধাপ
সাবধানতা
১। শাখা কলম রোপণের সময় অগ্রভাগ উপরে রেখে নিম্নাংশ মাটিতে পুতে দিতে হবে ।
২। নার্সারি বেড অর্থ ছায়াযুক্ত স্থানে হওয়া উচিত ।
৩। নার্সারি বেডের মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকা আবশ্যক কিন্তু সুনিষ্কাশিত হওয়া উচিত।
সংস্পর্শ জোড় কলম পদ্ধতি অনুশীলন
প্রাসঙ্গিক তথ্য
গাছের আদি জোড় ও উপজোড় পরস্পর সংযুক্ত হয়ে যখন একটি একক গাছ হিসাবে বৃদ্ধি লাভ করে তখন তাকে গ্রাট জোড় কলম বলে এবং এ জোড় লাগানোর প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় গ্রাফটিং বা জোড় কলম। জোড় কলম দু'ধরনের (ক) সংযুক্ত বা সংস্পর্শ জোড় কলম (খ) বিযুক্ত জোড় কলম। সংস্পর্শ জোড় কলম পদ্ধতিতে উপজোড়কে তার নিজস্ব মূলতন্ত্রের উপর বৃদ্ধিরত অবস্থায় আদি জোড় সংস্পর্শে এনে জোড়া লাগানো হয় ।
প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রপাতি
কাজের ধাপ
সতর্কতা
ভিনিয়ার জোড় কলম পদ্ধতি অনুশীলন
১। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
কাজের ধাপ
৩। সতর্কতা
প্রাসঙ্গিক তথ্য: বাডিং এমন এক প্রকার জোড় কলম যাতে শাখার পরিবর্তে পলবের কুঁড়ি বা চোখ (ফ) উপজোড় রূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শীতের শেষে বসতে যখন গাছ বেশ সক্রিয়, রসপূর্ণ ও বর্ধনশীল হয়ে উঠে সে সময় অর্থাৎ মার্চ এপ্রিল মাস এর জন্য খুবই উপযোগী। চোখ কলমের জন্য প্রায় এক বৎসর বয়ক আদি জোড় নেয়া উত্তম । চোখ কলম ছয় ধরনের- ১ টি চোখ কলম ২। আই-চোখ কলম ৩। তালি চোখ কলম ৪ । চক্র চোখ কলম ৫ । কুচি চোখ কলম । ৬। ফোরকাট বা জিহ্বা চোখ কলম ।
টি চোখ কলম (T-budding)
কুঁড়ি চোখ কলম বিভিন্ন পদ্ধতি সমূহের মধ্যে একটি অত্যন্ত সুপরিচিত ও জনপ্রিয় পদ্ধতি । এ পদ্ধতিতে উন্নত ডালের একটি মাত্র চোখ ব্যবহার করে নতুন গাছ উৎপন্ন করা হয় ।
উপকরণ ও যন্ত্রপাতি
১। আদি জোড় ও উপজোড়
২। বাডিং ছুরি
৩। দ্বিফলক বিশিষ্ট ছুরি
৪ । নাইলন স্ট্রিপ বা সুতলি
কাজের ধাপ
১। নির্বাচিত আদি জোড় মাটি থেকে ২০-২৫ সেমি উপরে কাণ্ডের ওপর আড়াআড়ি ভাবে ১.৩ সে.মি/ পরিমাণ লম্বা কর্তন দিতে হবে । এ কাটা দাগের মাঝখানে থেকে নিচের দিকে ৪-৫ সে.মি. পরিমাণ আরেকটি লম্বালম্বি কর্তন দিতে হবে ।
২। লম্বালম্বি দাগ বরাবর চাকু দ্বারা কাঠ থেকে বাকল আলগা করতে হবে ।
৩ । কাঙ্খিত মাতৃগাছ থেকে সুপ্ত কুঁড়িসহ একটি বাকল কেটে নিতে হবে । বাকলটিকে ঢালের মত করে তৈরি করে নিতে হবে ।
৪ । কুঁড়িসহ বাকলটি আদিজোড় কর্তিত অংশে ঢুকিয়ে দিতে হবে ।
৫। কুঁড়িটিকে বাইরে রেখে পলিথিন ফিতা দ্বারা বাকলটি আদি জোড়ের সাথে ভালোভাবে বেঁধে দিতে হবে ।
৬। সংযোজিত কুঁড়িটি ২০-৩০ দিনের মধ্যে নতুন পলব ছাড়তে শুরু করবে। তখন জংলী ডালপালা গুলো ধীরে ধীরে কেটে দিতে হবে।
সাবধানতা
১। বাধার সময় কুঁড়িটি যেন ঢাকা না পড়ে ।
২। প্রস্ফুটিত কুঁড়ি ব্যবহার করা যাবে না ।
অলি চোখ কলম অনুশীলন
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
কাজের ধাপ
আদি জোড় নির্বাচিত করতে হবে এবং নির্বাচিত আদিজোড়ের যে কোন সুবিধাজনক স্থানে বর্গাকার বা আয়তকার বাকল তুলে ফেলতে হবে । কাঙ্খিত মাতৃ পাছ থেকে সুখ কুঁড়িসহ আদিজোর কর্তিত স্থানের অনুরূপ আকৃতির একটি বাকল তুলে এনে আদি জোড়ের কর্তিত স্থানে স্থাপন করতে হবে। কুঁড়িটি বাইরে রেখে পলিখিন কিভা বা নাইলন লিপি দ্বারা বাকলটিকে আদি জোড়ার সাথে ভালোভাবে বেঁধে দিতে হবে।
৩। সতর্কতা
ক) বাধার সময় কুঁড়িটি যেন ঢাকা না পড়ে খ) প্রস্ফুটিত কুঁড়ি ব্যবহার করা যাবে না ।
প্রাসঙ্গিক তথ্য
মাঠ ফসলের সাথে উদ্যান তাত্ত্বিক ফসলের মূল পার্থক্য হলো এই যে উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের ক্ষেত্রে ভালোভাবে চাষের পর জমিতে নির্দিষ্ট আকারের গর্ত খনন করার পর গর্তে সার প্রয়োগ করে গাছ লাগানো হয় ।
উপকরণ ও যন্ত্রপাতি
কাজের ধাপ
১। চাষের পর জমিতে নির্দিষ্ট দুরত্বে নির্দিষ্ট মাপের গর্ভ করতে হবে। গর্তের মাটি চারদিকে ছড়িয়ে রাখতে হবে।
২। গাছের আকৃতির উপর বিবেচনা করে পর্ভের গভীরতা নির্ণয় করতে হবে। তবে সাধারণত ছোট ধরনের গাছের বেলায় (ভালিম, পেঁপে) গতটি ৫০ সে.মি.×৫০ সে.মি.×৫০ সে:মি: মাঝারি (পেয়ারা, কুল) ধরনের গাছের জন্য ৭০ সে.মি.×৭০ সে:মি: ৭০ সে.মি. এবং বড় ধরনের (কাঁঠাল, তেতুল গাছের বেলায় ১ মি. ১ মি.×১ মি: করা যায় তবে মাটির অবস্থা বুঝে গর্ভের মাপ নির্ধারণ করতে হবে। বেলে দোঁয়াশ বা হালকা ধরনের মাটির জন্য পর্বের আকার কিছু ছোট হলেও চলে।
৩। গর্ত করার সময় মাটির উপরি ভাগের ২/৩ অংশ মাটি (ছবি 'ক' অংশ) একদিকে ফেলতে হবে । আবার নিচের ১/৩ অংশ মাটি অপর এক দিকে (ছবি 'খ' অংশ) রাখতে হবে । উপরের অংশের মাটি উর্বর বেশি । তাই এসব মাটিতে আলাদা ভাবে সার মেশানোর পর গর্ত ভরাট করার সময় উপরের অংশের মাটি নিচে এবং নিচের অংশের মাটি উপরে দিতে হয়।
৪। গাছের আকৃতির উপর নির্ভর করে প্রতি গর্তে ২০-৪০ কেজি পচা গোবর বা আবর্জনা পঁচা সার ও ২০০-৫০০ গ্রাম টিএসপি সার 'ক' অংশের উপরের মাটির সাথে ভালো করে মেশাতে হবে।
৫। সার- গোবর মিশ্রিত উপরের মাটি পুনরায় গর্তে ফেলতে হবে । কিছু কিছু মাটি গর্তে ফেলার পর পা দিয়ে চাপ দিতে হবে । যেন গাছে লাগানোর পর পানি পেয়ে মাটি বসে রোপিত গাছের ক্ষতি না হয় ।
৬। সার মেশানো মাটি দিয়ে গর্ত পূরণ করার এক সপ্তাহ পর গর্তে চারা লাগাতে হবে। চারা পট বা পলিথিন ব্যাগ থেকে সাবধানে বের করতে হবে ।
৭ । এখন চারার গোড়ার বলের পরিমাণ মাটি গর্ত হতে সরিয়ে রাখতে হবে । এরপর পলিথিন ব্যাগটি চাকু দ্বারা লম্বালম্বি ভাবে কেটে দিতে হবে। তবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যেন মাটির বলটি পলিথিন ব্যাগ কাটার সময় অথবা পট থেকে বের করার সময় ভেঙে না যায় ।
৮ । এমন চারাটি সোজা করে গর্তে বসাতে হবে । গর্তে বসানোর সময় দেখতে হবে যেন বেশি নিচে বা উপরে লাগানো না হয় । আগে যে পরিমাণ নিচে পুঁতা ছিল ঠিক তা বজায় রাখতে হবে ।গর্তে বসানোর পর গর্ত হতে সরিয়ে নেয়া মাটি দিয়ে বলটি ভালো করে চেপে দিতে হবে। চারা রোপণের পর তাতে ঝাঝরি দিয়ে পানি দিতে হবে ।
৯ । চারা লাগানোর পর উত্তর - পশ্চিম কোনা বরাবর গাছের সহায়ক খুঁটি দিয়ে হালকা ভাবে বেঁধে দিতে হবে । তা হলে বাতাসে হেলে গাছের ক্ষতি হবে।
১০। চারা লাগানোর পর নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে। চারা লাগানোর প্রথম কয়েকদিন কেবল পাতায় পানি দিয়ে গাছকে সতেজ রাখতে হবে এবং কয়েক দিন হালকা ছায়া দিতে পারলে ভাল হয় । বাঁশের খাঁচা দিয়ে চারটি গরু ছাগলের আক্রমণ হতে রক্ষার বাবস্থা নিতে হবে ।
সতর্কতা
১। হালকা মাটিতে গর্ত খননের সময় সাবধানে খনন করতে হবে যাতে গর্তের পাড় ভেঙে না যায় ।
২ । গর্ত ভরাট করার সময় গর্তের ভেতরের মাটি যেন আলগা না থাকে ।
প্রাসঙ্গিক তথ্য: গাছে ফল ধারণের পূর্বে একটি সবল ও সুন্দর কাঠামো তৈরির জন্য গাছে ছাটাই করা হয় । এ কাজটি প্রধান প্রধান কাণ্ডকে কেন্দ্র করে রা হয় বলে এ ধরনের ছাটাইকে ট্রেনিং বলা হয় । অর্থাৎ চারা বা গাছের বিশেষ উচ্চতায় প্রধান কান্ড কাটা বা ছাটাই করা হলো ট্রেনিং ।
ট্রেনিং করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ
১। ট্রেনিংয়ের জন্য গাছের চারা বা ছোট গাছ ২। ছুরি ৩। কঁচি ৪ । সিকেচার ৫ । ডাল কাটার দা ৬ । বোর্দোপেস্ট বা ছত্রাকনাশক ৭। গরম মামে ৮। পলিথিন
ট্রেনিং পদ্ধতি
ফল গাছে সাধারণত ৩ পদ্ধতিতে ট্রেনিং করা হয় । যথা
ক) উচ্চ কেন্দ্র খ) নাতি উচ্চকেন্দ্র এবং গ) মুক্ত কেন্দ্ৰ
কাজের ধাপ
(ক) উচ্চ কেন্দ্ৰ
১। নার্সারিতে ১ থেকে দেড় বছরের চারা নির্বাচন করতে হবে
২। নির্বাচিত চারাটির উচ্চতা ১ মিটার হলে ভাল হয়
৩। চারাটির নিচের দিকে পাশে গজানো শাখাগুলো এমনভাবে কাটতে হবে, যেন কাটা চিহ্ন মাটির সাথে। লাভাবে থাকে ।
৪ । শাখার যেখানে কাটা হবে তা যেন প্রধান কাণ্ড হতে কমপক্ষে ২.৫ সেমি, দূরে হয়। অর্থাৎ কাটা ডালটির গোড়ার অংশ প্রধান কাপ্ত হতে প্রায় ২.৫ সেমি. লম্বা থাকবে ।
৫ । শাখার যেখানে কাটা হবে তা যেন পর্ব সন্ধি বা গিরার উপর না হয়
৬ । প্রধান কাণ্ডের সাথে পাশে গজানো বা সংযুক্ত শাখা চিকন হলে প্রুনিং চাকু এবং শাখা মোটা হলে সিকেটিয়ার বা প্রুনিং করাত দিয়ে কাটতে হবে
৭ । সংযুক্ত শাখা কেটে গাছের কাঠামো সুন্দর ও শক্ত করতে ২ থেকে ৩ বছর সময় লাগে ।
৮। ট্রেনিং এর কাজটি পরিষ্কার ও রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে করতে হবে। খুব সকালে বা একেবারে বিকালে শাখা ছাটাই করা উচিত না ।
খ) নাতি উচ্চকেন্দ্র
১। এ পদ্ধতিতে কাজের জন্য নার্সারিতে ১ থেকে ২ বছরের চারা নির্বাচন করতে হবে
২ । চারাটির প্রধান কাণ্ড ১ মিটার উঁচু হওয়া পর্যন্ত পাশের শাখাগুলো কেটে দিতে হবে, তবে এ সময় প্রধান কাণ্ডের মাথা কাটা যাবে না ।
৩। এ সমস্ত শাখাগুলো বাড়ার সাথে সাথে প্রধান কাণ্ডটি ১.৫ থেকে ২ মিটার উঁচু হলে প্রধান কাণ্ডের মাথা কেটে দিতে হবে ।
৪ । প্রধান কাণ্ড ও পার্শ্ব শাখাগুলো কাটার পর পরই কাটাদ্যানে বোর্দোপেস্ট বা ছত্রানাশক লাগাতে হবে ।
গ) মুক্ত কেন্দ্ৰ
১। এ পদ্ধতিতে কাজের জন্য নার্সারিতে ১ বছরের চারা নির্বাচন করতে হবে
২। চারাটির প্রধান কাণ্ড ০.৫ থেকে ১ মিটার উঁচু হলে মাথা বা শীর্ষকুঁড়ি কেটে দিতে হবে
৩। এরপর পাশের শাখাগুলো বাড়তে দিতে হবে।
৪ । গাছ ঝোপালো করার প্রয়োজন হলে পাশের শাখাগুলো কিছুটা বড় হতে দিতে হবে। এরপর শাখাগুলোর মাথা কেটে দিতে হবে ।
৫ । তবে পাশে গজানো শাখা বেশি ঘন হলে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে কিছু কিছু শাখা কেটে দিতে হবে
৬। এ কাজ সম্পন্ন করে গাছের কাঠামো ঠিক করতে ২ থেকে ৩ বছর সময় লাগে
৭ । প্রতিবারই শাখার বা কাণ্ডের কাটাস্থানে বোর্দোপেস্ট বা ছত্রাকনাশক লাগাতে হবে ।
প্রাসঙ্গিক তথ্য: প্রুনিং বলতে গাছের যে কোন অপ্রয়োজনীয় অংশ ছেটে ফেলা বা কেটে বাদ দেয়া বোঝায় । ছাটাই এর উদ্দেশ্য হলো গাছকে সুন্দর রূপ দেয়া, গাছের ডালপালা বেশি দৃঢ় করা, বেশি পরিমাণে ভাল গুণাগুণ সম্পন্ন ফল ধরানো ফলন বেশি করা। গাছ ছাটাই-এর সাথে ফল উৎপাদনের সরাসরি সংযোগ আছে । ছাটাই করে গাছের ডালপালার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়। সঠিকভাবে ও সময়মত ছাঁটাই করতে না পারলে ফলবতী গাছে ফলন কমে যায় এবং বেশি সময় ধরে প্রতিক্রিয়া দেখা যায় । এমনকি ছাটাই বেশি হলে গাছ মারাও যেতে পারে । সঠিকভাবে ছাটাইয়ের ফলে গাছের পূর্ণ বিকাশ হয়, ফলের রঙ সঠিক হয়, ফলের আকার ভাল হয়, ফল বেশি হয় । এমনকি ফলের গুণগত মানান্নোয়ন হয় এবং গাছের রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কমে যায় । ছাঁটাইকৃত গাছের ফল সংগ্রহ করা সহজ হয় এবং অন্যান্য পরিচর্যা করাও সুবিধাজনক হয় ।
এ কাজ করার জন্য একটি গাছের নিচে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। লেবু, পেয়ারা, ডালিম, কুল, গালাপজাম ইত্যাদি গাছের গোড়া থেকে লম্বা তেউগ উৎপন্ন হয় । এগুলো অন্যান্য ডালপালার নিচে থাকে এবং কলম করার উপযোগী নয়। এরা নিজেরা তেমন খাদ্য প্রভুত করতে পারে না । তাই এসব ডাল ছাটাই করা উচিত।
উপকরণ
১। ছুরি
২। সিকেচার
৩। ছাটাই ছুরি বা ডাল কাটার দা
৪ । গাছ ছাটাই করাত
৫ । ডাল কাটার কঁচি
৬। বড় গাছের ডাল কাটা কাঁচ বা পালে প্রনার
৭। ডেটল পানি
৮। খন্তা বা শাবল
৯ । কাতে বা কাঁচি
ছাটাই-এর প্রকারভেদ গাছ নির্বাচন
ক) ডালপালা ছাঁটাই এর উপযযাপী গাছ (কুল, কাঁঠাল, আম, লিচু, কামরাঙা, পেয়ারা ইত্যাদি)
খ) শিকড় ছাঁটাই এর উপযাগী গাছ (কাঁঠাল, লিচু, লেবু, কথবেল, জামরুল ইত্যাদি)
গ) ফল পাতলাকরণের উপযোগ গাছ পেঁপে, আমড়া, তরমুজ, জামরুল ইত্যাদি)
ঘ) পাতা ছাঁটাই এর উপযোগী (কলা, নারিকেল, খেজুর, তাল ইত্যাদি)
কাজের ধাপ
১ । ডাল ছাঁটাই এর যন্ত্রপাতি ধারাল, পরিষ্কার পরিছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে ।
২। ছোট, কম বয়স্ক এবং ফল উৎপাদন শুরু করেছে এমন গাছে শুধু ছোট ডালপালা কাটতে হবে । যা গাছের নিচের দিকে প্রধান কাণ্ড হতে বের হয়ে ছোট অবস্থায় থাকে। এছাড়া প্রধান প্রধান ডালা হতে ছোট ছোট ডালপালা বের হয়ে যেগুলো গাছের ভিতরমুখী হয়ে থাকে। সেগুলো কেটে ফেলতে হবে ।
৩। পুরাতন ও বড় গাছে ভারী আকারে ও বেশি পরিমাণে ছাঁটাই করতে হবে।
৪ । যে কোন গাছের বেলায় মৃত, রাগাক্রান্ত বা ঝড়ে ভাঙ্গা ডালপালা কেটে দিতে হবে ।
৫ । প্রচণ্ড খরা বা তীব্র শীতের সময় গাছের ডালপালা ছাটাই করা যাবে না ।
৬। যে সব গাছের পাতা ঝরে যায় সে সমস্ত গাছের পাতা ঝরার ১ মাস পরে অপ্রয়োজনীয় ডালা কেটে দিতে হবে।
৭। চিরসবুজ গাছের ফল পাড়ার পর পরই অপ্রয়োজনীয় ডালা কেটে দিতে হবে।
৮ । যে কোন গাছের প্রধান কাণ্ড হতে একই উচ্চতায় উভয় দিকে সামনাসামনি গজানো শাখার একদিকের সুস্থ ও সবল একটি ডালা রেখে প্রথমে অন্যটি কেটে দিতে হবে ।
৯ । পরবর্তীতে ঠিক উপরের দিকে প্রধান কাণ্ড হতে অনুরূপভাবে সাজানো শাখায় প্রথমে যেদিকে রাখা হয়েছে তার বিপরীত দিকেরটা রেখে অন্যটি কেটে দিতে হবে। এভাবে উভয়দিকে পর পর একান্তর ক্রমিকভাবে ডালা রেখে অন্যটি কেটে দিতে হবে। এতে গাছের ভারসাম্য রক্ষা হয় ।
১০ । ডালার যে স্থানে কাটা হবে তা প্রধান কাণ্ডের বা শাখা প্রশাখার পূর্ব সৃণি হতে ৫-০ সেমি. উপরে হতে হবে।
১১ । ডালা কাটার সময় প্রথমে ডালার নিচের দিকে ডালার ব্যাসের তিনভাগের একভাগ বা তার চেয়ে কম পরিমাণ কাটতে হবে । তারপর উপরের দিকে তিনভাগের দুই ভাগ কাটতে হবে । সম্পূর্ন ডালা কাটার পর কাটা স্থান সমান করে দিতে হবে।
১২ । কাটা স্থানে ছত্রাকনাশক বা আলকাতরার প্রলেপ দিতে হবে ।
১৩ । ছাঁটাই এর কাজ বৃষ্টিপাত বা মেঘলা আবহাওয়ার সময় করা উচিত না ।
১৪ । গভীর মূল বিশিষ্ট গাছের গোড়া হতে ১০০ থেকে ৩০০ সেমি. দূর দিয়ে নালা খনন করতে হবে । এতে নালার ভেতরের যে মূল কাটা পড়বে তাতেই মুল ছাটাই হবে । এই নালাটি গাছের চারিপাশ দিয়ে সম্পূর্ণ বৃত্তাকার, অর্ধবৃত্তাকার বা এক চতুর্থাংশ বৃত্তাকার হিসেবে করা যেতে পারে। তবে চওড়ায় বিভিন্ন মাপের হতে পারে।
১৫ । গাছের গোড়া হতে কিছু দুর দিয়ে মাঝে মাঝে গর্ত খনন করা হলে মমূল ছাটাই হবে । আবার সারা বাগান জুড়ে লাঙ্গলের সাহায্যে জমি চাষ করা হলেও অনেক মূল ছাটাই হবে ।
১৬ । ফল বেশি ঘন হলে বা একই বোটায় বেশি ফল ধরলে ছোট, দুর্বল এবং প্রধান বোটার পাশ দিয়ে বা বোটা হতে সরাসরি বের না হওয়া ফলগুলো কেটে দিতে হবে। তাতে অন্যান্য ফলগুলো বড় হবে ও আকার ভাল হবে।
১৭। পাতা ছাটায়ের জন্য সাধারণত ডালপালাহীন গাছের নিচের দিকে ঝুলে থাকা বয়স্ক পাতাগুলো গোড়াসমেত পরিষ্কার করে দিতে হবে । তবে পাতার গোড়া তাজা ও শক্ত থাকলে পুত্র ফলকের কিছু অংশ রেখে কাটতে হবে । এছাড়া ছোট চারা স্থানান্তরের সময় কিছু কিছু পাতাও কেটে দিতে হয় ।
আমড়া, নারিকেল, আঙ্গর ও লিচুর গুরুত্বপূর্ণ রোগ সনাক্ত ও রোগের নমুনা প্রদর্শন:
প্রাসঙ্গিক তথ্য:
রোগ জীবাণু উদ্ভিদ দেহে প্রবেশ করে সেখানে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করে । পোষাকের দেহের কোষ নষ্ট করে । খাদ্যরস গ্রহণ করে । উদ্ভিদের দৈনন্দিন কাজে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এ অস্বাভাবিকতার বাহ্যিক প্রকাশকে আমরা রোগের লক্ষণ বলে (Symptom)। এটা বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পায়। যেমন পাতা পঁচা, পাতার দাগ, পাতা পাড়ো, কাণ্ডের দাগ। কাণ্ড পচা, ঢলে পড়া ইত্যাদি । আবার কোন কোন সময় রোগের এ বাহ্যিক লক্ষণের মধ্যে রোগজীবাণুর উপস্থিত থাকে । যেমন একটি পাতার দাগের মধ্যে রোগজীবাণুর পারে বা মাইসেলিয়াম খালি চোখে দেখা যায় । লক্ষণের মধ্যে রোগজীবাণুর আংশিক উপস্থিতিকে চিহ্ন বা সাইন বলে ।
প্রয়োজনীয় উপকরণ
১। রোগাক্রান্ত গাছের পাতা, ডাল, ফুল, ফল বা মূল ।
২। কাগজ, পেনসিল, রাবার।
৩। আমড়া, নারিকেল, আঙ্গুর ও লিচুর প্রধান প্রধান রোগের নমুনা ।
কাজের ধাপ
১। সংগৃহীত নমুনা (রোগাক্রান্ত, পাতা, ফুল, ফল, বাকল ও মূল) টেবিলে নিয়ে আসতে হবে ।
২। নমুনাটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে ।
৩ । নমুনার কোন অংশে রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তা খাতায় লিখে রাখতে হবে।
৪ । আক্রান্ত অংশের রং, আকার, আয়তন, ইত্যাদি লিখে রাখতে হবে ।
৫ । আক্রান্ত অংশে দাগ পড়লে দাগের সংখ্যা নিরুপণ করতে হবে ।
৬। লিখিত লক্ষণের সাথে প্রকাশিত বইয়ের লক্ষণের সামঞ্জসাতা মিলিয়ে দেখতে হবে।
৭ । রঙিন স্লাইড প্রদর্শিত হলে, স্লাইডগুলো ভাল করে দেখ, আক্রান্ত অংশের রঙের পরিবর্তন লক্ষ করতে হবে ।
৮ । পুক, ছবি হারবেরিয়াম শিট ও কাচের আধারে রক্ষিত নমুনার বৈশিষ্ট্য ও জীবাণুর বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে রোগকে নিশ্চিতভাবে সনাক্ত করতে হবে ।
সতর্কতা
১ । রোগাক্রান্ত পাতা ডাল, ফল বা মূল সংগ্রহের সময় রোগ না পোকার আক্রমণ বা অন্য কোন কারণ তা দেখে নিতে হবে ।
২। রোগাক্রান্ত নমুনাটি সংগ্রহের পরপরই পর্যবেক্ষণ করতে হবে । শুকিয়ে গেলে অনেক লক্ষণ চেনা নাও যেতে পারে ।
বোর্দো মিক্সচার প্রস্তুত পদ্ধতি অনুশীলন
প্রাসঙ্গিক তথ্য: এটি একটি তামাঘটিত অজৈব, খুবই জনপ্রিয় ও সবচেয়ে পুরাতন ছত্রাকনাশক । এ ঔষুধ বিভিন্ন মাত্রায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে । তবে সাধারণত শতকরা একভাগ ক্ষমতা সম্পন্ন বোর্দোমিক্সচার গাছে ছিটানো হয় ।
প্রয়োজনীয় উপকরণ
১। কুঁতে ২। চুন ৩ । পানি ৪। ২টি ছোট ও একটি বড় মাটির পাত্র ৫। ২টি বাঁশ বা কাঠের কাঠি ৬ । প্রেয়ার ৭ । একটি ইস্পাতের চাকু ।
কাজের ধাপ
১। কুঁতে ও চুন পৃথকড়াবে মিহি করে গুড়া করতে হবে ।
২। ছোট মাটির পাত্র দু'টিতে ৫ লিটার করে পানি নিতে হবে ।
৩। একটি পাত্রে ১০০ গ্রাম মিহি চূর্ণ কুঁতে ও অন্য পাত্রে ১০০ গ্রাম মিহি চূর্ণ চুন ঢেলে দিতে হবে ।
৪ । বাঁশের কাঠি দিয়ে পৃথক পৃথকভাবে ঘুটে নিতে হবে । ৮-১০ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে ।
৫ । অতঃপর দু'পাত্রের দ্রবণ বড় মাটির পাত্রে একসাথে ঢেলে নিতে হবে । পাত্রটি একটু ঝাঁকিয়ে নিতে হবে । এটাই বোর্দো মিক্সচার অর্থাৎ তৈরি মিশ্রণটি বোর্দো মিক্সচার ।
৬। মিক্সচারের রঙ পরীক্ষা করতে হবে ।
৭। মিশ্রণের রঙ গাঢ় নীল হলে মিশ্রণ সঠিক হয়েছে বুঝতে হবে। সবুজ রঙ বা সাদাটে হলে বুঝতে হবে যথাক্রমে পুঁতে বা চুন বেশি হয়েছে । ৮। বোর্দো মিক্সচার এখন স্প্রে করতে পারবে।
সতর্কতা
১। কুঁতে ও চুন মিহি করে চূর্ণ হয়েছে কি না ভাল করে দেখে নিতে হবে। চূর্ণ করার পর তঁত ও চুন সঠিক ভাবে মেপে নিতে হবে।
২। বোর্দো মিক্সচার তৈরির ২-৩ ঘন্টা মধ্যে স্প্রে করতে হবে ।
৩ । প্রস্তুতকৃত বোর্দো মিক্সচার ইস্পাতের চাকুর অগ্রভাবে ডুবিয়ে দেখো লালচে দাগ পড়ে কি না। না পড়লে বুঝবে মিশ্রণ ঠিক হয়েছে।
পোকা মাকড় সংগ্রহের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ফলের উপকারী ও অপকারী পোকা মাকড় চেনা এবং এ পোকা ক্ষতির ধরন সম্পর্কে জানা, যাতে করে এ পোকা দমনের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেয়া যায় ।
উপকারী পোকা মাকড় শনাক্তকরণ প্রাসঙ্গিক তথ্য
যে সকল পোকা মাকড় প্রত্যক্ষ বা পরাক্ষেভাবে মানুষের কোন না কোন উপকার করে সে সকল পোকাগুে লাকেই উপকারী পোকা বলে ।
প্রয়োজনীয় উপকরণ
১। পোকা ধরার জাল ২। পানির পাত্র ৩। ড্রইং পেপার ৪। পেন্সিল ৫। রাবার ৬। ফরসেপ ৭। স্কেল ৮। ইনসেক্ট কিলিংজার ৯ শস্যক্ষেত (ফলের গাছ/ফলের বাগান) ১০। পেট্রিভিস বা ছোট পার্টিক কৌটা ।
কাজের ধাপ
১। পোকা ধরার জাল নিয়ে শস্য ক্ষেতে যেতে হবে (কলা, পেঁপে, আনারস, আম, পেয়ার, লিচু, কাঁঠাল, লেবু ইত্যাদি বাগান
২। জল যারা পোকা ধরতে হবে।
৩। পানির পাত্রের সাহায্যে পোকা ধরতে হবে ।
৪। এরপর পোকা গুলো ইনসেক্ট কিপিং জারে অথবা (ক্লোরাফের্ম দ্বারা ভেজাভুলা বিশিষ্ট কাচের পাত্র কিছুক্ষণ ঢাকনা বন্ধ করে রাখতে হবে। এতে পোকাগুলো মারা যাবে ।
৫। এবার জার থেকে মৃত পাকাগুলো বের করতে হবে।
৬। মৃত পোকাগুলো ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করতে হবে।
৭। সংগৃহীত পোকাগুলো বইয়ে দেয়া বর্ণনার সাথে মিলিয়ে কোনটি কি পোকা তা সনাক্ত করতে হবে ।
৮ । এখন ড্রইং পেপারে সনাক্তকৃত পোকা গুলোর চিত্র অঙ্কন করতে হবে।
৯। অতপর অঙ্কিত পোকার চিত্রে এর বিভিন্ন উপাঙ্গ চিহ্নিত করতে হবে।
সতর্কতা
১। কিপিং বাতেল সাবধানে ব্যবহার করতে হবে। এটি যাতে ভেঙ্গে না যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে । কিলিং বোতলে ভুলেও শ্বাস নেয়া বা গন্ধ শুকা যাবে না।
প্রাসঙ্গিক তথ্য
ফসলের ক্ষতিকর পোকা মাকড় সনাক্তকরণের একটি সহজ উপায় হলো নমুনা স্থাপন কাগজের বা হারবেরিরাম সিটের অ্যালবাম তৈরি। এতে সংগৃহীত ক্ষতিকর পোকার শুদ্ধ নমুনা থাকে এবং তার পাশে নামসহ সনাক্তকণের বৈশিষ্ট্য লেখা থাকে। এতে ব্যবহারিক শ্রেণি কক্ষে শিক্ষার্থীদের অনুশীলনের জন্য সংরক্ষিত নমুনা অত্যন্ত কাজে লাগে। শিক্ষার্থীরা ফসলের ক্ষতিকর প্রধান প্রধান পোকার নাম জানা, চেনা ও সনাতকরণের কাজ অতি অল্প সময়ে সহজেই করতে পারে ।
হারবেরিয়াম শিটের একটি অ্যালবাম তৈরির একটি নমুনা নিচে সেরা হলো
পোকার নমুনা নং | পোকার নাম (বৈজ্ঞানিক নাম ও গোত্র সহ) | আক্রান্ত ফসল | ক্ষতির প্রকৃতি ও লক্ষণ | অন্যান্য বৈশিষ্ট্য |
প্রয়োজনীয় উপকরণ
১ । নমুনা পোকা ২ । বোর্ড কাগজযুক্ত বড় খাতা ৩। কলম ৪ । কসটেপ ৫। বড় পুরাতন খবরের কাগজ বা চোষ কাগজ ৬ । পোকা ধরার হাত জাল ৭ । কিলিং জার ৮। পেট্রিডিস ৯। ফরসেপ বা চিমটা ১০। ক্লোরফম ইত্যাদি দ্বারা ভেজা তুলা ১১। স্কেল ১২। ফসলের ক্ষেত বা বাগান ইত্যাদি ।
কাজের ধাপ
১। ফসলের ক্ষেত বা বাগান হাতে হাতে জাল বা অন্যকোন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পোকা ধরে সংগ্রহ করতে হবে।
২। সংগৃহীত পোকা কিলিং জারে রেখে মেরে ফেলতে হবে ।
৩। কিলিং জার হতে মৃত পোকা বের করে পেট্রিডিসে নিতে হবে ।
৪ । পেট্রিডিস হতে সংগৃহীত পোকাগুলো একে একে পুরাতন খবরের কাগজ বা বড় বই-এর ভাজে রেখে শুকাতে হবে ।
৫ । কয়েক দিন পর পোকাগুলো বের করে নিতে হবে।
৬। প্রাসঙ্গিক তথ্য সারণি অনুযায়ী খাতায় ছক কেটে শিরোনামগুলো লেখে নিতে হবে ।
৭ । পোকার নমুনার শিরোনামের নিচে এক এক করে একাধিক পোকা স্কচটেপ দিয়ে লাগাতে হবে ।
৮ । শিরানোম অনুসারে বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যবেক্ষণ কার প্রতিটি পোকার সামনের ঘরগুলো লিখতে হবে ।
৯ । এভাবে প্রতি পৃষ্ঠায় একাধিক ক্ষতিকর পোকার নমুনা লাগিয়ে হারবেরিয়াম বা এলবাম তৈরি করতে হবে ।
সতর্কতা
১। একটি পোকার নমুনার উপর আর একটি পোকার নমুনা লাগানো যাবেনা ।
২। পোকা চাপ খেয়ে ভালোভাবে শুকানোর পর লাগাতে হবে ।
৩ । উন্নত মানের হারবেরিয়াম সিট ও কচ টেপ ব্যবহার করতে হবে।
আরও দেখুন...